ঢাকা, সোমবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩২, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ০০ জিলকদ ১৪৪৬

মুক্তমত

পোপ ফ্রান্সিস গাজা নিয়ে শেষ দিনগুলোতে কী ভাবতেন

মহিউদ্দীন মোহাম্মদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ৩:১০ পিএম, এপ্রিল ২৭, ২০২৫
পোপ ফ্রান্সিস গাজা নিয়ে শেষ দিনগুলোতে কী ভাবতেন

বিশ্বজুড়ে ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু ও সার্বভৌম ভ্যাটিকান সিটির প্রধান পোপ ফ্রান্সিস চিরবিদায় নিয়েছেন ২১ এপ্রিল। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধান ও হাজারো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

 

পোপের প্রস্থানে শান্তিবাদী মানুষের হৃদয় দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। কেননা, সারা পৃথিবীর যেখানটাতে মানবতা বিপণ্ন হতে দেখেছেন—সেখানেই ছুটে গেছেন তিনি। গাজা তথা ফিলিস্তিন ইস্যুসহ সাম্রাজ্যাবাদী হিংস্রতায় বিধ্বস্ত জনপদের মানুষের অন্তরে পোপ ফ্রান্সিস বহুকাল বেঁচে থাকবেন।

যদিও ইসরায়েলের মানুষ তাকে নিয়ে নীরবতা দেখিয়েছে। রাষ্ট্রীয় যে শোকবার্তা দিয়েছিল তা পরে মুছে ফেলেছে। হিংস্রতা ইহুদিবাদিদের যেমন, ইতিহাসে ঠিক একই রকম এক পোপের ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছিল।  

এই শোকার্ত মুহূর্তে পোপ ফ্রান্সিস ও পোপ আরবানের কথা মনে পড়ছে। একই ধর্মের দুই নেতা-প্রথমজন শান্তির জন্য নিরন্তর চেষ্টা করেছেন। অন্যজন রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছেন মানুষের খুনে।  

কী চেয়েছিলেন পোপ দ্বিতীয় আরবান
এখন থেকে শোয়া নয়শ’ বছর আগের কথা। ধর্মের নামে, জেরুজালেম উদ্ধারের নামে ইতিহাসে খুনের নহরে স্রোত বইয়ে দিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন পোপ দ্বিতীয় আরবান।

পোপ দ্বিতীয় আরবানের উদ্দীপ্ত ঘোষণা— জেরুযালেমের পুনরুদ্ধারকল্পে অগ্রসরমান ক্রুসেডারদের বর্মে যতক্ষণ থাকবে ক্রসচিহ্ন, ততক্ষণ তাদের জন্য থাকবে ইহলোকে আর্থিক সকল সুযোগের এবং পরলোকে স্বর্গলাভের নিশ্চয়তা। উদ্ধার কর পবিত্র জেরুযালেম!! God wills it!! মহামান্য পোপের এই বাণী শ্রোতৃমণ্ডলীর গগনবিদারী লক্ষ কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো- God wills it- ঈশ্বর এ-ই চান!!! ..... ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দ। এগিয়ে চলল ক্রুসেড-বাহিনী।  

জার্মান প্রফেসর মেয়ারের কথায়— ১০৯৫ সালের ১৮ নভেম্বরকে ইতিহাসে ক্রুসেডের সূচনা সময় বলে ধরা হলেও যে মুহূর্তটি আহুত কাউন্সিলের ইতিহাসে বিশেষ স্থান বলে চিহ্নিত হয়ে আছে, তা হচ্ছে ২৭ নভেম্বরের শেষ লগ্ন। ওই লগ্নেই পোপ দ্বিতীয় আরবান তার জ্বালাময়ী বক্তৃতায় সমবেত খ্রিস্টান শ্রোতৃমণ্ডলীর মনে জ্বালিয়ে তুলেছিলেন প্রাচ্য-মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের আগুন। অতঃপর আরম্ভ হলো খ্রিস্টান ধর্মযোদ্ধাদের সংগঠনের কাজ এবং সংগঠন শেষে ক্রুসেডের নামে, মানব-হননের জন্য অভিযাত্রার তারিখ নির্ণয়।

