ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

রোগজীবী ডাক্তারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই, আসুন...

বন্দনা কবীর, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১২
রোগজীবী ডাক্তারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই, আসুন...

ঢাকা: আমি প্রায় দেড় বছর ধরে প্রচণ্ড অসুস্থ। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে লড়ে বেঁচে আছি।

কিছুদিন হলো প্রতিদিন গড়ে চার-পাঁচ ঘণ্টা হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে থেকে বাসায় ফিরছি এবং পরের আট ঘণ্টার মধ্যে আবার যাচ্ছি। হাসপাতালে ভর্তি না থেকে চিকিৎসা নিয়েই বাসায় ফিরে আসার কারণ, আমি ছাড়া আমার সংসার দেখার কেউ নেই।

দীর্ঘ দেড় বছর অসুস্থতার কারণে আমি বাইরের সব ধরনের কাজ ছেড়ে ঘরে বসে আছি। এখন ঘরে বসে থাকা আর নেটে পড়ালেখা করা ছাড়া আমার আর কোনো কাজ নেই। অসুস্থতা আমার কাছ থেকে বাইরের জগৎটাকে বলতে গেলে কেড়েই নিয়েছে। এদিকে গত জানুয়ারি মাসে একটা ড্রাগ রিয়েকশনের ফলে চোখ এতো খারাপ হয়ে গেছে যে, চশমা ছাড়া কাগজের বই প্রায় পড়তেই পারি না।

ওষুধের প্রতিক্রিয়ায় এক ঘণ্টা ঘুমাই, এক ঘণ্টা ঝিমাই আর একটু ভালো লাগলে ফেসবুক/ব্লগ/নেট সার্ফিং করি। মন দিয়ে সবার লেখা পড়ার চেষ্টা করি আর ভাবি। সব নিয়ে ভাবি। স্বদেশ-বিদেশ, রাজনীতি, মানবতা...। এই ভাবনা ছাড়া এখন আর আমার কিছুই করার নেই। ফাঁকে ফাঁকে লিখতে ইচ্ছে করলে লিখি। তাও শুয়ে-শুয়েই।

গত প্রায় তিন সপ্তাহ আগে আমার শরীর হঠাৎ খুব খারাপ হয়ে যায়। প্রথমে শুরু হলো বমি। কিছুই খেতে পারি না। পানি খেলেও বমি হয়ে যায়। দ্বিতীয় দিন শুরু হলো পাতলা পায়খানা। তাই ডিসেন্ট্রি মনে করে আমার স্বামীর অফিসের ডাক্তারের পরামর্শ মতো ওষুধ/স্যালাইন খেলাম। তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আইসিডিডিআরবি’র চালের স্যালাইন খেয়ে ওটা বন্ধ করালাম।

এক দিন পর ১২ নভেম্বর শুরু হলো তলপেটের ব্যথা। প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে এক বন্ধুর পরামর্শে সেন্ট্রাল হাসপাতালে গেলাম ডাক্তার (উনি কার্ডিওলোজি ও মেডিসিন স্পেশালিস্ট) দেখাতে। ডাক্তার সাহেব বন্ধুর মামা সম্পর্কীয়। তিনি আমাকে দেখে সবার আগে একটি আলট্রা সাউন্ড করতে বললেন। সঙ্গে সঙ্গে ওই সেন্ট্রালেই আল্ট্রা সাউন্ড করে জানা গেল, আমি সাড়ে ছয় সপ্তাহের গর্ভবতী এবং আমার জরায়ুমুখে বেশ কয়েকটা সিস্ট/টিউমার আছে (যা আমি আগে থেকেই জানতাম)। আল্ট্রা সাউন্ডের রেজাল্ট নিয়ে তখনই আবার ডাক্তারের কাছে গেলাম। তিনি আমার সব ধরনের ওষুধ বন্ধ করে দিয়ে শুধুমাত্র একটি বমি বন্ধ করার ও একটি গ্যাসের ওষুধ দিয়ে ভালো একজন গাইনির ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিলেন।

এক দিন পর ১৩ নভেম্বর রাত প্রায় ৮টার দিকে হঠাৎ আমার ব্লিডিং শুরু হলো, সঙ্গে প্রচণ্ড ব্যথা। স্বামীকে ফোন করতেই বাসায় এসে আমাকে নিয়ে ছুটলেন হাসপাতালের দিকে। বাড়ির কাছে বলে ইমার্জেন্সির জন্য তার প্রথম পছন্দ (অথবা সহায়) ইউনাইটেড হাসপাতাল। ১৪ নভেম্বর রাত থেকে শুরু হলো আমার নরক যন্ত্রণা।

এই লেখার মূল উদ্দেশ্য...

