ঢাকা, রবিবার, ১০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২৫ মে ২০২৫, ২৭ জিলকদ ১৪৪৬

মুক্তমত

আঙুর ফল আর টক নয়

মোফাজ্জল করিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩:৫০, মে ২৪, ২০২৫
আঙুর ফল আর টক নয় মোফাজ্জল করিম। ছবি: সংগৃহীত

ক’দিন আগে টিভিতে দেখলাম, চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলের একজন উদ্যোগী চাষির ইন্টারভিউ হচ্ছে। ওই চাষি ভদ্রলোক তার নিজ বাগানে পরীক্ষামূলকভাবে আঙুর চাষ করে সাফল্য লাভ করেছেন।

তার আঙুর লতাগুলোতে থোকায় থোকায় পাকা আঙুর ঝুলছে আর তিনি এগুলো থেকে একটি-দুটি আঙুর পেড়ে পেড়ে ইন্টারভিউগ্রহীতাকে খাওয়াচ্ছেন। আঙুর খেয়ে টিভির ভদ্রলোক খুব তৃপ্তির সঙ্গে তার প্রশংসা করছেন।

দৃশ্যটি দেখে আমার বা আমার মতো অন্য সব দর্শকেরও নিশ্চয়ই খুব ভালো লেগেছে। যাক, অবশেষে তাহলে এই সোনার দেশের সোনার মাটিতে আঙুরও ফলতে শুরু করল। নিশ্চয়ই সেই দিন আর বেশিদূরে নয়, যেদিন আম-কাঁঠাল-লিচুর মতো আঙুরও বেশুমার উৎপন্ন হবে এই দেশে। এ কথা ঠিক, বাংলাদেশের জলবায়ু আঙুর-আপেল-নাশপাতি-বেদানা ইত্যাদি ফল উৎপাদনের জন্য ঠিক অনুকূল নয়।

তবে আমাদের কৃষিবিদ ও উদ্যোগী কৃষকরা যুগ যুগ ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছেন বৈরী পরিবেশ-প্রতিবেশকে জয় করে ওই সব ‘কুলীন’ ‘বিদেশি’ ফল ফলাতে। এই কিছুদিন আগেও মাল্টাকে মনে করা হতো বিদেশি ফল। আমাদের নিষ্ঠাবান কৃষি গবেষক ও উদ্যোগী কৃষকদের চেষ্টায় এখন দেশি মাল্টা পাওয়া যায়। আর গুণে-মানে সেই মাল্টা তার বিদেশি ‘কাজিনদের’ চেয়ে খুব একটা খারাপ বলা যাবে না।

আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণার পর এর মান আরো উন্নত হবে আশা করা যায়। সেই সঙ্গে ফলনও বৃদ্ধি পাবে, সরবরাহ বাড়বে, দামও কমবে। একই কথা বলা যায় ড্রাগন ফল নামক অপর একটি ‘নবাগত’ ফল সম্বন্ধে।

আঙুর নিয়ে কথা বলতে শুরু করলে প্রথমেই বলতে হয় কয়েক যুগ আগেও এই সুমিষ্ট সুস্বাদু ফলটি আমাদের দেশে খুব একটা সুলভ ছিল না। একে তো দেশে আম-জাম-কলা-কাঁঠাল-আনারসের মতো এটা উৎপাদিত হতো না—যাও সামান্য পাওয়া যেত, তা ছিল বাইরে থেকে আমদানি করা এবং তার মূল্য ছিল সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে, তদুপরি গুরুতর অসুখবিসুখে রোগীর পথ্য ছাড়া এটা খাওয়ার জো ছিল না এর উচ্চমূল্য ও দুষ্প্রাপ্যতার জন্য।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল উনিশ শ পঞ্চাশ-ষাটের দশকের একটা ‘জোকের’ কথা। এক লোক বেশ কিছুদিন ধরে হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন, কিন্তু তাঁর অবস্থার তেমন উন্নতি হচ্ছিল না। তাঁকে দেখতে তাঁর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব রোজই আসতেন, সঙ্গে আনতেন নানা রকম ফলমূল, খাবারদাবার। একদিন এক দর্শনার্থী আঙুর নিয়ে এলেন। আঙুর দেখেই রোগীর চোখমুখ অন্ধকার হয়ে গেল। তিনি তাঁর দর্শনার্থী বন্ধুকে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘পল্টু, তুই আমার বাল্যবন্ধু, আমার কাছে কিছু লুকাবি না, ভাই। ঠিক করে বল তো, ডাক্তার আমার সম্বন্ধে কী বলেছে। আমার সময় কি শেষ হয়ে গেছে?’ বলেই ভদ্রলোক কাঁদতে লাগলেন। তাঁর বন্ধু তো অবাক। তিনি চানতে চাইলেন, ‘কেন? এমনটি কেন মনে হচ্ছে তোর? তুই তো মাশাল্লাহ আগের চেয়ে অনেক ভালো আছিস। ’ রোগী ভদ্রলোক বললেন, ‘তাহলে তুই আমার জন্য আঙুর নিয়ে এসেছিস কেন? আঙুর তো লোকে শেষ সময়ে খায়। ’

আসলেই গত শতাব্দীর পঞ্চাশ-ষাটের দশকে আঙুর ছিল এমনই দুর্লভ একটি ফল। আমরা যখন স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানের অংশ ছিলাম, তখন কিছু আঙুর আসত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। দাম ছিল সাধারণ ভোক্তার নাগালের বাইরে। সেই আমলেও বোধ করি আমাদের দেশে আঙুর ফলানোর চেষ্টা হয়েছে, তবে তা সফল হয়নি।

স্বাধীনতার পর আমাদের কৃষিক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে, তার পেছনে আছে আমাদের বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের নিরলস প্রচেষ্টা, উদ্যম ও লাঙলের পেছনের মানুষ (ম্যান বিহাইন্ড দ্য প্লাও) নীরব কর্মী কৃষক। একাত্তরে স্বাধীনতার সময় আমাদের জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে সাত কোটি। আজ ৫৪ বছর পর তা বেড়ে ১৮ কোটির কাছাকাছি। তখনো অর্থাৎ সাড়ে সাত কোটির আমলেও ফসল ফলিয়েছে পর্দার আড়ালের আমাদের অগণিত নীরব কর্মী, নিরন্ন-নির্বস্ত্র কৃষককুল। আজ ১৮ কোটির মুখেও অন্ন তুলে দিচ্ছেন সেই কৃষক, যদিও তার নিজের ভাগ্যের তেমন ইতরবিশেষ উন্নতি হয়নি। হয়তো ৫৪ বছর আগে তাঁর হাড়-জিরজিরে শরীরে একটি গেঞ্জিও ছিল না, দু’বেলা পেট পুরে খেতে পেতেন না তিনি। আজ তাঁরই পরিশ্রমের ফলে ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশ খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা চলে।

সেই পরিশ্রমী, নির্লোভ, নিরহংকার কৃষকের দেশে অভিজাত ফল আঙুর কত দিন অধরা থাকবে? আর আমরা খোঁজ রাখি না বটে, তবে লোকচক্ষুর আড়ালে অনেক উদ্যোগী মানুষ আছেন, যাঁরা চুয়াডাঙ্গার সেই সফল আঙুর চাষির মতো নীরবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করতে। সেদিন ইনশাআল্লাহ আর দূরে নয়, যেদিন আম-জাম-কাঁঠালের মতো আঙুরও ফলবে এ দেশের গ্রামে গ্রামে, এমনকি শহরের ‘ছাদকৃষিতেও’।

তবে ভুললে চলবে না, সব প্রচেষ্টাই সফল হয় প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা ও অনুকূল পরিবেশ পেলে। আমার মতে, এই জাতির অগ্রগতি-উন্নতি নির্ভর করে তিনটি বিষয়ের ওপর : স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষি। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, শিল্পায়নকে বাদ দিচ্ছেন কেন? জবাবে আমি বলব, না, বাদ দিচ্ছি না। তবে একটি সুস্থ-সবল জাতি যদি প্রকৃত শিক্ষালাভে বঞ্চিত না হয়, আর তার অর্থনীতির প্রধান অবলম্বন যে কৃষি (এবং সেই সঙ্গে কৃষির মূল চালিকাশক্তি যে কৃষক) তা যদি অবহেলিত না হয়, তাহলে অন্য সবকিছু আসবে দুয়ে দুয়ে চারের মতো।

উন্নত, অনুন্নত সব দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি থাকে একটি বা দুটি : কারো শিল্প-কলকারখানা, কারো দক্ষ প্রশিক্ষিত জনশক্তি, কারো হয়তো খনিজ সম্পদ ইত্যাদি। আমাদের কী? আমরা তো অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নত দেশের কাতারে নই, বরং অনুন্নত দেশের তকমা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের কথাবার্তা চলছে আমাদের নিয়ে। তাহলে আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কী? চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়, আমাদের ‘ফরেন রেমিট্যান্স’ (যা জোগান দেয় বিদেশে কর্মরত আমাদের অগণিত অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত শ্রমজীবী মানুষ), আমাদের তৈরি পোশাক শিল্প এবং আমাদের আবহমান কালের কৃষি। সেই কৃষিতে কোনো সাফল্যের খবরে অবশ্যই সবার আগে ধন্যবাদ দিতে হয় কৃষককে এবং তাঁর সহযোগী   ‘ফ্রেন্ড, ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড’ কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। আমাদের খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধি বা কৃষিতে যেকোনো সাফল্যের পেছনে আছেন আমাদের লাখ লাখ কৃষক ভাই এবং পর্দার আড়ালের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীরা।

সামনে আসছে নতুন অর্থবছর। সরকার জাতির সামনে পেশ করবে নতুন বছরের বাজেট। সেই বাজেটে কী থাকবে, কী থাকবে না—তা বর্তমান অনির্বাচিত সরকারের আমলে বলা মুশকিল। তবে জাতির মেরুদণ্ড বলতে যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কৃষিকে বোঝায়, সেগুলো নিশ্চয়ই যথাযথ গুরুত্ব পাবে বাজেটে—এ কথা নিঃসংকোচে বলা যায়।

শেষ করি আবার আঙুর প্রসঙ্গ দিয়ে। আমাদের আশা, অচিরেই দেশে আঙুরের চাষ সাফল্যের মুখ দেখবে। ঈশপের গল্পের সেই শিয়াল যে লাফিয়ে লাফিয়ে আঙুরলতায় ঝুলন্ত আঙুর পাড়তে ব্যর্থ হয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছিল এই বলে : আঙুর খেতে পারলাম না তো কী হয়েছে, আঙুর তো একটা টক ফল।

আমরা কিন্তু ওই শিয়াল পণ্ডিতের মতো নিজেকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে বলতে চাই না : ‘আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারব না তো কী হয়েছে, ভোট মানে তো মারামারি, কাটাকাটি, দিনের ভোট রাতের অন্ধকারে দিয়ে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা। অতএব নির্বাচন হোক, না হয় না হোক, কিচ্ছু যায় আসে না। নির্বাচন একটা বাজে জিনিস। ’ না, আমরা ওই শিয়াল পণ্ডিতের মতো কয়টা লাফ দিয়ে ব্যর্থ হয়ে নিজেকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিতে চাই না। আমরা বিশ্বাস করি, গত ভোটবিহীন দেড় যুগের অধরা আঙুর ফল জাতির হাতের মুঠোয় এবার আসবেই আসবে। তবে তার জন্য চাই অটুট জাতীয় ঐক্য ও সংশ্লিষ্ট সবার সময়োচিত সঠিক পদক্ষেপ।

 মোফাজ্জল করিম, লেখক : কবি ও সাবেক সচিব

এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।