ঢাকা, শনিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ কি বিদেশিদের কাছে শিখতে হবে?

অরপি আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১২
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ কি বিদেশিদের কাছে শিখতে হবে?

বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গৌরবের ইতিহাস। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বীর বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতা। লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময় আর লাখো মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের লাল সবুজের পতাকা। সারা বিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে বীর বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন।

স্বাধীন বাংলাদেশের চল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে। এই চল্লিশ বছরে বিশ্ব জেনেছে কীভাবে বাঙালি জাতি তার মায়ের ভাষায় কথা অধিকারের সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে একটি জাতির জন্ম দিয়েছিল। স্বাধীনতার এই চল্লিশ বছরের সারা বিশ্ব বাংলাদেশের কাছ থেকে শিখেছে ভাষার জন্য কীভাবে জীবন দিতে হয়। কিভাবে তাদের অধিকার আদায়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বুকের রক্ত উজাড় করে দিয়ে ১৯৭১ সালে বিশ্বের বুকে উড়িয়ে দিয়েছিল লাল সবুজের পতাকা।

বাঙালির ইতিহাস হাজার বছরের ইতিহাস। এই ইতিহাসের ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাই বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ছিল। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পরপরই এই বাঙালি জাতি তার মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় আমাদের ছাত্র সমাজ। আসে একুশে ফেব্রুয়ারি। মায়ের ভাষায় কথা বলার দাবিতে প্রাণ হারায় রফিক-জব্বার-বরকত সহ আরো অনেকে। শুরু হয় সম্মুখ আন্দোলন। ষাটের দশকে এই আন্দোলনের নেতৃত্বে আসেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ১৯৬৬ সালে পেশ করেন তারঁ ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি। শেখ মুজিবের দেওয়া ছয় দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতির উপর নেমে আসে পশ্চিমা শাষক গোষ্ঠীর নির্মম অত্যাচার। শুরু হয় জেল জুলুম। গড়ে উঠতে শুরু করে বাঙালির আন্দোলন।

সময়ের হাত ধরে আসে ১৯৭০ এর নির্বাচন। নির্বাচনে বাঙালিরা বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করে। কিন্তু বাঙালিকে তার অধিকার দেবে না পশ্চিমা শাষক গোষ্ঠী। তাই শুরু করে ষড়যন্ত্র। আর সেই ষড়যন্ত্রেও হাত ধরে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তান আর্মি অপারেশন সার্চলাইট নামে শুরু করে বাঙালি নিধন অপারেশন। এই রাতে হাজার নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করা হয় রাতের আঁধারে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যখন পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি নিধন যজ্ঞ শুরু হয় ঠিক তার পরপরই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়ারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং তার পরপরই তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হন।

কিন্তু গ্রেফতার হবার পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ইপিআর ওয়ারলেসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলাদেশে। ২৬ মার্চ সারাদিন চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। ২৭ মার্চ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শুরু হওয়া বাঙালির স্বাধীনতার যুদ্ধ পরিণতি লাভ করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এইদিন পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হাতে গোনা কিছু দুষ্কৃতকারী ছাড়া সবাই স্বাধীনতার স্বপক্ষে কাজ করেছে। বিশেষ করে দেশের কৃষক শ্রমিক মজুর গরীব দু:খী মানুষ বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছিল। কিন্তু আজ স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পার হয়ে যাবার পর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। মুক্তিযোদ্ধারা এখনো না খেয়ে কষ্টে আছে। বিনাচিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা একটি চাকুরি পায়না ঠিক ভাবে। অবহলো অনাদরে হারিয়ে যাচ্ছে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা।

অথচ যে মুষ্টিমেয় কিছু দুষ্কৃতকারী স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল তারা স্বাধীন বাংলাদেশে সকল সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে, মন্ত্রী হয়েছে, মিডিয়া দখল করেছে। স্বাধীনতার চল্লিশ বছরেও মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হলেও অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে চিহ্নিত রাজাকারদের। স্বাধীন বাংলাদেশে এই চল্লিশ বছর পরেও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি। প্রণীত হয়নি মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা। মুক্তিযুদ্ধ করেনি এমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা অর্থের বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশের আনাচে কানাচে।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে গঠন করা হয়েছে একটি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণঅলয়। গঠিত হবার পর থেকে এই মন্ত্রণালয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ এবং মুক্তিযোদ্ধারে কল্যাণে কি কি করেছে তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। এই মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটেও বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কিত বিস্তারিত কোনো তথ্য বা দলিল পাওয়া যায় না। এই মন্ত্রণালয়ের কাজ কি? এই পর্যন্ত এই মন্ত্রণালয় কি কি কাজ সম্পন্ন করেছে? ১৯৭১ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের কতটি স্থান এখন পর্যন্ত এই মন্ত্রণালয় সংরক্ষণ করেতে পেরেছে? তার কোনো তথ্য কোনো জায়গায় পাওয়া যায় না।

সরকারি অর্থে পরিচালিত এই মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছে এবং এই কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়াবে। কিভাবে বিদেশিরা তাদের ইতিহাস সংগ্রহ করছে তা দেখবে এবং শিখবে। দেশের লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে ফিরে দেখার পর মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণায়ের কর্মকর্তাবৃন্দ তাদের বিদেশ থেকে আহরণ করা জ্ঞান দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণের চেষ্টা চালাবে!

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জাতিসংঘসহ সারা বিশ্বজুড়ে আজ স্বীকৃত। সারা বিশ্বের মানুষ আজ বাংলাদেশে যাচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাস জানার জন্য। কীভাবে বাঙালিরা ভাষার জন্য ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাণ দিয়েছিল। কীভাবে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য তাদের জীবন দিয়েছিল। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বিদেশ ঘুরবেন আর ইতিহাস সংরক্ষণ শিখবেন, ভাবতেই হাস্যকর মনে হয়। সরকারি অর্থে লুটপাট, আরাম আয়েশ বাংলাদেশে যদিও নুতন কোনো বিষয় নয়। তবুও একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের এই বিষয়টি নিতান্তই হাস্যকার এবং মন্ত্রনালয়ের কমকর্তাদের সরকারি অর্থে বিদেশ ঘুরবার একটি বাহানা (অজুহাত) বলেই মনে হয়। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য বিদেশিদের কাছে শিক্ষার কিছু নেই। বরং বিদেশিরাই আমাদের কাছে শিক্ষার অনেক কিছু আছে - এই বোধটি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণায়লয়ের কর্মকর্তাদের থাকা উচিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধারে নাম করে সরকারি অর্থে বিদেশ মনোরঞ্জন করে সরকারি অর্থ ব্যয় না করে বিদেশ ভ্রমণের জন্য নির্ধারিত অর্থ কিছু গরীব মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে বিতরণ করলে তারা আন্তত কিছুদিন ভালো থাকতে পারবেন বলেই আমি মনে করি।

অরপি আহমেদ, লেখক সাংবাদিক।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১২
আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।