নারায়ণগঞ্জের ভেতরে সিদ্ধিরগঞ্জে আরেকটি নারায়ণগঞ্জ বানিয়ে ফেলতে যাচ্ছিল একটি চক্র। এরাই হয়ে উঠতে থাকে সেখানকার হর্তাকর্তা-বিধাতা।
বুধবার রাত ৮টায় সেনাবাহিনীর ঘণ্টাখানেকের অ্যাকশনে ভূতের লেজে আগুন লাগার মতো দশা। সব ঠাণ্ডা। আদমজী বিহারি কলোনি এলাকায় এই অভিযানে সেনাবাহিনী সঙ্গে রাখে পুলিশকেও। অভিযানে কিছু মাদক, দেশীয় ১৭-১৮টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
আটক করা হয় দুই নারীকে। এত দিনের হর্তা-কর্তারা সব পগারপার। ধরার মতো আর কাউকে পাওয়া যায়নি। কে কোথায় গেছে বা আছে আল্লাহ মালুম।
এর আগে এত দিন তো কত কী-ই মনে করা হয়েছিল। কত মিথ-ন্যারেটিভই না ছিল তাদের নিয়ে। বলা হয়েছিল এরা মহাপরাক্রমশালী। গডফাদারেরও ফাদার-ব্রাদার!
সেনাবাহিনীর টু দ্য পয়েন্টে হিট করার বিষয়টি পেশাগত অভিজ্ঞতা ও পেশাদারি। ঠিক এ পন্থায়ই কদিন আগে ‘জায়গামতো’ মব পাণ্ডামির বিরুদ্ধে টোকেন অ্যাকশন দেখা গেছে সেনাবাহিনীর।
মাত্র কয়েক জায়গায় চালানো অ্যাকশনে ফল মিলেছে সারা দেশে মহৌষধের মতো। যদিও সম্প্রতি আবার কোথাও কোথাও মববাজরা দানবীয় হওয়ার চেষ্টা করছে বলে বিচ্ছিন্ন তথ্য মিলছে। মাঠ থেকে সেনাবাহিনী তুলে নেওয়া হচ্ছে বা সেনাবাহিনী আর কাউকে ‘লাল’ করবে না—এমন কিছু মেসেজ ছড়াতে এরা কসরত করছে। কিছুদিন আগে ঈদ যাত্রা উপলক্ষে যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়ার বিরুদ্ধেও কয়েক জায়গায় সেনাবাহিনীর ‘সামান্য’ থেরাপি পড়েছে। তা জেনে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় সেনাবাহিনীর কয়েকটি অভিযানের ভিডিও দেখে সোজা হয়ে গেছে মালিক, চালক, হেলপারদের সিন্ডিকেট। ঈদে মানুষ এর সুফল পেয়েছে।
এরও আগে ৫ আগস্ট-পরবর্তী বিভিন্ন শিল্প এলাকায় গজবের মতো নাজিল হয় কিছু পাণ্ডা। চাঁদা, আগুন, ভাঙচুর বাহিনী উৎপাদনের চাকা থমকে দিতে থাকে। দেশ তখন পুলিশবিহীন অবস্থায়। পুলিশ নিজেরাই দৌড়ের ওপর। সেখানেও কোনো আওয়াজ না দিয়ে এক পর্যায়ে সেনা অ্যাকশনে ম্যাজিকের মতো ফল মেলে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর-বসিলাসহ কয়েকটি এলাকায় কিছু দুর্বৃত্তের দস্যুতা-ডাকাতির আজাবও দমেছে সেনা সদস্যদের কয়েক দিনের দ্রুত পদক্ষেপে। এসবের সুবাদে সেনাবাহিনীর প্রতি শান্তিকামী মানুষের আস্থা ও ভরসায় আরো মাত্রা যোগ হয়। এটাই স্বাভাবিক। মানুষ যেখানে আস্থা-ভরসা পাবে, সেদিকেই ফিরবে। মানুষ কেন, যে কোনো প্রাণী বা জীবমাত্রই তা করবে। আর মানুষের ক্ষেত্রে একবেলা না খেয়ে থাকলেও নিরাপত্তাই সবচেয়ে বড় চাওয়া। তারা তখন রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক, সামরিক-অসামরিক বিষয়-আশয় দেখে না। দেখে বা খোঁজে কেবল ভরসা।
ভরসার সেই জায়গায় ৫ আগস্ট নতুন রূপে সামনে এসেছে সেনাবাহিনী। বাহিনীপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান মানুষের আকাঙ্ক্ষা বুঝেছেন। রিয়ালিটি অনুধাবন করেছেন। করণীয় ঠিক করার প্রজ্ঞা দেখিয়েছেন। গুনেমানে উন্নীতকরণসহ তাঁর গোটা বাহিনীকে সেভাবে প্রস্তুত করেছেন। তাঁর এ দক্ষতা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ইতিহাসে আরো উচ্চাসন দিয়েছে। সাধারণ মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে, সব চক্র-সিন্ডিকেট, অন্যায়-অনিয়ম, চাঁদাবাজি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী প্রতীকী অ্যাকশনে নামলে সুফল না এসে পারে না।
জেনারেল ওয়াকার সেনাবাহিনীকে জনআস্থার এ পর্যায়ে নিতে পারার পেছনে তাঁর সদিচ্ছার সঙ্গে আরো কিছু বিষয়ের সংযোগ রয়েছে। সেনাবাহিনী কম-বেশি সব সময়ই শক্তিশালী। শক্তি নিয়ে সমস্যা নেই। বাহিনীকে অবিরাম প্রশিক্ষণে উন্নীত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখতে পারা বিশাল ব্যাপার। তাদের কোনো দল বা সরকার নয়, সংবিধানের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ রাখতে পারা একজন সেনাপ্রধানের অন্যতম পবিত্র দায়িত্ব। তিনি সেটা অক্ষরে অক্ষরে পেরেছেন। কারো কারো বুঝতে না পারা বা গোলমাল বাধানোর প্রবণতা রয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সরকারের অধীনে নয়, সংবিধানের অধীনে পরিচালিত হয়। বিষয়টি সূক্ষ্ম। সরকারের অধীনে আর সংবিধানের অধীনে পরিচালিত হওয়ার তফাৎ অনেক। আমাদের