ইউনাইটেড নামক ফাইভস্টার টাইপ ধনীক শ্রেণীর জন্য নির্মিত একটি হাসপাতালের কারণে আমার এই যন্ত্রণার সূত্রপাত। ২০০৮-এর দিকে একটি অর্থোপেডিকের সমস্যা নিয়ে ওখানে ভর্তি হই। হাসপাতালে ৯/১০ দিন অবস্থানের পরে ছাড়া পাই এবং এক বস্তা ওষুধ সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরি। তখন সকালে ১৮টি দুপুরে ৫টি এবং রাতে ফের ১৮টি করে ওষুধ খাওয়া শুরু হয়। মোট তিন মাস কন্টিনিউ করার কথা হয় এই ওষুধ। কিন্তু দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যেই শুরু হয় আমার পেটব্যথা এবং বমি। পানি খেলেও পেটব্যথা করে। বাংলাদেশের সব বড় বড় নামি দামি যতো পেটের/গ্যাসের ডাক্তার আছে সব ভাজা ভাজা করেও কোনো ফল না পেয়ে গেলাম বাড়ির কাছের প্রেস্ক্রিপশন পয়েন্ট হাসপাতালে এন্ডোস্কপি করাতে। ওটার রেজাল্ট হাতে নিয়ে ভাবলাম এখানে যখন এসেছি তখন এখানকার গ্যাসের ডাক্তারকে একটু দেখিয়ে যাই। গেলাম। এন্ডোস্কপির রেজাল্ট ভয়াবহ দেখে কী ওষুধ খাই জানতে চাইলে ইউনাইটেডের ফাইল উনাকে দেখালাম। উনি সেই ফাইলের ওষুধ লিস্ট দেখে আৎকে উঠে বললেন, ‘‘এতোগুলো ওষুধ মানুষ খায় কী করে?! এতো ওষুধ খাওয়ার ফলেই আপনার আলসার হয়ে গেছে। ’’

উনি সব ওষুধ বন্ধ করে শুধু তিনটি ওষুধ দিলেন। কিছুদিন ভালো থাকলাম। খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবনের মধ্যে কিছুদিন ভালোই ছিলাম। তারপরে আবার শুরু হলো কিছুটা অনিয়ম।

২০১২’র জানুয়ারির দিকে সেভারাল পেইন শুরু হল আবার। এবার তলপেটে। গাইনীর প্রবলেম নিশ্চয়ই। শুরু হলো ভালো গাইনী ডাক্তারের খোঁজ। ভালো গাইনীর ডাক্তার কে? জিজ্ঞেস করতে দু একজন ডঃ নুসরাতের নাম বললেন। তিনি আবার ইউনাইটেড হাসপাতালেই বসেন। অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে গেলাম তার কাছে। এক গাদা টেস্ট করিয়ে সকাল থেকে প্রায় বিকেল পর্যন্ত হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে ভাত খেয়ে এক ডোজ আর রাতে এক ডোজ এই দুই ডোজ ওষুধ খেয়ে ঘুমোতে গেলাম। ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ শুরু হলো নরক যন্ত্রণা। সারা শরীরের চামড়া ফুলে ফেঁটে রক্ত বেরিয়ে এসেছে। স্বামী আবার আমাকে নিয়ে ছুটলেন, সেই ইউনাইটেডেই! সিসিইউতে দুই দিন পরে আমার জ্ঞান ফিরলো। জ্ঞান ফেরার পরে নিজের হাত পা দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠতেই নার্স ছুটে এলেন। নার্স আমার জ্ঞান ফেরা দেখে প্রথমেই বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। ’ তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার এই অবস্থা কেন? তিনি বললেন, ‘ড্রাগ রিয়েকশন হয়েছে। এই ধরনের রিয়েকশনে সাধারণত বেশির ভাগ মানুষই মারা যায়, আপনার হায়াত আছে বলে বেঁচে গেছেন’।

