গত ১৬ বছরে শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় সফলতা ছিল দেশের মানুষকে মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়ে বিকলাঙ্গ করে ফেলা। একটা সময় এমন হয়েছিল, মানুষ এটা বিশ্বাসই করতে পারত না যে শেখ হাসিনারও পতন হতে পারে।
কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, পালানো ছাড়া তার আর কোনো গতি রইল না। জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে শুধু বন্দুকের নলের মাথায় টিকে থাকতে চেয়েছে। তার এই ফ্যাসিবাদী প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রের কাঠামো পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সে ত্রাসের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। আইনের শাসনের অভাব, বাকস্বাধীনতার অভাব, নির্বাচনহীনতার সংস্কৃতি, প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতা, গুম-খুন, প্রতিহিংসার রাজনীতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবে অকল্পনীয় দুর্নীতি, এমনকি দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলোতে অতিরিক্ত প্রতিবেশীপ্রীতি—সব কিছুই ছিল শেখ হাসিনার দীর্ঘ অপশাসনের বৈশিষ্ট্য।
লুটপাটের এক মহোৎসবের আয়োজন ছিল গত ১৬ বছরের এই দীর্ঘ অপশাসন। একটি গণতান্ত্রিক দেশের হৃৎপিণ্ড হলো সেই দেশের নির্বাচনব্যবস্থা। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা ভেঙেচুরে চুরমার করে দিয়ে এ দেশের স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনগুলোকে তামাশার পাত্র বানিয়ে ছেড়েছিল। জনগণের অন্যতম নাগরিক অধিকার, ভোটের অধিকার হরণ করার মধ্য দিয়ে নিজেকে ফেরাউনের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল।
গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সাদৃশ্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো হলো ক্ষমতা হস্তান্তর না করার মানসিকতা, পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি, দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চার অভাব, স্থানীয় পর্যায়ে ফিউডাল রাজনীতির ব্যাপক অনুশীলন। দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দুটি পরিবারকে কেন্দ্র করে। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যেও নির্দিষ্ট দুটি পরিবারের সদস্যদের বাইরে নতুন নেতৃত্ব কল্পনা করার প্রবণতা লক্ষ করা যায় না। বিষয়টি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্রচর্চার প্রক্রিয়া ব্যাহত করে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য একটি লজ্জার বিষয়।
এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যদি কোনো সংসদ সদস্য নিজ দলের বিপক্ষে ভোট প্রদান করে তাহলে তার সংসদ সদস্য পদ চলে যাবে। সাংবিধানিকভাবে দলকানা হয়ে থাকার অদ্ভুত নিদর্শন শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব। শেখ মুজিবের আমলে হওয়া এই আইন কোনো রাজনৈতিক দলই পরিবর্তন করেনি। দলীয় কাউন্সিলে সভাপতির পদ নির্দিষ্ট রেখে বাকি পদগুলো নিয়ে কথা হয়। জাতীয়ভাবে এককেন্দ্রিক স্বেচ্ছাচারমূলক নেতৃত্ব চর্চার সংস্কৃতির শুরুটা এখান থেকেই। কোনো সমালোচনা বা ব্যর্থতার দায় নিয়ে দলের অভ্যন্তরে জবাবদিহির অভ্যাস ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়; জাতীয়ভাবে জবাবদিহি তো অনেক দূরের কথা। একজন ব্যক্তির অপকর্মের দায় পুরো দলকে নিতে হয়। ফলে জন্ম নেয় ফ্যাসিবাদ কিংবা স্বৈরাচার। স্বাধীনতার পরে অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে এই গণতন্ত্রহীনতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি এ দেশে বিদ্যমান।
৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পর একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখার সুযোগ এসেছে। হাসিনা নানা প্রক্রিয়ায় দেশের মানুষকে বিভক্ত করে রাজনীতি করার প্রয়াস চালিয়েছে। কিন্তু জুলাই বিপ্লব বিভক্তি থেকে দেশের মানুষকে গণতন্ত্রের প্রশ্নে এককাতারে আনার অন্যতম উপলক্ষ। সবচেয়ে বড় বিষয়, গোটা প্রজন্মকে রাজনৈতিকভাবে বিকলাঙ্গ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়েছে। যে প্রজন্ম বলত ‘আই হেট পলিটিক্স’, সেই প্রজন্মেরই স্লোগান ছিল, ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। আধুনিক যুগের সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক বিপ্লবটি এ দেশের ছাত্র-জনতা করে দেখিয়েছে। এই আন্দোলনের স্পিরিটকে জাতি গঠনের স্পিরিটে রূপান্তর করতে হবে। কোনো মূল্যেই বিভক্ত হওয়া যাবে না। বিভক্ত হওয়া মানে নরকের দরজার ওপার থেকে পতিত ফ্যাসিবাদের কটাক্ষমাখা তৃপ্তির হাসি।
বাংলাদেশে পরবর্তী সময়ে যে রাজনৈতিক সরকার আসবে তাকে অবশ্যই নিজেদের সংস্কারের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। দেশের জনগণের মনের কথা শোনার অভিপ্রায় নিয়ে আসতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, তারা শুধু এ দেশের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ; কোনো বিদেশি প্রভুর কাছে নয়। দীর্ঘদিনের আশাহীনতা, আক্ষেপ ও চূড়ান্ত অসহিষ্ণুতা মানুষকে জীবনের তোয়াক্কা না করে রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছিল। এই বিষয়গুলোর পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। জুলাইয়ের আন্দোলনে এটা প্রমাণিত, এ দেশের মানুষ মরতে ভয় পায় না। যারা মরতে ভয় পায় না, তাদের কখনো গোলামির জিঞ্জির পরানো যাবে না। সাম্য, ইনসাফ ও মানবিক বাংলাদেশের প্রতিজ্ঞা করেই ক্ষমতায় আসতে হবে। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের মধ্যে প্রশ্ন করার সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্রীয় অধিকার ও দায়িত্বের প্রশ্নে সর্বদা সচেতন থাকতে হবে। দেশটাকে সবাই মিলে গড়তে হবে। এ দেশ কারো একার না; এ দেশ আমার, আপনার সবার।
লেখক: স্নাতকোত্তর, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়