কথার পাণ্ডিত্য বা রাজনৈতিক স্বার্থে এখনো সেনাবাহিনী নিয়ে হালকা কথার চর্চা লক্ষণীয়। রাজনীতিতে কারণে-অকারণে কোনো কিছু নিয়ে লঘু-গুরু মন্তব্যকে দূষণীয় মনে করা হয় না।
দেশের এবারের সামগ্রিক অনিবার্য পরিস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেসি সক্ষমতা নিয়ে এখনো মাঠে আছে সেনাবাহিনী। আর আছে বলেই সম্ভাব্য অনেক বিপদ থেকে রক্ষা।
জননিরাপত্তা, অনাকাঙ্ক্ষিত অরাজকতা প্রতিরোধ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের কারসাজি রুখে দেওয়া, মিল-কারখানা সচল রাখা, রাষ্ট্রের কেপিআই এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনাগুলোকে রক্ষা, সড়ক-মহাসড়ক বাধামুক্ত রাখা, অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার, বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতের কাজ সেনাবাহিনী যেভাবে করে যাচ্ছে, তা বিবেকবানরা উপলব্ধি করছেন মর্মে মর্মে। ঘটা করে এসবের কোনো প্রচার নেই।
সেনাবাহিনী প্রচারে অভ্যস্তও নয়। মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার, বিভিন্ন চিহ্নিত অপরাধী ও নাশকতামূলক কাজের ইন্ধনদাতা-পরিকল্পনাকারীদের গ্রেপ্তারের পুলিশি কাজও করে চলছে সেনাবাহিনী। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের লক্ষ্যে নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা উঠে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘসহ বিশ্বসভার সদস্যদের প্রতিক্রিয়ায়ও। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জনগণের ওপর দমন-পীড়নকে রোধ করতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা একটি ইতিবাচক ঘটনা।
জাতির পরম আস্থা ও ভালোবাসার প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠার সঙ্গে দেশ গঠনেও নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকার একটি নতুন দৃশ্যায়ন ঘটল এবার।
এবারের পটপরিবর্তনের পর দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে কী রকমের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি হয়েছে, কত সড়ক-মহাসড়কে অবরোধ হয়েছে, কত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে, সরকারি সংস্থা অথবা অফিসসংক্রান্ত জটিলতা হয়েছে, অনেকেরই এসংক্রান্ত ধারণা নেই। সেনা সদস্যরা সেগুলো ফয়সালা করেছেন। টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানে অপ্রীতিকর ঘটনার সমাধানও করেছেন। বড়দিন, পূজা, মাহফিল, ওরস, রাসমেলা, নবান্ন উৎসবসহ গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আয়োজন শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপনে দায়িত্ব পালন করেছেন।
কাজগুলো সচরাচর পুলিশের। কিন্তু পুলিশবাহিনীর দুর্গতির কারণে সেনাবাহিনীকে চালাতে হয়েছে এসব কর্মধারা।
গণ-আন্দোলনের আগে ও পরে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের পরিস্থিতি কেমন ছিল, তা অনেকেরই অজানা। এ সময়টাতে বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) হাত থেকে স্থানীয় নিরীহ জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় সেনাবাহিনীকে কেবল বিশেষ যৌথ অভিযান নয়, জীবনবাজি রেখে কাজ করতে হয়েছে। এখনো করছে। শত শত কেএনএফ সদস্য ও তাদের সহায়তাকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্বয়ংক্রিয়সহ নানা ধরনের বিপুল অস্ত্র, গোলাবারুদ, সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। এসব কাজ করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য নিহতও হয়েছেন। পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি কক্সবাজার জেলায় এফডিএমএন ক্যাম্প এলাকার নিরাপত্তা বিধানের কাজও করেছেন।
