প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফর প্রথম কোনো দেশে দ্বিপক্ষীয় সফর। এই সফর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
নানা দিক থেকে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ইউনূসের এ সফর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এ সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। একইসঙ্গে তিনি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছেন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার কর্মসূচিরও প্রশংসা করেছেন।
এ সফরের মধ্য দিয়ে বিনিয়োগ, স্বাস্থ্য, রোহিঙ্গা সংকট ও পানি ব্যবস্থাপনায় চীনের সাথে সম্ভাবনার আলোচনায় আগামীর বাংলাদেশ আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গেল। কূটনৈতিক লেন্সে তাকালে যার সূদুরপ্রসারী সুফল দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে পানি ব্যবস্থাপনায় ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান বাংলাদেশের উৎপাদন ও অর্থনীতির গতিশীলতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
পানি ব্যবস্থাপনায় ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান ও তিস্তা
বাংলাদেশের নদী ও পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে চীনের কাছে ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান আহ্বান করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চীনের পানিসম্পদমন্ত্রী লি গোইয়িংয়ের সঙ্গে বেইজিংয়ের একটি রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায় সাক্ষাতের সময় তিনি এ আহ্বান জানান।
প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং চীনের জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করেছেন, যা দেশটি পানি ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যবহার করছে। তাই প্রধান উপদেষ্টা চীনের পানি ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতাকে বাংলাদেশের সাথে ভাগাভাগি করার আহ্বান জানান। চীনের পানি ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক অভিজ্ঞতা রয়েছে, যা তাদের জটিল পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় আশ্চর্যজনক সাফল্য দেখিয়েছে।
আমাদেরও একই সমস্যা রয়েছে তাই চীন যদি বাংলাদেশের পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনায় তথ্য ও প্রযুক্তিগত সহায়তা করে তবে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে দারুণ ভূমিকা রাখবে। চীনা পানিসম্পদমন্ত্রী লি গোইয়িংয়ে ও বাংলাদেশকে প্রযুক্তিগত সহায়তা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের সমস্যা যে শুধু একটি নদীকে ঘিরে নয়, বরং পুরো নদী ব্যবস্থার সঙ্গেই সম্পর্কিত বিশেষ করে উজান থেকে নেমে আসা পলির স্তর, নদীর মাঝে জেগে উঠা বালু চর, তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা এবং ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দূষিত পানি পরিষ্কার করা অপরিহার্য, তা প্রধান উপদেষ্টা চীনের কাছে তুলে ধরেন। যার ভিত্তিতে তিনি চীনের কাছে পানি ব্যবস্থাপনায় ৫০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান প্রত্যাশা করেছেন।
বাংলাদেশে পানি ব্যবস্থাপনার বর্তমান চিত্র
১৯৪৯ সালে ক্রুগ কমিশনের সুপারিশক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে (আইইসিও) বাংলাদেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এর ভিত্তিতে আইইসিও ১৯৬৪ সালে দুই খণ্ডের মাস্টারপ্ল্যান প্রস্তুত করে।
এই মহাপরিকল্পনার সময়-প্রেক্ষিত ছিল ২০ বছর। কিন্তু মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে নদী ব্যবস্থাপনার যে ধারা বাংলাদেশে সূচিত হয়েছিল, প্রায় ৬০ বছর ধরে বাংলাদেশে মোটাদাগে সেই ধারাই অব্যাহত রয়েছে।
আইইসিওর মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, সেচ ব্যবস্থার কিছু উন্নতি ও খাদ্য উৎপাদনে সামান্য বৃদ্ধি হয়েছিল, তবে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন ও দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত না হওয়ার কারণে পুরো দেশে এর সুফল একমুঠে পাওয়া যায়নি। তিস্তাসহ নানা ইস্যুতে বিগত সরকার তাদের ব্যর্থতা ঢাকতে নানা বিষয় সামনে আনলেও বাংলাদেশে পানি ব্যবস্থাপনার সঠিক ও কার্যকর একটি রূপ রেখা দিতে তারা ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারে না।