সিসিইউ থেকে কেবিনে শিফট করার পর ডঃ নুসরাতকে কল করা হলো। তিনি অতি শীঘ্র অপারেশন করে আমার ইউটেরাস ফেলে দেবার কথা বললে আমি বেঁকে বসলাম। এক দু’দিন পরে একটু সুস্থ হতেই আমার স্বামী আমাকে সেখান থেকে বের করে নিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে আমাকে নিয়ে ব্যাংকক চলে গেলেন।

সেখানে দেখালাম। সেখানকার ডাক্তার সব টেস্ট করিয়ে আমার ইউটেরাস ফেলে দেওয়ার কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে অপারেশন করতে অস্বীকৃতি জানালেন এবং মুখে খাওয়ার জন্য ওষুধ দিলেন। চিকিৎসার সঙ্গে ‘কিচ্ছু হবে না সব ঠিক হয়ে যাবে, মেডিকেল সায়েন্স এখন অনেক উন্নত, ওষুধেই অনেক বড় বড় রোগের চিকিৎসা হয় অপারেশন ছাড়াই’— এই ধরণের সান্ত্বনা আর আস্থা নিয়ে দেশে ফিরে এলাম আড়াই মাসের ওষুধ নিয়ে।

আড়াই মাস পরে যেতে হবে। ভালোই ছিলাম। ওষুধের কোর্স শেষ করে আবার গেলাম। এবার ওরা পাঁচ মাসের জন্য চিকিৎসা এবং ওষুধ দিয়ে ফের পাঁচ মাস পরে যেতে বললেন। জুলাইয়ের শেষ দিকেই মনে হয় ফিরেছি ওখান থেকে। ক’দিন পরে আবার যাওয়ার কথা। কিন্তু এর মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার (১৪ নভম্বর) আবার খুব বেশি অসুস্থ হয়ে যাওয়াতে গভীর রাতে স্বামী উপায়ান্তর না দেখে বাড়ির পাশে বলেই ফের ইউনাইটেডে নিয়ে গেল ইমার্জেন্সিতে। ওখানে ডিউটি ডাক্তার বড় কোন ডাক্তারের সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। এরপর দুই চারটা ব্যথানাশক ইঞ্জেকশন দিয়ে ভর্তি করে কেবিনে ফেলে রাখলেন। সকালে গাইনীর স্পেসালিস্ট এসে আল্ট্রাসাউন্ড করতে বলে এবং যে ওষুধ দেওয়া হয়েছে তা কন্টিনিউ করতে বলে চলে গেলেন। দুই দিন সেখানে থেকে বাসায় এলাম।
 
এক দিন পরেই রাতে শুরু হলো নরক যন্ত্রণা। এলার্জির মতো সারা শরীর ফুলে ঢোল হয়ে গেছে আর এমন চুলকানি... স্বামী আবার টান মেরে ঐ ইউনাইটেডেই নিয়ে গেলেন ইমার্জেন্সিতে। সাড়ে ১১টা থেকে ভোর পর্যন্ত ওইখানে থেকে দুই তিনটা ইঞ্জেকশন নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম কারণ আমি ছাড়া আমার সংসার দেখার কেউ নেই। সারাদিন যেমন তেমন গেল বিকেলে আবার শুরু হলো। স্বামীকে ফোন দিলাম। মাকেও। ঢাকার জ্যাম ঠেলে তাদের বাসায় আসতে দুই ঘণ্টা গেল। এসেই আবার নিয়ে গেল সেই ইউনাইটেডেই! এবার অবস্থা মর মর। ডিউটি ডাক্তার আগের দিনের একটা ইঞ্জেকশন পাল্টে আরেকটা দিলেন। আমার স্বামী বারবার অনুরোধ করছিলেন একজন মেডিসিন স্পেশালিস্টকে কল করতে। কিন্তু ডিউটি ডাক্তার বললেন, ‘পেশেন্ট ভর্তি না করালে উনি আসবেন না’ এটা শুনে পাশ থেকে আরেক পেশেন্টের রিলেটিভ বললেন ‘ভর্তি করালেও সকালের আগে কোনো ডাক্তার আসবে না। উনাকে অন্য কোথাও নিয়ে যান’।