মানব ইতিহাসে এই রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়ার বাসনার বিপরীতে জেরুজালেমে আর্তমানবতার পাশে নিজেকে শামিল রেখেছেন পোপ ফ্রান্সিস। তাই এত ক্ষোভ ইসরায়েলের। অন্যদিকে গাজার খ্রিস্টান ও মুসলমানরা পোপ ফ্রান্সিসকে স্মরণ করে, সম্মান জানাতে মাথার তাজ করে রেখেছেন। শান্তির ভাবনায় উজ্জীবিত ছিলেন পোপ ফ্রান্সিস। তিনি ধর্মকে নিরাপত্তার বাহন করে তুলেছিলেন বলে দুনিয়ার মানবতাবাদীদের হৃদয় ভেঙেচুরে গেছে। ইউক্রেন, আর্মেনিয়া, আজারবাইজাইন, ইরাক, ফিলিস্তিন, সুদানসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ ও সেখানকার মানুষের জন্য ছুটে গেছেন।  

মৃত্যুর আগে আহ্বান
আলজাজিরায় কলামিস্ট বেলেন ফেমান্দেজ একটা কলাম লিখেছেন। যার শিরোনাম “পোপ ফ্রান্সিস মৃত্যুর আগে গাজায় শান্তির আহ্বান জানিয়েছিলেন। কেউ কি শুনবে?” যারা মানুষের মধ্যে হিংসা ছড়িয়ে দেয় তাদের এ ভাষণ কর্ণকুহরে পৌঁছানো দরকার। ইস্টার সানডের ভাষণে পোপ উদ্বেগ জানিয়ে সেদিন বলেন—
“গাজার জনগণ আর বিশেষ করে এর খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কথা ভাবছেন, যেখানে ভয়াবহ সংঘাত মৃত্যু ও ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং একটি নাটকীয় ও শোচনীয় মানবিক পরিস্থিতি তৈরি করছে। ” এই বয়ানে অবশ্যই, গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের চলমান গণহত্যার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। দেশটি ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ৫১,২০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।

গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানোর জন্য পোপ তার চূড়ান্ত প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করেছেন। এজন্য তিনি প্রশংসার দাবিদার। আর এটা তিনি এমন এক সময় করলেন বিশ্ব যখন ফিলিস্তিনিদের গণহত্যা অনির্দিষ্টকালের জন্য চালিয়ে যেতে দিতে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট বলে মনে হচ্ছে।

যদিও তিনি নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেননি ‘ক্ষুধার্ত মানুষ’কে সাহায্য করতে দিচ্ছে না কারা, আর এর দায় কার। তথাপি এটি স্বাভাবিকভাবেই মার্চের গোড়ার দিকে গাজা উপত্যকায় সমস্ত মানবিক সাহায্য সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার ইসরায়েলি সিদ্ধান্তের প্রতি ইঙ্গিত, তা বোঝা যায়, যা জোরপূর্বক অনাহার ও যুদ্ধাপরাধের সমান।

ভ্যাটিকান নিউজের বরাতে জানা যায়, পোপ ফ্রান্সিস পুনরায় গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বোমা হামলা শুরু হওয়ায় বলেন—আমি দুঃখিত, অনেক মৃত্যু ও আহতের ঘটনা ঘটেছে। আমি অবিলম্বে অস্ত্রবিরতি ও সংলাপ শুরু করতে সাহসিকতার আহ্বান জানাচ্ছি। যাতে সমস্ত জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া যায় ও একটি চূড়ান্ত যুদ্ধবিরতি সম্পন্ন হয়।

আসলে গাজা নিয়ে পোপের অবস্থান দেখে বলতে পারি অনৈতিক সময়ে আমাদের নৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।

পশ্চিমা মিডিয়ার ভণ্ডামি 
এখন চিরবিদায়ের সময়ে অনেক স্তুতি হচ্ছে পশ্চিমা মিডিয়ায়, সাম্রাজ্যবাদী নেতারা প্রশংসা করছেন। এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলে লিখেছেন গার্ডিয়ানের এক সাংবাদিক। তার নাম ওয়েন জোন্স। তিনি কঠোর সমালোচনা করেছেন।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের মৃত্যু ভণ্ডামির প্রকাশকে উস্কে দিতে পারে। পোপ ফ্রান্সিসের ক্ষেত্রেও তাই প্রযোজ্য, যিনি এখন নেতা এবং মিডিয়া দ্বারা প্রশংসিত, যারা তার নিন্দা করা মন্দ কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। "পোপ ফ্রান্সিস দরিদ্র, নিপীড়িত এবং ভুলে যাওয়াদের জন্য একজন পোপ ছিলেন," বলেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কায়ার স্টারমার। তিনি এমন একজন প্রধানমন্ত্রী যিনি অনেক দুর্বল পেনশনভোগীদের কাছ থেকে শীতকালীন জ্বালানি পেমেন্ট কেড়ে নিয়েছিলেন এবং ৪০০,০০০ ব্রিটিশকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার আক্রমণের সমর্থক জো বাইডেন লিখেছেন “তিনি বিশ্বজুড়ে ... দুর্ভোগের অবসান ... প্রচার করেছিলেন। ’

