ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মৌলবাদ: যে কথা বলা হয় না

মোহাম্মদ সালেক পারভেজ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৮, ২০১২
মৌলবাদ: যে কথা বলা হয় না

(কেন এই লেখা? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। সে সুবাদে অনেকের অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হয়।

জীবনে বহুবার ‘মৌলবাদ’ নিয়ে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। ঐ সকল প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে যা পেলাম, তা নিয়েই আজকের এ লেখা। মৌলবাদের মূল-সন্ধানী এ লেখার মুখবন্ধে এটা বলতে পারি— এ যেন কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপের সন্ধান পাওয়া׀)

মৌলবাদ কোনো উর্দু, আরবি বা ফার্সি শব্দের বাংলা অনুবাদ নয় ׀ Fundamentalism একটি ইংরেজি শব্দ, যার বাংলা করা হয়েছে ‘মৌলবাদ’ শব্দটি দ্বারা ׀

মৌলবাদের জন্ম

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায় যে, শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয় আমেরিকায় এবং ১৯২২ সালে׀ ১৮০০ সালের পর থেকে শুরু হয় বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের স্রোত ׀ সেই স্রোতধারায় ভেসে যাবার উপক্রম হয় খ্রিস্টধর্মের অনেক বিশ্বাস ও প্রচলিত ধারণা׀ নাস্তিক্যবাদের (aethism) প্রসার ব্যাপকতা লাভ করে ׀ তখন আমেরিকান খ্রিস্টানদের Protestant সমাজের একটি অংশ খ্রিস্টধর্মের হেফাজতের জন্য একটি আন্দোলন শুরু করে׀ এই আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন Milton এবং Lyman Stewart নামের দুই ভাই। তারা ছিলেন তেল ব্যাবসায়ী׀ তাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও তত্ত্বাবধানে ৬৪ জন লেখক (যাদের মধ্যে ছিলেন পণ্ডিত, পাদ্রী এমন কি মন্ত্রীও; কিন্তু কোনো মুসলমান— অবশ্যই নয়) ধারাবাহিকভাবে ১২টি ভলিউমে খ্রিস্টধর্মের মূল বিষয়াদি বর্ণনা করেন। এই  ভলিউমগুলোর নাম দেয়া হলো The Fundamentals. ধীরে ধীরে ধর্ম-কর্ম ছেড়ে দেয়া অনেক খ্রিস্টান এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয় ׀ এই মতবাদের নাম দেয়া হল Fundamentalism (মৌলবাদ) এবং এই মতবাদে যারা বিশ্বাস স্থাপন করতে লাগল তাদেরকে বলা হল Fundamentalist বাংলায় যার সরাসরি অর্থ হয় ‘মৌলবাদী’।

নিরপেক্ষ পাঠক মাত্রই অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকার করবেন যে, এই Fundamentalism বা মৌলবাদের উত্পত্তির সঙ্গে কোরান-হাদিস-ইসলাম-মুসলমান এবং কোনো মুসলিম দেশের দূরতম সম্পর্কও নেই׀কিন্তু এটা বড়ই দুঃখজনক এবং আফসোসের  বিষয় যে, মৌলবাদের জন্মস্হান এবং সংরক্ষণাগার আমেরিকা আজ মুসলমানদেরকে মৌলবাদী বলছে এবং মুসলিম দেশসমূহে মৌলবাদ খুঁজে বেড়াচ্ছে ׀অথচ কোথাও কেউ প্রতিবাদ করারও নেই। এর প্রধান কারণ ভীরুতা এবং অজ্ঞতা ׀ এই দুটো জগদ্দল পাথরের মত  দুনিয়ার সকল  মুসলমান এবং মুসলিম দেশসমূহের ওপর চেপে বসেছে׀

প্রসঙ্গতঃ এ কথাটি বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, নাস্তিক্যবাদ (যা প্রতিহতের জন্য খ্রিস্টান তথা মার্কিন মৌলবাদের জন্ম) এবং ইসলামী পরিভাষায় প্রচলিত  `কুফর` একই অর্থ বহন করে না׀ নাস্তিক্যবাদের (aethism)  অর্থ  স্রষ্টাকে অস্বীকার করা এবং যারা এই কাজ করে তাদেরকে নাস্তিক(aethist) বলে। পক্ষান্তরে ইসলামের যে কোনো বিষয়কে অস্বীকার করাকে `কুফর` বলে׀ যেমন আবু জেহেল, আবু লাহাব প্রমূখ স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করা সত্বেও নিঃসন্দেহে কাফের কারণ তারা `রিসালাতে` অবিশ্বাসী ছিল׀ এই যুগেও ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক `কাদিয়ানীরা` সন্দেহাতীতভাবে `কাফের` কারণ তারা বিশ্বাস করে না যে হযরত মুহাম্মদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল। অথচ  কাদিয়ানিদেরকে কেউ নাস্তিক বলে না। আরও উদাহরণ দেয়া যায়, মুসলমানদের মধ্যে সুদ খাওয়াকে হালাল মনে করলে কেউ নাস্তিক হয় না কিন্তু সে কাফের হয়ে যায়׀

