ঢাকা, রবিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

...‘মগের মুল্লুক’ রাজধানীতেই

আহ্‌সান কবীর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৯, ২০১২
...‘মগের মুল্লুক’ রাজধানীতেই

তিনি বিজ্ঞান বিষয়ক বক্তৃতা করে বেড়ান। তরুণ বয়সে দেশে দর্শনির বিনিময়ে বিজ্ঞান বক্তৃতার প্রচলন ঘটান মূলত তিনি।

এখনও সেই নেশাকেই পেশা হিসেবে ধরে রেখেছেন; উদ্দেশ্য আলোকিত মানুষে ভরে দেবেন দেশ। অবহেলিত এই দেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে পরবর্তী প্রজন্মের জ্ঞানসিদ্ধ মেরুদণ্ডে ভর করে।

কিন্তু এই সরল-সিধা আলাভোলা মানুষটির মন ভালো নেই। কারণ, তার পরলোকগত পিতার রেখে যাওয়া জমিতে রীতিমত ৫তলা ভবন দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন অন্য লোক। সেই ‘অন্য লোক’ বা লোকেরা এতই শক্তিশালী যে রাজউক তাদের কিছু বলে না। বলে তো না-ই, এমনকি দেশটাকে ‘মগের মুল্লুক’ বানিয়ে পরের জমি দখল করে বাড়ি তোলা পক্ষেরই পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী।

এ ঘটনা দুর্গম উড়ির চরের বা টেকনাফ-তেঁতুলিয়ার কোনও অখ্যাত এলাকার নয়; এমনকি ভারতের একসময়ের দস্যুঅধ্যুষিত কুখ্যাত চম্বল এলাকার নয়, শতাব্দীকাল ‍আগের যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসও নয়, খোদ রাজধানী ঢাকা শহরে ঘটেছে এই ঘটনা (বিশ্বাস না হয় সঙ্গে দেওয়া ছবিটি আবার দেখুন)।
 
সরেজমিনে রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় চাক্ষুষ করা গেছে, এই অবিশ্বাস্য ঘটনার প্রমাণ। জনপ্রিয় বিজ্ঞান বক্তা ও বেশকিছু বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থের রচয়িতা আসিফ বাংলানিউজকে জানান, তার বাবার কেনা এই জমিতে থাকা একতলার টিনশেড বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাড়াটিয়াদের মেরে-পিটে বের করে দিয়ে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা সেখানে ৫তলা ভবন দাঁড় করায় সবার চোখের সামনে দিয়ে।
 
জানা গেছে, রাজউকের সাবেক অথরাইজ্‌ড অফিসার হারুন উর রশীদ এই অবৈধ ভবন নির্মাণের সঙ্গে জড়িত। তিনি স্থানীয় বাড্ডা কল্যাণ সমিতির প্রধানও। ‘কল্যাণ সমিতি প্রধানের’ এই ‘অকল্যাণকর’ কাজের সঙ্গী হিসেবে আছেন রাজউকের এস্টেট শাখার এক নারী কর্মচারীও। ভবন নির্মাণের সঙ্গে জড়িত কর্মীরা জানান, এই ভবনের মালিক এক নারী। এই নারী সেই রাজউক কর্মচারী। রাজউকের সাধারণ পর্যায়ের কর্মচারী এই নারী এলাকায় ‘সুরাইয়া ম্যাডাম’ নামে পরিচিত। তার হাতে নাকি অনেক ক্ষমতা, তিনি চাইলে রাজধানীর যে কোনো জায়গার জমিজমা বিষয়ে যে কাউকে মোটামুটি ‘চড়ক গাছ’ দেখিয়ে ছাড়তে পারেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন রাজউকের সাবেক অথরাইজ্‌ড অফিসার হারুন উর রশীদ এবং নাসের কন্ট্রাক্টর নামে এক ব্যক্তি। তাদের ক্ষমতার কাছে দেশের সব আইন-কানুন মনে হচ্ছে নাবালক!

নথিপত্র অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঢাকা মহানগর জরিপ, আরএস জরিপ, সিএস জরিপ— সবগুলো জরিপেই ৩ কাঠার ওই জমির মালিক হিসেবে বিজ্ঞানবক্তা আসিফের মরহুম পিতা মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম আক্তারুজ্জামানের নাম আছে।

রেকর্ডপত্র মোতাবেক, ১৯৯৪ সালে রাজউকের গুলশান-বাড়িধারা প্রকল্পের জন্য ক্ষতিগ্রস্থদের বাড্ডা এলাকায় প্লট বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার এবং সে সূত্রে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সরকারি কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামানের জমিও ওই বিজ্ঞাপিত জায়গার মধ্যে পড়লে তিনি নিয়ম মোতাবেক নালিশি স্থানে প্লট বরাদ্দ চেয়ে ১০ হাজার টাকা ফিসহ আবেদন করেন। প্রসঙ্গত, রাজউকের ১৯৮৯ সালের এক নথিতে আক্তারুজ্জামানের জমি যে কোনও সরকারি হুকুম দখলের বাইরে রাখার নির্দেশনা রয়েছে। সে সূত্রে ১৯৯৯-২০০০ সালে সম্পন্ন হওয়া মহানগর জরিপে ওই জায়গা ফের আক্তারুজ্জামানের নামে রেকর্ড করা হয়। সে অনুযায়ী দলিল-পর্চাও দেওয়া হয়। এরপর জমির মালিক আক্তারুজ্জামান ওই জায়গায় টিনশেড ঘর তুলে ভাড়া দেন।

