ঢাকা: বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা এবং উৎকণ্ঠা নিয়ে বিদায় নিল ২০২৪। নতুন বছর কেমন যাবে? এ বছর নির্বাচন হবে নাকি রাজনীতিতে নতুন করে সংকট এবং সহিংসতা দানা বেঁধে উঠবে? বাংলাদেশ আবার রক্তাক্ত হবে কি না ইত্যাদি নানা প্রশ্ন নিয়েই নতুন বছরকে স্বাগত জানাল বাংলাদেশ।
জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছিল গত বছরের ৫ আগস্ট। শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি জাতীয় ঐক্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমেই গণতন্ত্রের দ্বার উন্মোচিত হওয়ার একমাত্র পথ। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে ততই জাতীয় ঐক্যে বিভক্ত রেখা দেখা দিচ্ছে। আর এ বিভক্তি সৃষ্টির পেছনে সুশীল সমাজের একটি অংশের প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে বলেই দৃশ্যমান হচ্ছে। বিশেষ করে সুশীল সমাজ নিয়ন্ত্রিত প্রভাবশালী একটি বাংলা এবং একটি ইংরেজি দৈনিক আবার বাংলাদেশে বিরাজনীতিকরণের খেলায় মেতেছে। পর্দার আড়ালে বিভক্তির সৃষ্টির চেষ্টা করছে এ গোষ্ঠী। আর এ কারণেই তারা বিএনপির সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং জামায়াতের বিরোধ সৃষ্টি করার জন্য একটি নিপুণ নীলনকশার বাস্তবায়ন করে চলেছে নীরবে। সেই নীলনকশার অংশ হিসেবেই বছরের শেষদিকে জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতা নাসীরুদ্দীনের এক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় একটি প্রভাবশালী দৈনিকে। সেই সাক্ষাৎকারে নাগরিক কমিটির নেতা বিএনপিকে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে অভিহিত করেন। এটি অপ্রয়োজনীয়, অনভিপ্রেত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্ক। কিন্তু এ সাক্ষাৎকার একটি প্রশ্ন জাতির সামনে এনেছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কি কোনো ‘কিংস পার্টি’ গঠিত হতে যাচ্ছে?
মনে রাখতে হবে, দীর্ঘদিন একটি দেশ অনির্বাচিত নেতৃত্ব দ্বারা পরিচালিত হতে পারে না। এটি দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি সবকিছুকে বিপদগ্রস্ত করবে
বিএনপি মাইনাসের নীলনকশাগত কিছুদিন ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর গুঞ্জন রয়েছে যে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি সরকারের সমর্থন নিয়ে একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চাচ্ছে। আগামী নির্বাচনে তারা প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চায়। আর এ কারণেই জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা বিভিন্ন ফোরামে বিএনপির বিরুদ্ধে সাঁড়াশি বক্তব্য রাখা শুরু করেছেন। বিএনপির নানারকম সমালোচনা করা, বিএনপির অর্জনকে বিতর্কিত করার একটি প্রকাশ্য তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে গত দুই মাসে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জামায়াতও। সাধারণ মানুষ মনে করছে, জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এ বিএনপিবিরোধী অবস্থানের পেছনে সুশীল সমাজের একটি অংশের মদত আছে। আর সাধারণ মানুষ এটাও বিশ্বাস করে যে জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিকশিত করার ক্ষেত্রে সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত বলা হচ্ছে যে, তারা সম্পূর্ণ নির্দলীয় এবং নিরপেক্ষ। কোনো ‘কিংস পার্টি’ গঠনের পরিকল্পনা তাদের নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো ৮ আগস্ট শপথ নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সরকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের ছাত্রদের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের প্রবণতা লক্ষণীয়। এ প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। বিশেষ করে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা করেছিলেন যে, তাঁর নিয়োগকর্তা হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিনজনকে সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীতে নেওয়া হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুযায়ী উপদেষ্টামণ্ডলী নিয়োগ করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণসহ বিভিন্ন বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যা বলেছে সেটি সরকার করেছে। এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের পক্ষ থেকে যখন রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের বিষয়টি আনা হয় তখনো সরকার এ বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করে। সরকারের দুজন উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতি অপসারণের বিষয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। কিন্তু এ সময় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিচক্ষণতা এবং দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয় বিএনপি। মূলত বিএনপির দৃঢ় অবস্থানের ফলেই একটি সম্ভাব্য সাংবিধানিক সংকট থেকে দেশ রক্ষা পায়। বিএনপি একটি পোড় খাওয়া রাজনৈতিক দল। দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দলটি এখন ইস্পাতকঠিন ঐক্যে নিজেদের মজবুত করেছে। একটি পরিণত এবং দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির পুনর্জন্ম হয়েছে। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং বিচক্ষণতার দিক থেকে এ দলটি এখন বাংলাদেশে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। শুধু চব্বিশের গণ অভ্যুত্থান নয়, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গত ১৫ বছর বিএনপি আন্দোলন করছে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে। এ সময় বিএনপির প্রায় প্রত্যেক নেতার বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু এসব মামলার পরও বিএনপি হতোদ্যম হয়নি, পথ হারায়নি। বিএনপি কোনো ভুঁইফোড় রাজনৈতিক দল নয়। কাজেই বিএনপিকে ‘কিংস পার্টি’ বলে তাকে রাজনৈতিক মাঠে কোণঠাসা করার চেষ্টা বিরাজনীতিকরণের ‘নীলনকশা’ বাস্তবায়নের অংশ বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। এটি মাইনাস ফর্মুলারই এক বর্ধিত রূপ। বিরাজনীতিকরণ সুশীলদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ। যার আপাত লক্ষ্য, দেশে গণতন্ত্রের উত্তরণকে বাধাগ্রস্ত করা। আর এ কারণেই আমরা লক্ষ্য করছি যে, ৩১ ডিসেম্বরের শহীদ মিনারে সমাবেশ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বলেছেন যে, আগে সংস্কার এবং বিচার, তারপর নির্বাচন। অর্থাৎ নির্বাচনকে তারা বিলম্বিত করতে চাইছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক সংগঠন, জাতীয় নাগরিক কমিটি আগে থেকেই বলেছে- শেখ হাসিনার বিচার ছাড়া বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া যত পিছিয়ে যাবে তত গণতান্ত্রিক ধারা ব্যাহত হবে। এর ফলে সুশীল সমাজের রাজত্ব আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে।
দীর্ঘদিন ধরে সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর মধ্যে যারা বিরাজনীতিকরণের পৃষ্ঠপোষক, যারা প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার নিয়ন্ত্রিত তারা এখন প্রকাশ্যে নির্বাচনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তাদের এ অবস্থান যখন রাজনৈতিক অঙ্গনে ধিক্কৃত এবং সমালোচিত হচ্ছিল তখনই তারা জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সামনে এনেছেন। এ গোষ্ঠীই বাংলাদেশে ২০০৭ সালে এক- এগারো এনেছিল। একটি অনির্বাচিত সরকারকে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় রাখার সব কলাকৌশল, চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি। এবার তারা একই চেষ্টা করছেন। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, সরকারের ভিতর যারা নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে চান, এখনই নির্বাচন করতে চান না, তারা ইদানীং অত্যন্ত সক্রিয়। তারা দেশে দীর্ঘদিন অনির্বাচিত সুশীলদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু এ নীলনকশা বাস্তবায়নের পথে প্রধান বাধা হচ্ছে বিএনপি। এ কারণেই বর্তমানে টার্গেট করা হয়েছে বিএনপিকে। এখন শুরু হয়েছে বিএনপি মাইনাসের নীলনকশা। যদি বিএনপিকে চাপে ফেলা যায়, বিএনপিকে কোণঠাসা করা যায় তাহলে বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা সম্ভব। আর এখন সেটাই করার চেষ্টা করছে। সুশীল সমাজ বিপুল সমর্থনপুষ্ট বিএনপির সঙ্গে জনপ্রিয়তার লড়াইয়ে পেরে উঠবে না। এ কারণে তারা জাতীয় নাগরিক কমিটিকে দিয়ে একটা নতুন রাজনৈতিক বিন্যাস করার চেষ্টা করছে। এ কারণেই ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে জাতীয় নাগরিক কমিটির নাম সামনে এসেছে। আর সরকার যেভাবে নাগরিক কমিটির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে, জাতীয় নাগরিক কমিটিকে ব্যবহার করে ‘প্রথম আলো, ডেইলি স্টার গোষ্ঠী’ বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে দীর্ঘমেয়াদে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। আর এ নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য রাজনীতিতে একটি অনিশ্চিত পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। এ সরকার বর্তমানে কোনো সংকট নিরসনে সফল হতে পারছে না। কারণ তাদের জনভিত্তি ব্যাপক দুর্বল। আর এ কারণেই তাদের উচিত দ্রুত একটি নির্বাচন দিয়ে জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। বিচার এবং সংস্কারের আগে নির্বাচন নয়- এ ধরনের গণতন্ত্রবিরোধী বক্তব্যকে নিয়ে এসে জনগণের ভোটের অধিকার হরণে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। বিচার এবং সংস্কারের সঙ্গে নির্বাচনের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। সবগুলোই দেশের জন্য জরুরি এবং সব কাজই দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে।
হঠাৎ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপিবিরোধী একটি অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সুশীলদের কেউ কেউ বিএনপিকে নাগরিক কমিটির মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে। কিন্তু একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, চব্বিশের অভ্যুত্থান কোনোদিনই সফল হতো না, যদি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তিল তিল করে আন্দোলন গড়ে না তুলত। তাদের ধারাবাহিক আন্দোলনের পথ ধরেই শেষ পর্যন্ত জুলাই বিপ্লব সফল করেছে। শেষ ৩৬ দিনের আন্দোলনে অবশ্যই ছাত্রসমাজ সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু সেই আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করে দিয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। এখন বাংলাদেশে বিএনপির সঙ্গে জাতীয় নাগরিক কমিটিকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর ফলে একদিকে যেমন অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে গণতন্ত্রের পথ বন্ধুর হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতি সম্পর্কে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে। এটিই হলো সুশীল সমাজের লক্ষ্য। তারা যেমন ২০০৭ সালে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অনির্বাচিত সরকারকে দীর্ঘদিন রাখার পরিকল্পনা করেছিল, ঠিক এবারও সেরকম বিএনপিকে মাইনাস করার একটা নীলনকশা বাস্তবায়ন নীরবে চলছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে- দীর্ঘদিন একটি দেশ অনির্বাচিত নেতৃত্ব দ্বারা পরিচালিত হতে পারে না। এটি দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি সবকিছুকে বিপদগ্রস্ত করবে।
লেখক: নাট্যকার ও কলাম লেখক
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০৯, ২০২৫
এসআইএস