একটি ধূর্তামি
খোমেনির অনুসারী কিছু ইরানি ছাত্র ০৪-১১-১৯৭৯ ইংরেজিতে তেহরানস্থ আমেরিকান দূতাবাসে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে ৬৬ জন আমেরিকানকে পণবন্দী করে׀ দিন কয়েক পরে প্রথম দফায় ১৩ জন ও পরে ১ জন মোট এই ১৪ জনকে ছেড়ে দেয়া হয়׀ বাকী ৫২ জনকে ছাত্ররা দীর্ঘ সময় ধরে আটক রাখে ও বিভিন্ন দাবী-দাওয়া উত্থাপন করতে থাকে׀ এই ৫২ জন সুদীর্ঘ ৪৪৪ দিন বন্দীদশায় অতিবাহিত করার পরে ২১-০১-১৯৮১ তে মুক্তি পায়׀ ঐ সময়ে পশ্চিমা মিডিয়া খোমেনির ও ইরানের বিপ্লবের আদর্শকে `প্রচারের জন্য` ইসলামী মৌলবাদ (Islamic Fundamentalism)` পরিভাষাটি তৈরি করে׀ এ কথা সর্বজনবিদিত যে খোমেনি ছিলেন একজন কট্টর শিয়া׀ খোমেনির চিন্তা-চেতনা-মতবাদ ইত্যাদি ইসলামের শ্বাশত ধ্যান-ধারণার সাথে সাংঘর্সিক׀  সুতরাং এখানেও একথা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, `ইসলামী মৌলবাদ` আর `দ্বীন ইসলাম` কস্মিনকালেও এক জিনিস নয় ׀

বাংলাদেশে মৌলবাদ

‘বাংলাদেশে মৌলবাদ বিস্তার লাভ করছে’ কিংবা ‘বাংলাদেশ মৌলবাদীদের দখলে চলে যাচ্ছে’ ইত্যাদি বলতে বলতে ইদানিং কিছু কিছু বিদেশি ও তাদের এদেশি বশংবদ দেশবাসীর ঘুম হারাম করে দেবার উপক্রম করেছে׀ এ কথাগুলোতে আসলে কি কোনো সত্য নিহিত আছে? এ প্রশ্নের সোজা সাপ্টা উত্তর হচ্ছে `না`׀ জঘন্য মিথ্যাচার ছাড়া এগুলো আর কিছুই নয় ׀ মিথ্যাচার এ জন্য বলা হচ্ছে, কারণ এদেশে জনসংখ্যার ৫% জনও খ্রিস্টান নয় ׀তাহলে এদেশে Fundamentalism বা মৌলবাদ কীভাবে বিস্তার লাভ করে? দ্বিতীয়ত খোমেনির মতবাদই (যাকে কদর্থে  ইসলামী মৌলবাদ বলা হয়ে থাকে) বা কীরূপে প্রতিষ্ঠা পাবে যেখানে এদেশের মুসলমানদের ৫% জনও শিয়া নয়! এদেশে শিয়াদের কোনো মাদ্রাসা নেই; অধিকন্তু এদেশের প্রতিটি ইসলাম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান (কওমী কিংবা আলীয়া) ও সেসবের নেতৃবৃন্দ শিয়াদেরকে ইসলাম হতে বিচ্যুত একটি গোমরাহী দল বলে বিশ্বাস করে। এতে কারো কোনো সন্দেহ থাকলে যে কোনো মসজিদ-মাদ্রাসার ইমাম-ওস্তাদদের সঙ্গে আলোচনা করে দেখুন উনারা কী বলে। ঢাকার মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে অবস্থিত শিয়া মসজিদ ছাড়া এদেশের আর কোথাও শিয়াদের কোনো কার্যক্রম  নেই׀ অতএব, ইরান কর্তৃক রফতানিকৃত তথাকথিত ইসলামী মৌলবাদ খুঁজতে হলে সর্বাগ্রে সেটা শিয়া মসজিদেই তালাশ করা উচিত׀ অথচ সেখানে সেনা-পুলিশ-র্যাব অভিযান পরিচালিত হতে কখনো শোনা যায়নি׀ এর কারণ কি অজ্ঞতা, না অনিচ্ছা— সেটা দেশের সরকারই বলতে পারবেন׀