গেল বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে সশস্ত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন ও তদূর্ধ্ব পদবির কর্মকর্তারা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা নিয়ে কাজ করছেন কোনো হাঁকডাক বা শোডাউন ছাড়াই, যার সুবিধা পেয়ে আসছে গোটা দেশ। বাহিনীটির এই অবদান ইতিহাস হয়ে থাকবে। কাজ ও দায়িত্ব বিবেচনায় দেশে দেশে বিভিন্ন বাহিনী ও মহল কিছু বিশেষণ ধারণ করে। তা বাংলাদেশেও আছে। এখানে সাংবাদিকদের বলা হয় জাতির বিবেক। তার মানে এই নয় যে আর কারো বিবেক নেই। সম্বোধনটি আসলে এই পেশার প্রতি বিশেষ সম্মানের বিষয়। এভাবে আইনজীবীদের বলা হয় ‘লার্নেড ল ইয়ার’। শিক্ষকদের ডাকা হয় ‘মানুষ গড়ার কারিগর’ নামে। আলেম-ওলামাদের সম্মান করা হয় হজরত, হুজুর, মোহতারাম ইত্যাদি সম্বোধনে। আর পুলিশের সঙ্গে যোগ করা হয় ‘জনগণের বন্ধু’। এসব সম্মানজনক বিশেষণের মর্যাদা কে কতটা রক্ষা করতে পেরেছেন, তা বলা বা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। সেনাবাহিনী তার ‘দেশপ্রেমিক’ বিশেষণের সম্মান অক্ষরে অক্ষরে রাখতে পেরেছে এবং তা বিশ্বব্যাপী আলোচিত ও প্রশংসিত। একটি রক্তাক্ত পরিস্থিতি কেবল মোকাবেলাই করেনি, সাহসী মধ্যস্থতায় চমৎকার ফয়সালা রচনায় সেনাপ্রধান, তাঁর কলিগ ও বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা ছিল অনেকের কাছে অকল্পনীয়। সেনাবাহিনীর এমন ভূমিকাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ চিহ্নিত করছেন ম্যাজিক নামে। ধর্ম-কর্মে বিশ্বাসীদের কাছে এটি ওপরওয়ালার রহমত। প্রকৃতিবাদীদের কাছে নেচার অব প্রেয়ার। আর জনগণের কাছে সেটিই দেশপ্রেম। সেনাবাহিনীর ৫ আগস্ট ও পূর্বাপর ভূমিকা দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে ইতিহাসের পাতায়।
সেনাবাহিনী সেদিন কেবল রাজনৈতিক ফয়সালায় ভূমিকা রাখেনি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায়ও দেশপ্রেমের স্বাক্ষর রেখেছে। এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও করেছে। দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। গুরুতর আহত কয়েকজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশেও পাঠিয়েছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর এখন সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনেও সেনাবাহিনীর অভিযাত্রার আকাঙ্ক্ষার কথা উঠে এসেছে বাহিনীটির প্রধানের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যে। দেশি-বিদেশি কয়েকটি গণমাধ্যমে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান কথার মধ্যে কোনো মেদ না রেখে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করে সোজাসাপ্টা বলেছেন, সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না। ১৭ কোটি মানুষের দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ প্রশস্ত করতে বিচার বিভাগ, পুলিশ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজনীয় সংস্কারে পাশে থাকার কথাও বলেছেন। এই সময়ে ধৈর্যের প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দিয়েছেন তিনি। অশান্তির পর দেশকে স্থিতিশীল করতে সরকারের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে বলেছেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিশ্চিত একসঙ্গে কাজ করলে ব্যর্থ হওয়ার কোনো কারণ নেই। এ ধরনের আত্মবিশ্বাস ও অঙ্গীকারের পর সামনে একটি সুন্দর-সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে আশাবাদ না জেগে পারে না।
এর বিপরীতটা হলেই বাধে বিপত্তি। দম্ভ, অহংকার, স্বেচ্ছাচার মাত্রাগতভাবে বাড়বাড়ন্ত হলে কী পরিণতি ভুগতে হয় তার দৃষ্টান্ত দেশে-বিদেশে অনেক রয়েছে। কখনো কখনো পরিবার-পরিজনকেও বাকি জীবন কাফফারা গুনতে হয়। সেই আতঙ্কে ৫ আগস্ট বাহিনীর প্রধানসহ পুলিশের মহাপরাক্রমশালী কর্মকর্তাদের হাল অবস্থা গণমাধ্যমের কল্যাণে সাধারণ মানুষেরও জানা। দেয়াল টপকে, লুঙ্গি ড্যান্সে, হেলিকপ্টারে বা রিকশায় সাধারণ মানুষ সেজে পালানোর কিছু ঘটনাও প্রকাশিত হয়েছে। একমাত্র ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে শেখ হাসিনার ভারতে চম্পট দেওয়ার পর পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত আইজিপি কামরুল ইসলাম, মনিরুল ইসলাম, আতিকুল ইসলাম, ডিএমপির কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদসহ বাঘা বাঘা পুলিশ কর্মকর্তার গুরুচরণ দশা এবং প্রাণভয়ে পালানোর কথা গোপন থাকেনি।
বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) এর কিছু আগে থেকেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। সেনাবাহিনী ‘নো ফায়ার’ ঘোষণা দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় আরো অনেক আগেই। পুলিশ-র্যাবের বিশেষ কয়েক কর্মকর্তার হম্বিতম্বি চলতে থাকে তখনো। অথচ ৩ আগস্ট সেনাপ্রধানের সঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈঠকে ‘জনগণের ওপর গুলি নয়’—বার্তাটি গোপন থাকেনি। অতি উৎসাহী দলবাজ, গোঁয়ার গোবিন্দ পুলিশ কর্মকর্তাদের মাঠের অবস্থা জানার বোধও যেন হারিয়ে যায়। বাংলাদেশের গণমাধ্যম সেনাপ্রধানের সঙ্গে তাঁর কর্মকর্তাদের বৈঠক নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেও প্রতিরক্ষাবিষয়ক অনেক বছরের পুরনো চর্চার কারণে ইন্টার সার্ভিস পাবলিক রিলেশনস (আইএসপিআর) থেকে তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত প্রতিবেদন করেনি। পরে সংবাদ করলেও বৈঠকের ফলাফল খুব একটা প্রকাশ করতে পারেনি। তবে দেশের অস্থির পরিস্থিতির মধ্যেই আইএসপিআরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি সেনাবাহিনীর অবস্থান পরিষ্কার করে দিয়েছিল। সেখানে সেনাপ্রধান বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বদা জনগণের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনের পাশে দাঁড়াবে। ’
হাল বা বাতাস বুঝতে আর কী লাগে? কিন্তু বোধ হারিয়ে গেলে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানও থাকে না। সব তথ্য না জানলেও সাধারণ মানুষ সেদিন সেনাবাহিনীকে ‘দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী’ নামেই বরণ করে নেয়। পুলিশ-র্যাব-বিজিবি সেই সুযোগ পায়নি। জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক যেকোনো তদন্তেই তা ঝরঝরে হয়ে আসবে। সেই তদন্তের আগেই পুলিশের ভোগান্তি শুরু হয়েছে। সেনা সহায়তায় জনতার সঙ্গে মিলেমিশে চলার ওয়াদা দিয়ে থানায় থানায় ফিরলেও আতঙ্কে পুলিশ সদস্যরা। এখনো থানায় ওসির লাশ মিলছে। আরেক থানা থেকে পালিয়েছেন গ্রেপ্তারকৃত ওসি। তাঁকে ধরতে রেড অ্যালার্ট জারি হয়েছে। ছাত্র-জনতার রোষের মুখে পুলিশের বেশির ভাগ সুবিধাবাদী ও সরকার বা আওয়ামী ঘেঁষা কর্মকর্তা আত্মগোপনে চলে যান। ডিএমপির সেন্ট্রাল কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার আক্রান্ত হওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জুনিয়র সদস্যদের ফেলে পালিয়ে যান।
ক্ষতবিক্ষত, দুমড়েমুচড়ে যাওয়া পুলিশকে কাজে ফেরানো এখনো কঠিন কাজ। অন্যান্য বাহিনী একটু একটু করে পেশাদার হয়ে উঠছে। তাদের স্বাভাবিক করে তুলতে বাড়তি শ্রম দিতে হচ্ছে সেনাবাহিনীকে। দেশপ্রেম এবং আস্থার ফল এখানেই। সেনাপ্রধানের সময়োপযোগী পদক্ষেপের সমান্তরালে কিছু মন্তব্য তাঁর বাহিনীর সদস্যদের আরো আশাবাদী করে তুলেছে। সেনাবাহিনী রাজনৈতিকভাবে কোনো হস্তক্ষেপ তো করবেই না উল্লেখ করে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমি এমন কিছু করব না, যা আমার সেনাবাহিনীর জন্য ক্ষতিকর হয়। আমি একজন পেশাদার সৈনিক। আমি আমার সেনাবাহিনীকে পেশাদার রাখতে চাই। ’ সরকারের প্রয়োজন অনুযায়ী সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, নতুন স্বপ্নের বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখার কথাও বলেছেন জেনারেল ওয়াকার। একটি নতুন স্বপ্ন, নতুন সময়ের পরিবর্তনের মধ্যে আছেন বলেও বার্তা দিয়েছেন। সারকথা বুঝতে এর চেয়ে বেশি কথা আর লাগে না।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন