বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূসের থ্রি জিরো তত্ত্ব নিয়ে পৃথিবীজুড়ে তোলপাড়। সুন্দর, সমৃদ্ধ ও শান্তিময় ধরণির মূলমন্ত্র রয়েছে এ তত্ত্বে।
পঁচাশি বছরের এ তরুণ এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারুণ্য অর্জিত অন্তর্বর্তী সরকারের। পতিত ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠী ছাড়া দেশবাসী এ সরকারের সফলতা কামনা করে। বারবার হোঁচট খাওয়া জাতি একটি স্থায়ী সংস্কার কাঠামোর মধ্যে আগামীর পথ রচনা করতে চায়। দেশবাসীর এ প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আরেকটি ‘থ্রি জিরো’ তত্ত্ব বাস্তবায়ন করতে হবে। এ তত্ত্বটি হলো ‘জিরো অদক্ষতা (Zero Inefficiency), জিরো অদূরদর্শিতা (Zero Imprudence) ও জিরো অসততা (Zero Dishonesty)। এ সরকারের সফলতার জন্য এ থ্রি জিরো কার্যকরের বিকল্প নেই। কোনো কারণে এ তিনটির একটিতে ঘাটতি থাকলে ব্যর্থ হবে এ সরকার। হতাশ হবেন বিপ্লবীরা। জুলাই বিপ্লবে শহীদদের আত্মা কষ্ট পাবে। আকাশছোঁয়া ইমেজ ক্ষুণ্ন হবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের।
অন্তর্বর্তী সরকারে রয়েছেন ২২ জন মন্ত্রী পদমর্যাদার উপদেষ্টা, উপদেষ্টা পদমর্যাদার তিনজন বিশেষ সহকারী এবং প্রতিমন্ত্রী মর্যাদার তিনজন বিশেষ সহকারী। প্রাজ্ঞ ড. মুহাম্মদ ইউনূস আস্থা রেখে সহযোগী হিসেবে তাদের রণসঙ্গী করেছেন। এখন সরকারের সাত মাস চলছে। এ সময়ের মধ্যে অনেক কিছু তারা করতে পারবেন, এমন প্রত্যাশা সচেতন কেউই করছেন না। তবে যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেটি পালনে তিনি দক্ষ কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। দক্ষতার মাপকাঠিও আপেক্ষিক। একেক জনের কাছে দক্ষতার মাত্রা একেক রকম। কিন্তু সর্বজনীন হলো, যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিনি সে কাজটি আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করছেন কি না। এ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর রাজপথ, সচিবালয়সহ সবখানে শুধু দাবি আর দাবি। এসব দাবি ও প্রতিবাদ অনেক ক্ষেত্রেই আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। শিশু সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে একের পর এক দাবিতে উত্তাল ছিল ঢাকা শহর। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এসব দাবির বিষয় সুরাহা করা যেত। শুরুতে এসব দাবির মিছিল বন্ধ করতে পারলে সরকারের ওপর এখন এসব দাবির চাপ থাকত না। প্রধান উপদেষ্টা যাঁকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, সে দায়িত্ব তিনি যদি আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন, তাহলে এ সরকার সফল হবে। ইমেজ বাড়বে নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। তাঁর মর্যাদার মুকুটে আরও একটি উজ্জ্বল পালক যুক্ত হবে।
সরকারের জন্য আরেকটি ‘থ্রি জিরো’ তত্ত্বসংসার, প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্র-সবকিছু পরিচালনার জন্য দূরদর্শিতা দরকার। আজ যে কাজটি করা হচ্ছে, আগামীকাল সমাজ বা রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সে কাজটির কী প্রভাব পড়বে, এটা আগাম অনুধাবন করতে পারাই দূরদর্শিতা। এ সরকার যেসব দূরদর্শী কাজ করছে এর মধ্যে অন্যতম হলো সংস্কার। ইতোমধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশন সরকারের কাছে রিপোর্ট জমা দিয়েছে। এসব রিপোর্টের সুপারিশ যদি সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়ন হয়, তাহলে উপকৃত হবে বাংলাদেশ। কিন্তু যে ছাত্ররা জুলাই বিপ্লবে গুলির সামনে বুক পেতে দিল, তাদের জন্য এবং আগামী প্রজন্মের কর্মমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করতে গঠন করা যেতে পারত একটি শিক্ষা কমিশন। এ সরকারের পক্ষে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা যতটা সহজ ছিল, কোনো রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে ততটা সম্ভব হবে না। কারণ শিক্ষা এখন অধিকার নয়, একটা লাভজনক ব্যবসায় রূপান্তরিত হয়েছে। অথচ আমরা কত বিজ্ঞের মতো কথায় কথায় বলি, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপর যে মুহূর্তে দেশের অর্থনীতি, নিত্যপণ্য নিয়ে সাধারণ মানুষের জীবন কষ্টকর অবস্থার মুখে, ঠিক সে সময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট আরোপ করা হলো। আবার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো, ভ্যাট আরোপের প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর পড়বে না। এমন অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও বক্তব্য দেশবাসীকে হতাশ করেছে। সরকার গঠনের পরপরই জন আকাঙ্ক্ষা ছিল, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে যারা চিহ্নিত সন্ত্রাসী, গডফাদার এবং ১৬ বছর দেশবাসীকে যন্ত্রণা দিয়েছেন তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা। যেসব সরকারি কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের দাস হিসেবে প্রকাশ্যে ভূমিকা পালন করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুট হয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠান দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করা ও লুটেরাদের বিচার করা। থানা থেকে যেসব অস্ত্র লুট হয়েছে, সেগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে উদ্ধার করা। বিনিয়োগে সামর্থ্য আছে, এমন ব্যবসায়ীর সঙ্গে বৈঠক করে নতুন অর্থনৈতিক ও কর্মসংস্থানের একটি রোডম্যাপ করা। বিপ্লবীদের একটি নির্ভুল তালিকা তৈরি করা। ছয় মাস হয়ে গেল, এখনো বিপ্লবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হলো না। মনে রাখতে হবে, একাত্তরে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়েছে অথচ ২০২৪ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় ভুয়া নাম যোগ হয়েছে। এখন যদি প্রকৃত বিপ্লবী ও শহীদের নামের তালিকা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে বহু ভুয়া বিপ্লবীর দাবিদার আবির্ভূত হতে পারে। মব জাস্টিস এখন সমাজ ও সরকারের জন্য এক আতঙ্কের নাম। শুরুতেই এটি শক্ত হাতে দমন করা গেলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। দেরি করে হলেও উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ১০ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, যারা মব করবেন, তাদেরও ডেভিল হিসেবে গণ্য করা হবে। আরও অনেক কাজই দূরদর্শিতার সঙ্গে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা যেত, কিন্তু তা করা হয়নি। করা হয়নি বলেই এখনো দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে হোঁচট খাচ্ছে। ভয়ে, নানা শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। সরকারের ওপর আস্থা রেখে নতুন বিনিয়োগে সাহস পাচ্ছেন না। যথাসময়ে কাজগুলো করা হয়নি বলেই গাজীপুরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জুলাই বিপ্লবের সাহসী সন্তানদের ওপর হামলা চালানোর সাহস পেয়েছে। গাজীপুরে যদি এর চেয়ে ভয়ংকর কিছু ঘটে যেত, তাহলে বিক্ষুব্ধ মিছিল হয়তো যমুনা অভিমুখী হতো। অনুধাবন করা উচিত ছিল, পিতা-মাতাসহ পরিবারের সদস্যদের নিহত হওয়ার প্রতিশোধ শেখ হাসিনা যতটা নিষ্ঠুরভাবে নিয়েছেন, তাকে দেশছাড়া করার প্রতিশোধ তিনি ও তার দোসররা আরও অনেক বেশি নিষ্ঠুরভাবে নেওয়ার অপচেষ্টা চালাবেন। আর সেটা করার জন্য তার দলের নেতা-কর্মীদের লেলিয়ে দেবেন। মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতা-কর্মীদের কাছে টাকা আছে। টাকার অনেক শক্তি। আরেকটি বিষয় খুবই বিপজ্জনক। আওয়ামী লীগ ও তার ভ্রাতৃপ্রতিম সহযোগী সংগঠনের অনেক কর্মী ওপরের নির্দেশে খোলস পাল্টে এখন বিপ্লবী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। সরকারের ভিতরে থেকেও তারা খোলস পাল্টে দিব্যি ভালোই আছে। এরা প্রয়োজনে আবারও স্বরূপে ফিরতে পারে। এদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার।
শুধু আর্থিকভাবে অসৎ হলেই অসততা বলা যায় না। সততার সংজ্ঞা ও পরিধি অনেক বিস্তৃত। জুলাই বিপ্লবীদের আমানত রক্ষার দায়িত্ব যাদের দেওয়া হয়েছে, তারা যদি কোনো কারণে সততার পিচ্ছিল সিঁড়ি থেকে একটু সরে যান, তাহলে পৃথিবীর কাছে ছোট হয়ে যাবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কেউ যদি মনে করেন, কাকের মতো নিজের চোখ বন্ধ রেখে কোনো অসৎ কাজে নিজেকে জড়ালে কেউ তা জানবে না, তাহলে ভুল হবে। পতিত সরকারের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি ছিলেন শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যরা। তারা স্বপ্নেও ভাবেননি, এ দেশ ছেড়ে তাদের চলে যেতে হবে। তাদের ভয়াবহ দুর্নীতি বিশ্ববাসী জানতে পারবে। অবশ্য অসৎ কর্ম ধরার জন্য এখন আর খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোনের মতো ইলেকট্র্রনিক ডিভাইস এখন সাক্ষ্য দেয়। কে কী করছেন, তা নিজের অজান্তেই যত্ন করে রেখে দিচ্ছেন নিজের ব্যবহৃত বিভিন্ন ডিভাইসে। আরেকটি অপ্রিয় সত্য হলো, কেউ যদি ব্যক্তিজীবনে অসৎ হন, তাহলে তার কাছ থেকে শতভাগ সততা প্রত্যাশার সুযোগ নেই। কারও ব্যক্তিগত অসততা অন্তর্বর্র্তী সরকারকে স্পর্শ করলে ম্লান হবে ড. ইউনূসের মর্যাদা, যা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়।
সততা প্রমাণের জন্য এ সরকারের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হলো আগামী নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন স্বীকৃত সব রাজনৈতিক দলকে আস্থায় নিয়ে সবার অংশগ্রহণে জাতিকে একটি ঐতিহাসিক নির্বাচন উপহার দেওয়া হবে সরকারের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। এ পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে। সরকার ও রাজনৈতিক দল দুই পক্ষের মধ্যেই ব্যাপক প্রস্তুতি। এ পরীক্ষার নিয়ন্ত্রক, ইনভিজিলেটর বা পরীক্ষা নিরীক্ষক পুরোটার দায়িত্বই সরকারের। এটি পক্ষপাতমুক্ত করার দায়িত্বও সরকারের, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সবার। সততার সঙ্গে যদি এ পরীক্ষাটি পরিচালিত না হয়, সরকারের ভিতরের কোনো মহলের নিজস্ব এজেন্ডায় যদি এটা কলুষিত হয়, তাহলে জাতি হতাশ হবে। আর গোটা বিশ্ব আমাদের প্রিয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দিকে আঙুল তুলবে, যা আমরা চাই না। সে কারণেই ‘জিরো অদক্ষতা (Zero Inefficiency), জিরো অদূরদর্শিতা (Zero Imprudence) ও জিরো অসততা (Zero Dishonesty)’ তত্ত্ব বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন
বাংলাদেশ সময়: ১০১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৫