এর মধ্যেই শুয়ে-শুয়ে আমি অন্য একটি ব্লাড ক্যান্সার আক্রান্ত সন্তানের পিতার চিৎকার- চেঁচামেচি, কমপ্লেইন শুনছি। তিনি তার সন্তানকে বিকেল পাঁচটায় নিয়ে এসেছিলেন ওখানে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা পাওয়ার আশায় (ছেলেটির চিকিৎসা দেশের বাইরেই হচ্ছে সম্ভবত। ইমার্জেন্সি কিছু হওয়াতে এখানে আনতে বাধ্য হয়েছেন বলছিলেন। ) ছেলেটিকে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডের সিটেই নাকে অক্সিজেন লাগিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে। এদিকে বিকেল পাঁচটায় ছেলেটির রক্ত পরীক্ষার জন্য নেওয়া হয়েছিল কিন্তু রাত ৮টা পর্যন্তও তিনি সেই রক্ত পরীক্ষার রেজাল্ট হাতে পাননি বলে দিশেহারার মতো ছুটোছুটি করছেন আর পাগলের মতো চিৎকার করছেন।

এই সব দেখে শুনে আমার স্বামী ভয় পেয়ে আমাকে ওখান থেকে বন্ড সই করে ছাড়িয়ে নিয়ে এলেন এপোলোতে নেওয়ার জন্য। ইউনাইটেড থেকে বেরিয়ে পাকিস্তান এম্বাসির সামনে থেকেই জ্যাম। জ্যামে বসে আছি। এমন সময় আমার এক বন্ধু ফোন করলো আমার কন্ডিশন জানার জন্য। সব জেনে সে অনুরোধ করলো, ‘অন্য কোনোদিকে যেওনা সোজা টান মেরে কলাবাগান সেন্ট্রালে চলে এসো’ (ওখানে চিকিৎসা করেই ৮ বার স্ট্রোক করেও আদনানের আম্মা বেঁচে আছেন। এটা আমরা বন্ধুরা সবাই জানি। ) আমার সঙ্গে কথা বলেই সে কলাবাগানে মধ্যবিত্ত/গরীবদের জন্য নির্মিত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করলো। ফোনেই কথা বলে মেডিসিন স্পেশালিস্ট তার মামাকে বসিয়ে রেখে কেবিনও বুকিং দিয়ে রাখলো। ততক্ষণে রাত ৯টার বেশি বেজে গেছে । এদিকে পথে মহাজ্যাম । আর আমার অবস্থা যাই-যাই। রাত ১২টার আগে সেন্ট্রাল হাসপাতালে পৌঁছানো সম্ভব হবে না ভেবে আদনানের দেওয়া ফোন নম্বর দিয়ে ডাক্তার হারিসকে ফোন করা হলো। উনি অবস্থা বুঝে দুটি ওষুধের নাম মেসেজ করে পাঠিয়ে দিলেন। সেই মোতাবেক একটা ডিস্পেন্সারিতে থেমে একটা ইঞ্জেকশন এবং একটা ওষুধ নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শে বাড়ি ফিরে এলাম। ঘণ্টাখানেক পরে উনি নিজে ফোন করে আমার অবস্থা জানতে চাইলেন। তখনো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি। উনি ওই ওষুধটার সঙ্গে দুটো ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে থাকতে বললেন এবং পরদিন উনার সঙ্গে দেখা করতে বললেন।

রাতে ঘুমোলাম। সারাদিন ভালো থাকলাম কিন্তু পরদিন দুপুরের পরে আবার শুরু হল ইচিং আর চামড়া চাক চাক হয়ে ফোলা। ডাক্তারকে ফোন দিলাম। উনি বললেন, ‘আমি এখন পিজিতে আছি। শসস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানের নিরাপত্তার কারণে পুরো ঢাকা শহর জ্যামে আটকে আছে। হাজার চেষ্টা করেও ৬টার আগে তুমি পিজিতে পৌঁছতে পারবে না। আর আমি ৫টার পরেই পিজি থেকে বের হয়ে যাই। তুমি বরং ধানমন্ডির দিক দিয়ে আসতে শুরু করো আমি এইদিক থেকে সেন্ট্রালে পৌঁছে যাবো। কথা ঠিক, সাড়ে ৪টায় বাসা থেকে বেরিয়ে আমরা ৭টায় সেন্ট্রালে পৌঁছলাম।