শি জিনপিংয়ের পানি ব্যবস্থাপনার মাস্টার প্ল্যান
‘পানি ব্যবস্থাপনার নতুন যুগ’ চীনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি উদ্যোগ যা ২০১৫ সালে চালু হয়েছিল। এর মূল লক্ষ্য ছিল চীনের পানিসম্পদের ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ এবং উন্নয়নকে আরও কার্যকর, টেকসই ও সমন্বিত করা। চীনের পানি ব্যবস্থাপনার বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ এবং শি জিন পিংয়ের নীতি সম্পর্কিত বিভিন্ন থিংক ট্যাংক, যেমন ‘চায়না ওয়াটার রিসোর্সেস’ এবং ‘চায়না ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার রিসোর্সেস’ (সিআইডব্লিউআর)-এর রিপোর্টগুলো বিশ্লেষণ করলে যে বিষয়গুলো উঠে আসে তা হলো—
সংযমী পানি ব্যবস্থাপনা— শি জিনপিংয়ের পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পানি ব্যবহারের সংযম। চীন একটি জলবায়ু পরিবর্তনশীল দেশ, এবং পানির অভাব অনেক অঞ্চলে প্রবল হয়ে উঠেছে। এই কারণে পানির অপচয় রোধ করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি এবং জল ব্যবস্থাপনার কৌশলগুলো প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে কৃষি, শিল্প, এবং অন্যান্য খাতে পানি অপচয় কমানো যায়।
পানি সংরক্ষণ ও পুনর্ব্যবহার— পানি সংরক্ষণ এবং পুনর্ব্যবহারের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নতুন সেচ ব্যবস্থা, পানি পুনর্ব্যবহার প্রযুক্তি, এবং শহরগুলিতে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ব্যবস্থা। এটি শহরাঞ্চলে পানির চাহিদা মেটাতে সহায়ক এবং কৃষি ব্যবস্থায়ও সেচের কার্যকরী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুতি— চীনে প্রতি বছর বন্যা ও শুষ্ক মৌসুমের কারণে পানি সংকট সৃষ্টি হয়। শি জিনপিংয়ের মাস্টারপ্ল্যানের আওতায়, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ড্রেনেজ সিস্টেম উন্নয়ন এবং পানির যোগান নিশ্চিত করার জন্য ব্যাপক কার্যক্রম নেওয়া হয়। এর ফলে, নদী ব্যবস্থাপনা ও পানির নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
নদী-বেসিন ভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা— চীনের নদী ও জলাশয়গুলোকে একত্রিত করে নদী-বেসিন ভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করা হয়েছে। এই কৌশলটি এমনভাবে কাজ করে যেন প্রতিটি নদী ও জলাশয়ের পানির যোগান, সেচ, ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ একযোগভাবে কার্যকরী হয়। এতে করে সব অঞ্চলের জন্য একটি সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার সুবিধা সৃষ্টি হয়।
শহরের পানির ব্যবস্থা ও দূষণ রোধ— শি জিনপিংয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী, শহরগুলোতে পানির দূষণ রোধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শিল্প ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করা, শহরের পানির রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া উন্নত করা এবং বিশুদ্ধ পানির যোগান বাড়ানোর জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে।
হাইড্রোলজিক্যাল গবেষণা ও প্রযুক্তির উন্নয়ন— পানি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত গবেষণা ও প্রযুক্তির উন্নয়নও এই পরিকল্পনার একটি অংশ। নতুন হাইড্রোলজিক্যাল মডেল, পানি ব্যবস্থাপনার প্রযুক্তি এবং তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে, যেন পানি ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকর এবং সঠিকভাবে পরিকল্পিত হয়।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ যদি চীনের পানি ব্যবস্থাপনা মহাপরিকল্পনার কিছু অংশ নেয়, তবে বিশেষত সেচ ব্যবস্থা, নদী শাসন, পানি সংরক্ষণ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে লাভবান হতে পারে। চীনের অভিজ্ঞতা এবং আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ বাংলাদেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের উন্নতি আনতে সাহায্য করতে পারে, যা কৃষির উৎপাদন বাড়ানো এবং দেশের সার্বিক পানি ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে সহায়ক হবে। তাই প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর বাংলাদেশে পানি সমস্যা সমাধানে আশার আলো দেখাচ্ছে।
সাইফুল ইসলাম শান্ত/ লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বাংলাদেশ সময়: ১৯১২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০২৫
আরএইচ