ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ পৌষ ১৪৩১, ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯ রজব ১৪৪৬

মুক্তমত

বাংলাদেশ কোনো একক গোষ্ঠীর দেশ হয়ে উঠবে না

আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ রুহেল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০২৫
বাংলাদেশ কোনো একক গোষ্ঠীর দেশ হয়ে উঠবে না

ফ্যাসিস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ‘রাজাকার’ মন্তব্যের পর যখন আমরা সব ভয় থেকে মুক্ত হয়ে হলে হলে ছাত্রলীগের ব্যারিকেড ভেঙে ‘তুমি কে আমি কে, রাজকার রাজাকার’ স্লোগান দেওয়া শুরু করি, তখন আমরা আসলে বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ ও তার সব ফ্যাসিস্ট কালচারাল-পলিটিক্যাল বয়ানকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করি। যে বাইনারি বয়ান আমাদের এতকাল পঙ্গু করে রেখেছিল, যা আমাদের নািসদের মতো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি করে রেখেছিল, যা আমাদের ঊনমানুষের জীবন যাপন করতে বাধ্য করেছিল, সেই বয়ানকে সাহসিকতার সঙ্গে মোকাবেলা করি।

১৫ জুলাইয়ের পর থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আমাদের লড়াইটা শুধু আওয়ামী লীগকে খেদানোর লড়াইয়ে থেমে থাকেনি, বরং আওয়ামী ফ্যাসিস্ট ন্যারেটিভকে, তার তৈরি করা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রকাঠামোকে ডিকনস্ট্রাকশন করা এবং পরে রিকনস্ট্রাকশন তথা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্যই মূলত আমাদের এই লড়াই। যদি শুধু রাজনৈতিক পটপরিবর্তন কিংবা ক্ষমতার ভাগাভাগির জন্য এই আন্দোলন হতো তাহলে কোনোভাবেই ছাত্র-জনতা মাঠে  নেমে আসত না, জীবন দিত না, আন্দোলনও সফল হতো না।

এই জায়গায় একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মাধ্যমে আমরা মূলত এই আন্দোলনের এসেন্স এবং পরবর্তী রাষ্ট্র সংস্কার কেন্দ্রিক বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর খুব সহজে পেয়ে যাব। প্রশ্নটা হলো, বিগত বছরগুলোতে পুরোপুরি  ‘অরাজনৈতিক’ থাকা জেন-জি ছেলেমেয়েরা কেন মূলত মাঠে নামতে বাধ্য হয়?

উত্তরটা সহজ। বিগত বছরগুলোতে আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি সর্বনিকৃষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছেছিল। ১৯৯৭-র পরে জন্ম নেওয়া ‘আধুনিক’ ছেলেমেয়েরা, যাদের কাছে সারা দুনিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতির জ্ঞান একেবারে হাতের মুঠোয়, তারা বাংলাদেশে প্রচলিত অসহিষ্ণু, অনুদার, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, তোষামোদি, সহিংস রাজনীতিকে ঘৃণা করতে শুরু করে।

এবং এই রাজনীতি যখন তাদের নিজেদের ভাইদের, বন্ধুদের জীবন কেড়ে নিতে শুরু করে, তাদের নিজেদের কিংবা নিজেদের পরিচিতদের ঊনমানুষের মতো জীবন কাটাতে বাধ্য করে, তখন তাদের হাতে অপশন ছিল একটাই, তা হলো রাস্তায় নেমে আসা।
তাদের রাস্তায় নেমে আসা এবং একটি সফল বিপ্লব ঘটানোর মাধ্যমে মূলত তারা একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে। তা হলো ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’। আর এই রাজনৈতিক বন্দোবস্তে বিগত বছরগুলোতে থাকা ফ্যাসিবাদী এলিমেন্টগুলো বাই ডিফল্ট বিলুপ্ত হয়ে যেতে বাধ্য।

ফলে বাহাত্তরের ফ্যাসিবাদী সংবিধান থাকবে কি না এই—প্রশ্নের অবতারণার সুযোগ কম; যেহেতু বাই ডিফল্ট এই সংবিধান বিলুপ্ত হয়ে যেতে বাধ্য।
যদিও অন্তর্বর্তী সরকার এখন পর্যন্ত সংবিধান বিলুপ্ত করেনি; তবে আমাদের বিশ্বাস উনারা আন্দোলনের এসেন্সকে ঠিকঠাক ধরে রেখে ফ্যাসিবাদী সংবিধানকে নিয়মতান্ত্রিক উপায়েই বিলুপ্ত করবেন। এখানে কিছু  স্টেকহোল্ডারের বিরোধিতা থাকলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যেক সঠিক দিকে নিয়ে যাওয়ার পথে সংবিধান বিলুপ্ত করার কোনো বিকল্প নেই বলে আমার মনে হয়।

ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, তাত্ত্বিকভাবে এই সরকার  কোনো বিপ্লবী সরকার না; কিন্তু জনমানসপটে এই সরকার মূলত বিপ্লবী সরকারই। প্রথাগত অন্তর্বর্তী সরকারগুলোর যে ধরনের দায়দায়িত্ব থাকে, সেসবের বাইরে এই সরকারের আরো কয়েক গুণ বেশি কাজ রয়েছে।

বাজারের অবস্থা এখনো আগুন। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়েনি। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমেনি। জিনিসপত্রের দাম নাগালের বাইরে। তা-ও গণমানুষের মধ্যে এই সরকার নিয়ে তেমন কোনো বিরক্তি নেই। সাধারণ মানুষ একটা ঠিকঠাক গণতান্ত্রিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রই চায়। তারা ফ্যাসিবাদ ২.০ চায় না। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে গণতান্ত্রিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে না পারলে এই সরকার ব্যর্থ হবে। যেহেতু জনমানসে এই সরকার মূলত বিপ্লবী সরকার, সেহেতু বিপ্লবী সরকার বা বিপ্লব-পরবর্তী সরকারের দায়িত্ব মূলত পুরো রাষ্ট্রকাঠামোই পরিবর্তন করা। শুধু একটা নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল করানোর জন্যে এই বিপ্লবে সাধারণ মানুষ শরিক হয়নি।

বাংলাদেশে আমরা এত দিন পর্যন্ত যে রাজনীতি দেখে আসছি, এই আন্দোলন সেইসব ট্র্যাডিশনাল পেশিনির্ভর রাজনীতি করা রাজনৈতিক দলগুলোকেও একটি শক্তিশালী বার্তা দেয়। যদি রাজনৈতিক দলসমূহের রাজনীতিতে ‘আধুনিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি’র ছোঁয়া না থাকে, যদি রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে দখলদারি, চাঁদাবাজির মনমানসিকতার পরিবর্তন না ঘটে, তাহলে ওই রাজনৈতিক দলসমূহের ভবিষ্যৎ আওয়ামী লীগের থেকে ভিন্ন কিছু হবে না। বাংলাদেশ আর ফ্যাসিবাদ ২.০ কে কোনোভাবেই সহ্য করবে না।

যেহেতু এই অভূতপূর্ব আন্দোলন নতুন এক বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে, নিঃসন্দেহে সেই বাংলাদেশ কোনো একক গোষ্ঠীর বাংলাদেশ হয়ে উঠবে না। বাংলাদেশ হয়ে উঠবে ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের ঊর্ধ্বে উঠে গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক-ইনক্লুসিভ এক দেশ। উন্নয়নশীল দেশসমূহের সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক দিক থেকে উন্নত হয়ে ওঠার একটি রোল মডেল।

লেখক: পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

(দৈনিক কালের কণ্ঠের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত)

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।