প্রকৃতপক্ষে, গাজার ভাগ্য পোপের শেষ বছরগুলিকে ব্যস্ত করে তুলেছিল বলে মনে হয়েছিল। তার শেষ ইস্টার সানডের ভাষণে একটি শক্তিশালী ধর্মোপদেশ ছিলো— যেখানে তিনি ‘মৃত্যু ও ধ্বংস’ আর এর ফলে ‘নাটকীয় ও শোচনীয় মানবিক পরিস্থিতি’র কথা বলেন—যা খুব কমই কোনো পশ্চিমা মিডিয়া প্রচার করেছিল। প্রকৃতপক্ষে, গাজা সম্পর্কে তার সাহসী বক্তব্যের কোনো উল্লেখযোগ্য কভারেজ খুঁজে পেতে আপনাকে সংগ্রাম করতে হবে। যখন তিনি বলেন—“এটি যুদ্ধ নয়। এটি সন্ত্রাসবাদ। ” তার সর্বশেষ প্রকাশিত লেখায়, পোপ ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রতি তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে ঘোষণা করেছেন—“শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধের চেয়ে, সাহসের প্রয়োজন অনেক বেশি। ”

গাজার খ্রিস্টান ও পোপ 
গাজার খ্রিস্টানদের সাথে এই বিপন্ন অবস্থায় পোপ ফ্রান্সিস সব সময় খোঁজ রাখতেন। বিবিসির ভাষ্য থেকে একটা উদাহরণ নেওয়া যাক-
“আস-সালাম আলাইকুম” বা “আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক”—এই বছরের শুরুতে গাজার প্যারিশিয়ানদের সাথে কুশলবিনিময়ের সময় পোপ ফ্রান্সিস আরবি ভাষায় সাহস করে এভাবেই বলেছিলেন।

তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত একটি ছোট ভিডিওতে ফিলিস্তিনি অঞ্চলের ক্ষুদ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখিয়েছে ভ্যাটিকান, যাদের অনেককেই তিনি নাম ধরেই চিনতেন।

১৮ মাস ধরে যুদ্ধ চলার সময় তিনি তাদের সুস্থতার বিষয়ে খোঁজ নিতে রাতে ফোন করে কথা বলতেন।

ভিডিও কলে পোপ স্থানীয় পুরোহিতদের জিজ্ঞাসা করতেন, ইতালীয় ভাষা পরিবর্তন করে “আজ তোমরা কী খেয়েছ?” 

গাজায় মাত্র কয়েকশ খ্রিস্টান রয়েছে। আর আছে প্রায় ২০ লক্ষেরও বেশি মুসলিম জনসংখ্যা। অনেকেই গাজা শহরের হোলি ফ্যামিলি ক্যাথলিক চার্চে বসবাস করছেন ও ইবাদত করছেন। পোপের মৃত্যুতে তারা অনুভব করছেন যে তারা একজন প্রিয় বন্ধুকে হারিয়েছেন।

কামাল নামে একজন খ্রিস্টান যিনি তার সন্তান ও স্ত্রীকে হারিয়েছেন গাজা যুদ্ধে। তিনি আলজাজিরার সাথে কথা বলেন। তিনি জানিয়েছেন— অসুস্থতার আগে, তিনি প্রতি সন্ধ্যায় গির্জায় আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের সাথে ফোনে কথা বলতেন এবং অসুস্থ হওয়ার পরেও নিয়মিতভাবে যোগাযোগ করতে থাকেন।
তার ফোনের সময়, তিনি গাজায় আমাদের জন্য শান্তি ও স্থিতির জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। যুদ্ধ জুড়ে যেকোনো ফোনে তিনি ‘শান্তি’ শব্দটি কখনও ভোলেননি। তার সমর্থনে আমরা সবাই—খ্রিস্টান ও মুসলিম অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। তিনি আমাদের নিরাপত্তার জন্য প্রতিদিন প্রার্থনা করতেন।

বাংলাদেশ সময়: ৩:১০ পিএম, এপ্রিল ২৭, ২০২৫ /

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।