উনি আমাকে দেখেই ইউনাইটেড এর প্রেস্ক্রিপশন ফাইল নিয়ে বসলেন। আধ মিনিটেই একটি ওষুধে টিক মার্ক দিয়ে বললেন— ‘এই যে, এই একটা ওষুধের কারণেই তোমার এই অবস্থা। যারা পেনিসিলিন সেন্সেটিভ তাদের এই ওষুধে মৃত্যুও হয়ে যায়। তোমার পেনিসিলিন সেন্সিভিটি আছে এই তথ্যটা জানার পরেও এই ওষুধ কী করে দেয়?! এতো বড় স্টুপিডিটি একটা ডাক্তার কী করে করে? এদের বিরুদ্ধে তো মামলা করে দেওয়া দরকার!’ নিজের মনেই বলছিলেন উনি আফসোস কিংবা রাগে।

উনি আমাকে একটি মাত্র ওষুধ ও একটি গ্যাসের ওষুধ লিখে একটু ধৈর্য ধরতে বললেন, ‘এই কষ্টটা/ইচিংটা এক দিনেই তো যাবে না, কম করে হলেও আরো দুটো তিনটে দিন থাকবে। তাই বাঁচতে চাইলে এখন দুটো দিন একটু সহ্য করতেই হবে’। কী আর করা? উনার কথা মতন ওষুধ কিনে বাসায় ফিরে এলাম এবং ধৈর্য ধারণের চেষ্টা করতে শুরু করলাম। কিন্তু যন্ত্রণা তো কমে না সহ্যও হয় না। সারা রাত জেগে নরক যন্ত্রণা সইতে সইতে ভোরে ডাক্তারকে ফোন দিলাম অবস্থা জানিয়ে। উনি বললেন, আমি চাইলেই এখন তোমাকে যে কোনো হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিতে পারি। কিন্তু তাতে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। ওরা তোমার ইচিং এর জন্য একটা ইঞ্জেকশন দেবে আর স্টেরয়েড দিয়ে ফেলে রাখবে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় স্টেরয়েড নিয়ে যদি তুমি আরেকটা অসুখ বাঁধাতে চাও তো ভর্তি হয়ে যাও। নইলে সহ্য করো। সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে গেলে যে কোনো ভালো ডিস্পেন্সারিতে গিয়ে দুই এম্পুল কর্টন আইভিতে নিয়ে বাড়ি চলে যাও।

সকাল নয়টার দিকে ফের বনানী প্রেস্ক্রিপশন পয়েন্টে গিয়ে দুই এম্পুল ইঞ্জেকশন দিয়ে বাড়ি এসে ছটফট করতে করতে ঘণ্টা দুয়েক ঘুমোলাম। স্বামীর কাজ কারবার মাথায় উঠেছে। টেনশনে/রোজ রোজ রাত্রি জাগরণে উনার নিজেরই এখন অসুস্থ হবার অবস্থা। আমার ঘুম ভাঙলে নাস্তা/ওষুধ খাইয়ে ল্যাপটপটাকে হাতের কাছে দিয়ে অফিসে গেলেন।
 
উনি চলে যাওয়ার কিছু পরেই এই লিখতে শুরু করলাম। আজকে, আমার এই এতোগুলো ব্যাক্তিগত কথা বলার উদ্দেশ্য— আমার অর্থ আছে বলে আমি এখনো বেঁচে আছি। কিন্তু আজকে যদি আমার অর্থ না থাকতো তবে অনেক আগেই আমার স্থান কবরের ভেতরে হতো। অর্থহীন বা বিত্তহীনদের যেমন হয়। আমার সামর্থ আছে তাই এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে দৌঁড়তে পারছি, বিদেশে যেতে পারছি। কিন্তু যাদের নেই তারা কী করবে? তারা কি এই সব দায়িত্বজ্ঞানহীন ডাক্তারদের হাতে শুধু মরতেই থাকবে? অথবা ভুল চিকিৎসা নিয়ে দিনের পর দিন ভুগতে থাকবে?

