ঢাকা, সোমবার, ২৭ মাঘ ১৪৩১, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০ শাবান ১৪৪৬

মুক্তমত

গল্প নয়: সত্য ঘটনা

মাহমুদ হাসান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৫
গল্প নয়: সত্য ঘটনা

হাতের কাজ শেষ করে অলস আড্ডায় অফিসে। সহকর্মীদের অ্যাসাইন্টমেন্ট দেওয়া ও নেওয়ার পর্বও শেষ।

সন্ধ্যা পার হয়েছে ঘণ্টাখানেক। একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন। মাহমুদ হাসান সাহেব বলছেন। সালাম বিনিময়ের পর বললেন, আমি মেজর.... বলছি। আরও বললেন, আগামীকাল সকাল ৮টায় আমাদের স্যার আপনার সাথে কফি খেতে চেয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম কে আপনার স্যার? কোথায় দেখা হবে?  উত্তর শুনে ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। গলায় যেন কিছু একটা আটকে গেল। শরীরটা ঘেমে উঠল। কয়েক মূহূর্ত পর অপর প্রান্ত থেকে হ্যালো- হ্যালো শব্দ আসতে লাগল। নিজেকে সামলে নিয়ে খুব নিচু স্বরে সম্মতি জানিয়ে বললাম আমি তো আপনার স্যারকে চিনি না। উত্তরে কিছুটা কর্কশ গলায় বললেন, ‘আপনার চিনতে হবে না। সময়মতো অফিসে আসলেই আমরা আপনাকে চিনে নিব, ধন্যবাদ’ বলে ফোনটি রেখে দিল।

প্রচণ্ড অস্থির সময়। তৎকালীন প্রধান দুই নেত্রীসহ প্রায় সব রাজনীতিবিদ কারারুদ্ধ। এক উদ্ভট শাসন ব্যবস্থায় চলছে প্রিয় দেশ। শুনেছি ওখানে গেলে নাকি নানা অত্যাচার-নির্যাতন করা হয়। কেউ কেউ হারিয়েও যায়। কি করব, কার কাছ থেকে পরামর্শ নেব অথবা কাউকে জানাবো না কিংবা কফি খেতেও যাব না।

এমন কত চিন্তা এক ঝটকায় মাথায় খেলে গেল। পরিবারের কথা মনে হতে লাগল। বড় ধরনের কোনো বিপদে পড়তে যাচ্ছি কি? কি হবে পরিবারের সদস্যদের? আর ভাবতে পারছিলাম না। একজন সিনিয়র বন্ধু-সুহৃদ যিনি সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাকে ফোন করলাম। যদিও তিনি তখন ঢাকার বাইরে দায়িত্ব পালন করছিলেন। বিষয়টি জানালাম। সব শুনে আমার কাছে জানতে চাইলেন কি করেছি? কার সাথে সমস্যা হয়েছে? আমি বললাম, কারও সাথেই কিছু হয়নি। কথা না বাড়িয়ে পরে কথা বলবেন বলে ফোন রেখে দিলেন। অপেক্ষা করতে লাগলাম উনার ফিরতি ফোন কলের। ওই এক ঘণ্টা কীভাবে যে কেটেছে তা মনে করে আজও বিহ্বল হয়ে পড়ি। ঘণ্টাখানেক পর তিনি বললেন , ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবেন। আমি কথা বলেছি। বিষয়টি কাউকে জানাতে সাহস পাচ্ছিলাম না। অনেক ভেবে-চিন্তে একজন সহকর্মী, আমার সে সময়ের বিভাগীয় প্রধান ও আমার সাবেক কর্মস্থল আমার দেশের তৎকালীন চিফ রিপোর্টার সৈয়দ আবদাল আহমেদকে ঘটনাটি জানিয়ে রাখি। বাসায় ফেরার আগে আমার সাবেক কর্মস্থল আমার দেশে আবদাল ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যাই। তিনি অভয় দিয়ে বললেন, কোনো কিছু অস্বীকার করবেন না। যা জানতে চায় সব বলবেন। এ কথা শুনে আরও ভীত হয়ে পড়লাম। যতদূর মনে পড়ে বাসায় এসে কাউকেই কিছু জানাইনি। এখনো পরিষ্কার মনে আছে ওই রাতে একটুও ঘুমাতে পারিনি। বিছানায় যাওয়ার আগে স্ত্রীকে শুধু বলে রাখলাম আগামীকাল খুব সকালে বের হবো।

পরদিন সকালে একটি সিএনজি স্কুটার নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বনানী গেট হয়ে সোজা কচুক্ষেত চলে আসলাম। কাঁচঘেরা আলোচিত সুরম্য ভবনটির সামনে যখন নামলাম তখন পৌনে ৮টা।   এই ভবন নিয়ে তখন নানা আলোচনা-সমালোচনা। অনেককেই নাকি আসতে হয়, কাউকে কাউকে ডেকে আনা হয়। কি করা হয় তা আর কেউই প্রকাশ করেন না। এই দপ্তর নিয়ে একটা ভীতি জনমনে কাজ করত। ধীরে ধীরে গেটে গেলাম। চারিদিকে ভীষণ নীরবতা। নিরাপত্তা কক্ষে ২/৩ জন ছাড়া কাউকে দেখতে পেলাম না। সালাম দিয়ে একজন জানতে চাইলো কার কাছে এসেছি? নাম বললাম। উর্দি পরা একজন বলল, জ্বি স্যার। ৮টায় আসার কথা আপনার। সামনে বাড়িয়ে দেওয়া খাতায় নাম ঠিকানা ও বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করতে বললেন। গেটে মোবাইল ফোন, কলম, প্যাড রেখে দিয়ে ভিতরে যাওয়ার রাস্তা দেখিয়ে দিল। সুবিশাল করিডোরে ঢুকতেই আবারো জিজ্ঞাসাবাদ ও দেহ তল্লাশি। এবার ঘড়ি, কোমরের বেল্ট ও জুতো খুলে দেখাতে হলো যে আমি অন্যকিছু বহন করছে কিনা। এখান থেকেই লিফটে এগিয়ে দিতে এসে লিফটের সুইচ টিপে দিয়ে গেল লোকটি। বলল, ওপরে আপনাকে রিসিভ করবে।

নির্দিষ্ট তলায় গিয়ে লিফটের দরজা খোলা মাত্র একজন স্মার্ট লোক আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে একটি ‍রুমে বসতে বললেন। এক নজরে রুমের ভেতরটা দেখে নিলাম। বিশাল একটি রুম। জীর্ণশীর্ণ পুরনো দুই সেট সোফা, একটি মাঝারি আকারের টি-টেবিল, তার ওপরে রাখা দুই/তিন বছর পুরনো কিছু বিদেশি ম্যাগাজিন। স্বাভাবিকের চাইতে প্রায় দ্বিগুণ উচ্চতার ‍রুমের সিলিংয়ের কাছেই কয়েকটি জানালা। সিলিংয়ে ঝুলছে একটি পুরনো ফ্যান। অপেক্ষা করতে বলে চলে গেলেন স্মার্ট লোকটি। তাই এবার অপেক্ষার পালা। পৌনে দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর একজন এসে বললেন, আসুন স্যার। রুম থেকে বের হয়েই দেখলাম ঠিক উল্টো দিকেই আরেকটি দরজায় মাঝারি আকৃতির একজন মানুষ দাঁড়ানো। শ্যামবর্ণের লোকটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আই অ্যাম ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারী, নাইস টু মিট ইউ মি. মাহমুদ। ’

