আমাদের অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গায় হাত দিতে হবে। বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।
ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে যে কাজ চলছে সেটা শক্তিশালী করতে হবে। রপ্তানি বাড়াতে সংস্কারের প্রয়োজন। এই খাতের বাজার ও পণ্য বৈচিত্র্যকরণের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
সংস্কার পরিকল্পনা নির্ভর বাজেট চাইসামনে সরকারের আয় ও ব্যয়ের হিসাব বা বাজেট আসছে।
আর এই বাজেট সামনে রেখে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার আছে। সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন নির্ভর করবে বাজেটে নেওয়া পদক্ষেপের ওপর। অনেক বিষয়ে সংস্কার করতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে পদক্ষেপ নিতে হবে। কিছু কিছু পদক্ষেপ হবে মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোতে।
এর মধ্যে বেশ কিছু সংস্কার পদক্ষেপ নিয়ে পরিকল্পনা আসতে হবে। এই পরিকল্পনাগুলো হবে মধ্য মেয়াদের। আমাদের এখন সবচেয়ে বড় যা দরকার হবে তা হলো বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নজর দিতে হবে। আবার সরবরাহব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে, যাতে সরবরাহ চেইনটা আরো শক্তিশালী হয়।
এর মাধ্যমে সরবরাহ ও চাহিদার যে পার্থক্য আছে, সেটা কমিয়ে আনতে হবে। সামনের দিনগুলোতে সময়মতো আমদানি করতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
সামনে রমজান আসছে। এই সময়ে অনেক পণ্যের চাহিদা বাড়বে। এটি বিবেচনা করে রমজানে বাড়তি চাহিদা থাকা পণ্য ও সেবা সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য আগে থেকে পদক্ষেপ নিতে হবে। এর জন্য সরকারের আগাম পরিকল্পনাগুলো থাকতে হবে। দেশের চাহিদানির্ভর পণ্যের আমদানি ও মজুদ ঠিক করতে হবে। আমাদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির মধ্যে আরো সংস্কার দরকার। সংস্কার করে এগুলোর আরো একটু দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। এ জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি পুনর্গঠন করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি থেকে ধীরে ধীরে আমাদের সামাজিক নিরাপত্তায় যাওয়ার পরিকল্পনা নিতে হবে। এই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে টেকসই সামাজিক নিরাপত্তার দিকে নিয়ে যেতে হবে। এ জন্য সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এটা এমন হতে পারে, সর্বজনীন পেনশন স্কিম ও সর্বজনীন ন্যূনতম মজুরি—এমন সব কার্যক্রমের দিকে যেতে হবে। যদিও এগুলো মধ্যমেয়াদি কাজ, তার পরও এসব সংস্কারের দিকে আমাদের যেতে হবে।
সংস্কার পরিকল্পনা নির্ভর বাজেট চাইঅর্থনৈতিক সংস্কারের কথা চিন্তা করলে এখন দুই দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাজেট সামনে রেখে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হবে সেসবের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি সংস্কার কার্যক্রম নিতে হবে। আরো কিছু নিতে হবে মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোতে। তিন বছর মেয়াদি এই বাজেট কাঠামোতে বেশ কিছু সংস্কারের প্রয়োজন হবে। এসব পরিকল্পনা গ্রহণ করেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
এখন বিশেষায়িত মূল্যস্ফীতির চাপ অর্থনীতিতে অব্যাহত আছে। ফলে স্থির আয়ের মানুষের ওপর যে চাপ ক্রমান্বয়ে পুঞ্জীভূত হচ্ছিল, সেটা যায়নি। চাপ থেকে গেছে। এই চাপ কমাতে নজর দিতে হবে। এই চাপ কমাতে বৈদেশিক মুদ্রার মূল্যমানের স্থিতিশীলতা আনার মাধ্যমে করতে হবে। এই মুহূর্তে বেশি করা দরকার সরবরাহ সক্ষমতা বাড়ানো; বিশেষ করে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।
ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের সংস্কারে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। রাজস্ব সংস্কারে কাজ হচ্ছে। এই দুটি সংস্কার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকিং ও রাজস্ব সংস্কারের জন্য কমিশনও গঠন করা হয়েছে। এই সংস্কার কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্পন্ন করতে পারি তত মঙ্গল। ব্যাংকিং খাত বড় চ্যালেঞ্জিং। এটা করতে না পারলে মূলধন ব্যয় ও সুদহার নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে, যেহেতু এর সঙ্গে বিনিয়োগ সম্পৃক্ত। আর বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করবে কর্মসংস্থান। আবার বিনিয়োগের সঙ্গে সরবরাহব্যবস্থা সম্পৃক্ত রয়েছে। ফলে সরবরাহ ও চাহিদা নির্ভর করবে বিনিয়োগের ওপর। সুতরাং বিনিয়োগকে একটি স্বস্তির জায়গায় নিতে হবে। তাহলেই মূল্যস্ফীতি একটি স্বস্তির জায়গায় নিয়ে আসতে পারব।
রাজস্ব সংস্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাজস্ব সংস্কারের মাধ্যমে কিভাবে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ানো যায়, কিংবা সরকারের আয় শক্তিশালী করা যায় তার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এই সংস্কারের মধ্যে আছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পুনর্গঠন। আবার বিভিন্ন কর কাঠামোর মধ্যে পরিবর্তন বা প্রণোদনা কাঠামোর পরিবর্তন—এগুলো সংস্কারের মধ্যে রাখতে হবে।
সরকারের ব্যয় বা বাজেট বাস্তবায়নে সংস্কারের একটি বড় বিষয় আছে। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এই বাজেট বাস্তবায়ন করে। তাই মন্ত্রণালয়গুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও জবাবদিহি দরকার। সার্বিকভাবে জবাবদিহি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার কাজ করতে হবে। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা যাতে বাড়ে এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার। সরকারের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই জবাবদিহির সংস্কৃতি, স্পষ্টতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কাজ করতে হবে। এগুলোই এখন বড় কাজ। প্রশাসনিক বিভিন্ন সংস্কার করলে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়বে বলে আমার মনে হয়। প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখন কমিটি কাজগুলো যত দ্রুত করবে, তাদের পরামর্শ যত দ্রুত পাওয়া যাবে তত ভালো। এগুলো বাস্তবায়নের জন্য যেসব সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া যাবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক। দেশের প্রবৃদ্ধি যেটা হয়েছে, সেখানে বণ্টনের ন্যায্যতা অনেক কম ছিল। যার ফলে আয়বৈষম্য, ভোগবৈষম্য ও সম্পদবৈষম্য বেড়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে। প্রকল্প থেকে টাকা পাচার হয়েছে। মানুষের প্রত্যাশা ছিল, আরো ভালোভাবে ন্যায্যতার মাধ্যমে বণ্টন হবে। এই বণ্টনের ক্ষেত্রে ভালো কিছু আকাঙ্ক্ষা মানুষের আছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের সমপর্যায়ের দেশগুলো, বিশেষ করে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া আমাদের ছাড়িয়ে গেছে। সুতরাং সেই দিকটি আমাদের মনে রাখতে হবে। কিভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উচ্চ স্তরে হবে, ন্যায্যতা নিশ্চিত হবে—এ দুই দিকে আরো বেশি প্রচেষ্টা থাকতে হবে। দেশের আর্থ-সামাজিক সূচকে অবশ্যই উন্নতি হয়েছে, যেখানে ধারাবাহিকভাবে সরকার ও সরকারবর্হিভূত ব্যক্তি খাতসহ অনেকের ভূমিকা আছে। দেশের উন্নয়নে জনগণের বড় ভূমিকা আছে। কিন্তু নীতিমালা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও সুশাসন শক্তিশালী করার মাধ্যমে আমাদের জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধির গতি বাড়ানো এবং বণ্টনের ন্যায্যতা নিশ্চিত করা দরকার। এ দুটিই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
লেখক: সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)
(দৈনিক কালের কণ্ঠের ১৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রকাশিত)
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১২, ২০২৫