এরপর প্রায় ১০ বছর পার হয়।

প্রসঙ্গত, ১৯৬৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর মূল মালিক মোছা. আজিজুন নেছা ও সুলতানা বেগমের নিকট হতে সাড়ে তিন কাঠা জমি সাফ কবলা দলিল মোতাবেক এ কে এম আক্তারুজ্জামান ক্রয় করেন। এ জমির দলিল ও নকশা তার সন্তানদের কাছে সংরক্ষিত আছে (সরকারি জমা-বহিতেও কাগজপত্র সংরক্ষিত)।

এদিকে, ২০০৯ সালের ১৭ নভেম্বর হঠাৎ করে একদল সন্ত্রাসী এসে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ওই বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে দেয় এবং ভাড়াটিয়াদের মেরে তাড়িয়ে দেয়। পরদিন ১৮ নভেম্বর থেকে ওই জমিতে বহুতল ভবনের ভিত নির্মাণ শুরু হয়। এ ঘটনায় মুক্তিযোদ্ধা আক্তারুজ্জামান বাড্ডা থানায় দখলবাজদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন।

বাড্ডা থানা পুলিশ রহস্যজনক কারণে সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার বা তাদের পরিচয় উদঘাটনে ব্যর্থ হলেও ওই জমিতে নির্মাণ কাজ তখনকার মত বন্ধ করে দেয়। একই সময়ে হাইকোর্টে করা রিট সূত্রে ওই জমিতে সব ধরনের নির্মাণ কাজের ওপর স্থগিতাদেশ দেন মহামান্য আদালত।

এদিকে, ২০১০ সালের ৩১ জানুয়ারি আক্তারুজ্জামান মারা যান। তার মৃত্যুর কিছুদিন পর ওই জমিতে ফের নির্মাণকাজ শুরু করে দখলবাজরা। নির্মাণ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বললে ভীত সন্ত্রস্ত স্বরে তারা জানান, ভবনের মালিককে তারা চেনেন না। এমনকি ভবন নির্মাণে নিয়োজিত সুপারভাইজারের নামও শ্রমিকদের কেউ-ই বলতে চান না। তবে সন্ধ্যার দিকে নাসের কন্ট্রাক্টর নামে এক ব্যক্তি তাদের টাকা দিয়ে যান বলে শ্রমিকরা জানান।

এলাকাবাসী জানান, নাসের কন্ট্রাক্টরকে কেউ দেখেননি, তবে নাম শুনেছেন। মোটকথা প্রভাবশালী দখলবাজদের ভয়ে ভীত সবাই। মোট কথা, পরের জমি জোর করে দখল করে ভবণ নির্মাণের এই দুঃসাহস এবং এরপর হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে একই কাজে রত থাকার স্পর্ধা দেখে স্থানীয়দের সবার মুখে তালা লেগে গেছে।

এ ব্যাপারে কথা বললে বাড্ডা কল্যাণ সমিতির নেতা হারুন উর রশীদ বলেন, তিনি এ ভবন নির্মাণের বিষয়ে কিছু জানেন না। তবে এখন যে স্থানে ‘অবৈধ’ ভবনটি নির্মাণ করা হচ্ছে তার পাশে অন্য কোনো প্লট মুক্তিযোদ্ধা আক্তারুজ্জামানের সন্তানরা চাইলে তিনি ব্যবস্থা করে দেবেন।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করলে রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নূরুল হুদা বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা রাজউকে আবেদন করলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। কোনো অনিয়ম থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কিন্তু একটি সহজ প্রশ্ন অবশ্যই রাখা যায় সন্মানিত রাজউক চেয়ারম্যান মহোদয়ের কাছে— মরহুম মুক্তিযোদ্ধা‍ আক্তারুজ্জামানের প্লটটিতে কোনো অনিয়ম থাকার বিষয়ে অনুসন্ধান করা কি তার জন্য এতই কষ্টকর? একাজে রাজউকের মত একটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের কতটুকু সময়ই বা প্রয়োজন হতে পারে? এ জবাব কি কেউ দেবেন?

সব কাজেই কি প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হতে হবে এই দেশে?

জমির অবস্থান: জেলা-ঢাকা, থানা-বাড্ডা, জে এল নং- ২৯১, সি এস দাগ নং- ১২০৫, খতিয়ান নং ৪০৭, ৪২০, মৌজা- বাড্ডা, পরিমাণ - ৩ কাঠা ৪ ছটাক।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৪ ঘণ্টা, ১৯ নভেম্বর, ২০১২
একে 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।