আমার হাতটা খুব শক্ত করে ঝাঁকালেন বেশ কিছু সময়। চাপও দিলেন বুঝতে পারলাম। হাতে একটি ফাইল, তার ওপর আমার নাম। বুঝাতে চাইলেন হয়ত যে আমার নামে একটি ফাইলও আছে এখানে। ২০০৭ সালে ১/১১ সরকারের আমলে যে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার নাম জনমনে শোনা যেত তাদের মধ্যে এই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ টি এম বারী অন্যতম। আলোচিত-সমালোচিত ছাড়াও তিনি ছিলেন আচার-আচরণে এক ভয়ঙ্কর মানুষ। আজ সামনাসামনি তার দেখা পেলাম। সাদা শার্টের ওপর কালো স্যুট ও লাল টাই পরিহিত ব্রিগেডিয়ার সাহেব আমাকে একটি রিভলভিং চেয়ারে বসতে বলে নিজেও আরও একটি চেয়ার টেনে বসলেন। বুঝতে পারছিলাম এবার তিনি তার আসল রূপে আবর্তিত হবেন। আমার ধারণাই ঠিক হলো। পা দিয়ে চালিয়ে তার চেয়ারটি ঠিক আমার মুখোমুখি নিয়ে আসলেন। এখন আমাদের দুজনের মাঝে দূরত্ব মাত্র দেড় থেকে দুই ফিট। দেখলাম আমার চেয়ারের পেছনে আরও একজন একজন তরুণ দাঁড়ানো। আমার হৃদকম্পন বাড়তে লাগল। অনেক চেষ্টায় নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করলাম। শুরু করলেন প্রশ্নের পর প্রশ্ন। আমার সাংবাদিকতার শুরু থেকে নানা তথ্য ছাড়াও আমার রাজনৈতিক আদর্শ সম্পর্কেও অনেক কিছু বলতে লাগলেন। ওই উদ্ভব সময়ে আমি ও আমার নানা কাজ নিয়ে নানা তথ্যই তার কাছে আছে বলে জানালেন। কয়েকটির প্রসঙ্গে কথাও বললেন। এর মাঝে থেমে নেই প্রশ্ন করা।

প্রশ্ন করতে থাকলেন, ক্যান্টনমেন্টের বাসায় ’গৃহবন্দী’ অবস্থায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে কেন ফোনে কথা বলেছি, কি কথা হয়েছে তার সঙ্গে, সাবেক সংসদ সদস্য মোসাদ্দেক আলী ফালুর সাথে কত দিনের পরিচয়, উনার সম্পর্কে কি জানি, সাবেক মন্ত্রী মির্জা আব্বাসের রাজনৈতিক কার্যালয় ও শাহজাহানপুরের তার বাসায় কেন যাতায়াত করি। সেনা সমর্থিত সরকার আসার পরও আমি মির্জা আব্বাসের অফিসে কতবার গিয়েছি সে প্রমাণও তার কাছে- এমন কথাও জোর দিয়ে বললেন। ফাইলটি দেখে এমন আরও কিছু বিষয়ে জানতে চাইলেন। এছাড়া, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মীর শওকত আলী, সাংবাদিক রিয়াজউদ্দিন আহমদ, সাংবাদিক নেতা শওকত মাহমুদ ও এলাহী নেওয়াজ খান সাজুকে টক শো’য় আমন্ত্রণ জানানোর পেছনে আমিই কলকাঠি নেড়েছি বলে ব্রিগেডিয়ার সাহেবের কাছে তথ্য আছে বলে জানালেন।

বলে রাখা উচিত টকশো’য় এসে উনারা সবাই তৎকালীন সরকারের সমালোচনা করেন। আবদাল ভাইয়ের কথা মনে রেখে যা সত্য সবই স্বীকার করে নিলাম। এক পর্যায়ে জানতে চাইলেন পরিবারে কে কে আছেন? এবার সত্যিই আমি অনেকটা ভেঙে পড়লাম। সারা হাত-পা ও শরীর কাঁপছিল।