গত রাতেই আমার এতো সব কাহিনী শোনার পরে ইউরোপ আমেরিকায় বাস করা বন্ধুরা বললেন, ‘এই দিকের যেকোনও হাসপাতালে যদি এরকম কোনো ঘটনা ঘটতো তাহলে এদের অবস্থা কেরোসিন হয়ে যেতো। বিলিয়ন ডলারের মামলা রুজু করে দিতো পেশেন্টের ফ্যামিলি। আর একদিন সময় না নিয়ে ওই রোগজীবীদের বিরুদ্ধে মামলা করে দিন/দাও’।

সারারাত সাফার করার পরে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি এই বদমাশ হাসপাতাল/ডাক্তারদের বিরুদ্ধে মামলা করবো। এক উকিলের সঙ্গে কথা হলো, কিন্তু উকিল বললেন, এদের বিরুদ্ধে মামলা করে এই দেশে কোনো ফল পাওয়া যায় না। কোনো ডাক্তারই সাক্ষী হবে না, সব রসুনের গোঁড়া একখানে। তারপরেও আমরা এদের বিরুদ্ধে কিছু না কিছু করবোই বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

আমি এখন জানতে চাইছি, এই সব সো কল্ড হসপিটাল/ডাক্তারদের কী করা উচিত? এই দেশে এখনো অনেক ভালো ডাক্তার আছেন তারাও কিছু বলেন না বা খারাপ ডাক্তারদের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাবস্থাও করেন না। আর সেবার নামে খুলে বসা হাসপাতাল নামক কিছু দাপটে ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও যে লোকে কিছু করবে তার কী উপায়? এদের কাছে কমপ্লেইন করলে দুই একজন ডাক্তারের চাকরিই কেবল চলে যায় বা সাময়িক বরখাস্ত হয়। ব্যাস। এর বেশি কী হয়? এখন পর্যন্ত ভুল চিকিৎসা বা কর্তব্যে অবহেলার জন্য একজন চিকিৎসকেরও কড়া কোনো শাস্তি হয়েছে বা তার চিকিৎসা করার পার্মিট বাতিল হয়েছে এমন নজির আমি হাজার খুঁজেও বের করতে পারিনি। আমি এখন এদের দৌরাত্মের বিরুদ্ধে কার্যকরি কিছু করতে চাই। নিজের ব্যক্তিগত কষ্টের অভিজ্ঞতা থেকে হলেও যে উপলব্ধি হয়েছে তাকে কাজে লাগাতে চাইছি। ডাক্তার নামক কসাইদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু আমি একা আর কতটুকু করতে পারবো? সঠিক উপায়ে কিছু করবার জন্য সকলের সহযোগিতা এবং পরামর্শ প্রয়োজন। কেউ কি একটু পরামর্শ দেবেন? যদিও অন্যান্য দিক থেকেও পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে...

তবুও আমি এইখানে এই কথা বললাম একটি বিষয় জানার জন্য, আমার এই লেখা পড়ে যারা যারা এই সব অব্যাবস্থার শিকার হয়েছেন তারা কি একটু এগিয়ে আসবেন? সাহায্য করবেন আমার এই লড়াইয়ে সাক্ষ্য দিয়ে? এসবের একটা বিহিত করার এখনই সময়। ছাড় দিতে দিতে এরা আমাদেরকে কীট-পতঙ্গ মনে করতে শুরু করেছে। আর কীটের মতনই ট্রিট করে টিপে টিপে মারছে। কেউ কি আসবেন এগিয়ে?

এটি আমার ব্যক্তিগত যন্ত্রণার কথা হলেও আমরা সবাই জানি, এই রকম যন্ত্রণার কথা লক্ষ লক্ষ জনের বুকের মধ্যে জমা হয়ে আছে। এই সব চিকিৎসকের অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন কিন্তু কোনো প্রতিবাদ তো দূরের কথা একটি কথাও বলেন না ঝামেলা এড়ানোর জন্য অথবা ওদের সঙ্গে পেরে উঠবেন না ভেবে। তাই ঐ সব কসাইদের কিছুই হয় না।
 
আমি অনুরোধ করছি, অনুগ্রহ করে কথা বলা শুরু করুন। অল্প অল্প, আস্তে-ধীরে, নম্রস্বরে- উচ্চকিত হয়ে যেভাবেই হোক কথা বলা শুরু করুন। জানি একদিনেই সবকিছু পাওয়া যাবে না। কোনো সমস্যার অবসানও হবে না কিন্তু শুরু করলে শেষ হবেই। আসুন না শুরুটা আমরাই করি। প্রতিরোধ গড়ে তুলি এদের বিরুদ্ধে... এক জোট হয়ে।

বন্দনা কবীর, লেখক/সাংবাদিক [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৭১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০১২
সম্পাদনা: তানিম কবির ও জয়নাল আবেদীন, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।