বরং আমরা দেখি যে মৌলবাদ খুঁজতে আর মৌলবাদী ধরতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রায় সময়ে বিভিন্ন মাদ্রাসায় অভিযান চালায়, অনেক ক্ষেত্রে নিরীহ ছাত্র-ওস্তাদদের ধরে এনে নির্যাতন চালায়׀

সেলুকাস! সত্যিই বিচিত্র׀ যাদের আজীবন সাধনা মৌলবাদের (চাই সেটা আমেরিকার হোক কিংবা  ইরানের হোক) বিরুদ্ধে, তাদেরকে অপবাদ দেয়া হয় মৌলবাদী নামে!

একটি উদাহরণ দিচ্ছি׀ ধরা যাক,  বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতীব সাহেবকে অথবা মুফতি আমিনীকে অথবা চরমোনাইর পীর সাহেবকে কিংবা  হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম সাহেবকে মৌলবাদী নামে অভিহিত করা হল ׀ এর মানে হচ্ছে উনারা খ্রিস্টান ধর্মীয় মতবাদ প্রচার করছেন׀ প্রিয় পাঠক! এর চেয়ে আজীব বা হাস্যকর কথা আদৌ শুনেছেন কি? বরং প্রকৃত সত্য এটা, যেখানে মাদ্রাসা নেই সেখানেই মৌলবাদ বিস্তার লাভ করে ׀ প্রমাণস্বরূপ পার্বত্য চত্তগ্রামের সাজেক নামক এলাকার কথা উল্লেখ করা যায়׀ এলাকটি আজ খ্রিস্টান প্রধান যদিও বছর বিশেক আগেও তা ছিল না।

মৌলবাদী নয় মুসলমান

মৌলবাদ একটি পারিভাষিক শব্দ যার রযেছে সুনির্দিষ্ট অর্থ׀ মসজিদ-মন্দির-গির্জার অর্থ যেমন সুনির্দিষ্ট, পাদ্রী–পুরোহিতকে ইমাম সাহেব বললে যেমন ভুল হয়, যুদ্ধকে জিহাদ বলা যেমন সত্যের অপলাপ, উপবাস যেরূপ রোজা হয় না, পীর-বুজুর্গকে সাধু-সন্ন্যাসী বলা যেমন ভুল ঠিক তেমনি একজন মুসলমানকে মৌলবাদী বলে অভিহিত করা চরম অসাধুতা׀ যারা এ কাজ করে তারাই জ্ঞানপাপী׀

অনেক সময় অনেক নিষ্ঠাবান মুসলমানকেও রাগের মাথায় বলতে শোনা যায় “আমিও একজন মৌলবাদী। ” যিনি একথা বলেন তিনি মৌলবাদের মানে জানেন না এবং না বুঝে নিজকে অনেক বড় মিথ্যাবাদী বানাচ্ছেন׀ একজন মুসলমানের পক্ষে নিজকে মৌলবাদী দাবি করা চরম অজ্ঞতার নিদর্শন׀ যে চুরি করে নাই সে কক্ষনো নিজকে চোর বলে স্বীকার করবে না, যতই সে রাগের মাথায় থাকুক না কেন׀ তদ্রুপ মৌলবাদের মানে জানা আছে এমন কোনো মুসলমান নিজকে কস্মিনকালেও মৌলবাদী ভাবতে নারাজ, স্বীকার করাতো দূরের কথা׀ বাস্তব হচ্ছে, মুসলমান মাত্রই মৌলবাদের বিরোধী׀

ধোঁকায় পড়ে অনেকে বলতে পারেন যে মৌলবাদী দ্বারা তারা ঐ সকল মুসলমানদেরকে বুঝাতে চাচ্ছেন যারা ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিষয়ের প্রতি আস্থাশীল׀ এটা এক মারাতামক বিভ্রান্তি׀ এর কোনো দরকারই নেই। আর আমাদের মহান প্রতিপালকও দ্বীনের রাহবারদের কী বলতে হবে তা শিখিয়ে দিয়েছেন “কথায় কে উত্তম ঐ লোক অপেক্ষা যে আল্লাহ্‌র প্রতি মানুষকে আহবান করে, নেক কাজ করে এবং বলে , ‘নিশ্চয়ই আমিতো মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত ’ (৪১: ৩৩)। ”

লেখক: সহকারী  অধ্যাপক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভারসিটি   
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৭ ঘণ্টা, ২৮ নভেম্বর, ২০১২
একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।