সংবিধানের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সকল ক্ষমতা জনগণের, যা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়। সেনাবাহিনীর প্রধান দায়িত্ব দেশ রক্ষা করা, শাসন নয়। সেনাবাহিনী সরকারের পরিপূরক নয়, সম্পূরক। বাহিনীর টপ টু বটম পেশাদারি, শৃঙ্খলা, চেইন অব কমান্ড ও প্রতিরক্ষায় মনোযোগ প্রতিষ্ঠায় তিনি আলাদা যশ-খ্যাতি গড়তে পেরেছেন। সেনা সদস্যদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে দূরে রেখে জাতীয় নিরাপত্তা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় মনোনিবেশে রাখতে পেরেছেন। যার অনিবার্যতায় জনসমর্থন ও রাজনৈতিক বাস্তবতাবোধ বেগবান হয়েছে। সেই সঙ্গে সেনাবাহিনীকে জাতীয় উন্নয়নে শরিক রাখতে পেরেছেন। যার বেনিফিসিয়ারি দেশ, জনগণ, সেনাবাহিনী—সবাই। সব মিলিয়ে ক্ষমতা দখলে সেনাবাহিনীর বিরত থাকা দুর্বলতার লক্ষণ নয়, বরং কৌশলগত প্রজ্ঞার পরিচয়।
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ক্ষমতায় না নিয়ে নিরপেক্ষ ভূমিকায় রাখতে পারার মাধ্যমে সেনাপ্রধানের গণতন্ত্রের প্রতি সম্মান দেশের স্বার্থসংরক্ষণ, জনআস্থা, সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠানিক মর্যাদাসহ সব দিক রক্ষার যে নজির তৈরি হয়েছে, তা সেনা ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কে পাঠপঠনের বিষয় হয়ে থাকবে। একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে সেনা সহায়তার ব্যাতিক্রমী এ দৃষ্টান্তের ফলোআপ হিসেবে সেনাবাহিনী আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। অঙ্গীকার অনুযায়ী সেনাপ্রধান তাঁর বাহিনীকে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার প্রতি মনোযোগী রাখছেন। আবার তাদের মূল দায়িত্ব দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রশাসনিক কাজে বিশেষ মনোযোগও অক্ষুণ্ন রাখতে পারছেন। তাদের অংশীজন করে রাখতে পারছেন নতুন স্বপ্নের বাস্তবায়ন এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের সহযোগী হিসেবে। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মানুষের প্রত্যাশা, বাস্তবতা, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন, নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা, সেনাবাহিনীকে সেনানিবাসে ফিরিয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষাসহ আনুষঙ্গিক নানা বিষয় তিনি গোপন রাখেননি। এ ব্যাপারে নিজের অবস্থানও তিনি প্রকাশ্যে জানান দিয়েছেন। কেবল জানান দেওয়া পর্যন্ত নয়, কথায় অটলও আছেন। শত উসকানি-বিভ্রান্তি-গুজব হজম করছেন অবিরাম। তাগিদ দিয়েই চলছেন সবাইকে ঐকমত্যে পৌঁছার।
সিভিল-মিলিটারি সম্পর্ক বা সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সম্পর্কে কঠোর রীতি-রেওয়াজেও একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তনও এনেছেন এই সেনাপ্রধান। একসময় রেওয়াজ ছিল, সেনাপ্রধান বা তাঁর ইমিডিয়েটরা জনসমক্ষে কথা বলতেন না। গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলতেন। রাজনীতি-অর্থনীতির ভাবনা জানাতেন না। সেখানে এবার বড় রকমের সংস্কার। রাজনীতিকদের চব্বিশের পরিবর্তনের সুযোগ কাজে লাগানোর আহবান জানিয়েই যাচ্ছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখার কথা কেবল বলছেনই না, সীমানার মধ্যে ভূমিকাও রাখছেন। সংস্কার সম্পর্কেও তাঁর স্পষ্ট অবস্থান। নির্বাচন এবং হস্তক্ষেপ নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য এবং বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন দেশের মানুষকে প্রেরণা জুগিয়েছে। বাকিটা নির্ভর করছে রাজনীতিকদের ওপর। তিনিসহ তাঁর সহকর্মীরা কথা বলছেন গণমাধ্যমের সঙ্গে, অফিসার্স এড্রেসের তথ্য লুকানো হচ্ছে না। সেনা সদর থেকেও আনুষ্ঠানিক ব্রিফ হচ্ছে। সেনাবাহিনীর অভিযানের তথ্যের আপডেটও জানানো হচ্ছে, যার মাধ্যমে জনগণের জিজ্ঞাসার জবাব মিলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিস ইনফরমেশন, ডিজ-ইনফরমেশনের জবাবও দেওয়া হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর মতপার্থক্য হচ্ছে, বিভেদ হয়েছে—এ রকম প্রশ্নের জবাবও এড়ানো হচ্ছে না।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