হঠাৎ কৈফিয়তের সুরে জানতে চাইলেন, নির্বাচন কমিশন থেকে বিএনপির মহাসচিব মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিনকে সংলাপের চিঠি দেওয়ার বিরুদ্ধে কেন রিপোর্ট করেছেন। আমি উত্তরে বললাম, এই রিপোর্ট তো আরও একটি টিভি চ্যানেল করেছে এবং বিএনপি চেয়ারপারসন তো খন্দকার দেলোয়ার হোসেনকেই মহাসচিব বানিয়েছেন। উত্তরে বললেন, কে কাকে কি বানিয়েছে তা তো দরকার নেই। আপনি কেন এই নিউজ করেছেন? জানেন না এটা আমরা চেয়েছি?’ আমি আর কোনো কথা বললাম না। এর মাঝে চা-বিস্কুট এলো। চায়ের কাপটি আমার হাতে উঠিয়ে দিয়ে বললেন, খুব ভালো লাগলো আপনার সাথে কথা বলে। ভালো করে কাজ করেন। কয়েক মিনিট পর অকস্মাৎ উঠে দাঁড়ালেন ব্রিগেডিয়ার সাহেব। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আই থিং ইউ আর ভেরি মাচ প্রফেশনাল, উইশ ইউ গুড লাক ইয়ং ম্যান ‘ এ কথা বলে দরজা খুলে দিলেন নিজ হাতেই। বুঝতে পারলাম আমার উঠতে হবে। চায়ের কাপে তখন মাত্র ২/১টা চুমুক দিয়েছি। রুম থেকে বের হওয়ার সময় বললেন, ‘আপনার প্রতিষ্ঠানে আমাদের একজন রিটায়ার্ড ব্রিগেডিয়ার সাহেব আছেন উনার সাথে যোগাযোগ রাখবেন। ’

তবে অ্যাংরি ব্রিগেডিয়ার এ টিএম বারীর ‘গুড লাক উইস’ বেশি দিনে স্থায়ী হয়নি আমার জন্য। ঠিক আটদিন পর সন্ধ্যায় নিউজ রুমে কাজ করা অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন সিইও ব্রিগেডিয়ার তার রুমে ডেকে নিয়ে সরাসরি চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বললেন। হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। এর আগে কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি। জানতে চাইলাম কি অপরাধ আমার? কেন, পদত্যাগ করতে হবে? সামরিক কায়দায় কর্কশ কণ্ঠে বললেন, ‘সব কিছু বলা সম্ভব নয়। নিশ্চয় বুঝতে পারছেন দেশের পরিস্থিতি। আপনি এখনই অফিস ত্যাগ করবেন। ’ পরিস্থিতি সামলে নিতে কিছুটা সময় বসে থাকলাম ওই রুমে। বললাম, একটু নিউজ রুমে যাই, লকারে রাখা আমার ব্যক্তিগত জিনিস-পত্র ও পদত্যাগপত্র টাইপ করে নিয়ে আসি। শান্ত মেজাজে বললেন, ‘আমার পিসিতে টাইপ করা আছে, প্রিন্ট দিচ্ছি স্বাক্ষর করে দেন। ’

এরপর একজন অফিস এক্সিকিউটিভকে ডেকে বললেন, ‘মাহমুদ সাহেবকে লিফটে এগিয়ে দাও। ’ একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে লিফটে উঠলাম...

বেশ কয়েকদিন পরই পুরো বিষয়টি জানা যায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনকে লক্ষ্য করেই ১/১১ সরকার ওই প্রতিষ্ঠানে একজন সাংবাদিককে বার্তা বিভাগের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। সশস্ত্র বাহিনী সদস্য পরিবারের সন্তান হিসেবে আগে থেকেই তার সঙ্গে ডিজিডিএফআই ও সেনাবাহিনীর সম্পর্ক ছিল। তার নীল নক্সার বলি হয়েছিলাম আমিসহ আরও বেশ কয়েকজন পেশাদার সাংবাদিক। ওই বিতর্কিত লোকটি ফ্যাসিস্ট সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে ইউরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশে হাইকমিশন অফিসে প্রেস মিনিস্টারের দায়িত্ব পালন করেছিল। এতসব ঘটনা শুনে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (একাংশ) ডিইউজের সাবেক সভাপতি মরহুম শাহজাহান মিয়া একদিন বলেছিলেন, ‘খুব যত্ন করে ছেলেটাকে কাজ শিখেছিলাম, কিন্তু সে যে এত খারাপ হবে সে তা বুঝতে পারিনি। মনে হয় আমার শিক্ষা দান কোনো কাজে আসেনি। ’

মাহমুদ হাসান: লেখক ও সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৫
এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।