ঢাকা, রবিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

পদ্মাসেতুর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ

অথচ মিডিয়ায় আসে না...

রফিকুল বাহার, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১২
অথচ মিডিয়ায় আসে না...

ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের সড়কপথের দূরত্ব প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। কোনো যানবাহন সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার গতিতে চললে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম কিংবা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পৌঁছাতে পাঁচ ঘণ্টা লাগার কথা।

আরো ৩০ মিনিট যাত্রাবিরতি ধরলে ঢাকা-চট্টগ্রামের সড়কপথের জার্নি সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার। কিন্তু বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে কেউই জোর গলায় বলতে পারবেন না এই সময়সীমার মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পার হয়েছেন। এমনও দিন আছে এই সড়ক পার হতে সময় লাগে ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা। এ সময়ে বিমানে যে কেউ চলে যেতে পারবেন সুদূর ইংল্যান্ডেও।

দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কপথে যাতায়াতে দেরির কারণ হল যানজট, দুর্বল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট, অতিরিক্ত যানবাহন ও অসচেতনতা। সাধারণভাবে এই চারটি কারণ চিহ্নিত করা হলেও মূল কারণ আসলে রাজনীতিকদের দূরদর্শিতার অভাব। দুই প্রধান দলের নীতিনির্ধারকদের কেউই এই সড়কটির ব্যাপারে মাথা ঘামান বলে মনে হয় না। তা না হলে নির্ধারিত সময়ে চারলেনে উন্নীত করার কাজ এই ডিসেম্বরে শেষ হয়ে যেত।

দেশের জন্য কেন মহাগুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়কটি? দেশের রাজধানী থেকে বাণিজ্যিক রাজধানীতে দ্রুত আসার জন্য? না, গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, বাংলাদেশের পাঁচ কোটি মেট্রিক টন আমদানি-রপ্তানি পণ্য এই সড়ক দিয়ে দেশ-বিদেশে আনা-নেওয়া করা হয়। দেশের প্রধান সামুদ্রিক বন্দর চট্টগ্রাম দিয়েই খাদ্যশস্য, কেমিক্যাল, গাড়ির যন্ত্রাংশ, শিল্পের কাঁচামাল, পাট, তৈরি পোশাকসহ সব পণ্যই এখানে জড়ো করা হয় প্রথমে। এসব খাত থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভ্যাট, শুল্ক, আয়কর ও বন্দর কর্তৃপক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে গত বছর। আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনের প্রবৃদ্ধি বাড়ছে প্রতি বছর ১০ শতাংশেরও বেশি।

২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চারলেন উন্নীত করার কাজ আগামী দুই বছরেও শেষ হবে কি-না এই বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। কোনো কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর মেঘনা ও দাউদকান্দি সেতু ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়লে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে পুরো দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমও। কারণ সড়কপথে দ্রুত ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াত করার বিকল্প কোনো পথও এতদিনে তৈরি হয়নি। অর্থাৎ একদিকে বিকল্প না থাকা অন্যদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চারলেন নির্মাণ কাজের ধীরগতি দেশের গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ নেটওয়ার্ক ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অথচ ঝুঁকিপূর্ণ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নিয়ে যতটা না গত এক বছরে মিডিয়ায় হৈচৈ হয়েছে, তার  চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ পদ্মাসেতু নিয়ে কয়েকগুণ বেশি হৈচৈ হল। একথা ঠিক, এই সরকারের মেয়াদে পদ্মাসেতু নির্মাণের বিষয় নিয়ে বড় ধরনের দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছে। সাধারণত মিডিয়া সবসময়ই সোচ্চার থাকে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে। কিন্তু উন্নয়ন ও অর্থনীতির চাকা যেসব বিষয়কে ঘিরে, সেদিকে খুব কমই মনোযোগ মিডিয়ার। এটা ঠিক যে, পদ্মাসেতুর মতোই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চারলেন করার ব্যাপারে মিডিয়া যদি আগ্রহ ও কৌতূহল দেখাতো তাহলে পুরো ব্যাপারটি অন্যরকম হতে বাধ্য হত। বলা দরকার যে, দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ৯৫ শতাংশ ব্যবহার হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। অপরদিকে একই ধরনের কার্যক্রমে পদ্মাসেতুর ব্যবহারের সম্ভাবনা মাত্র ২ শতাংশ।

চট্টগ্রামে ৩৫ হাজার কোটি টাকার যে রাজস্ব আদায় হয় তা থেকে ১০ শতাংশ চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করার দাবি তুলেছিল চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো। সরকার কোনো কারণে সদয় হয়ে চট্টগ্রামবাসীর এই দাবির প্রতি সমর্থন দিলে প্রতি বছর অন্তত সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ পাওয়া যাবে। এই সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা দিয়ে এ ধরনের আরো একটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সম্প্রসারণের কাজ করা যাবে। টাকার জোগান নিরবচ্ছিন্ন হলে দুই থেকে তিন বছরেই এই কাজ শেষ করা সম্ভব। ২০১০ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সম্প্রসারণ কাজ শুরু করার দুই বছর পর যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি এই প্রতিবেদককে বলেছেন, তাদের সরকারের আমলে পুরোপুরিভাবে এর নির্মাণকাজ শেষ হবে না।

শুধু দ্রুত কাজ শেষ করার স্বপ্ন নয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজ দ্রুত শেষ হলে সাশ্রয় হবে দেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রাও। অকারণ ও অহেতুক যানজটের কারণে বছরে অন্তত এই মহাসড়কেই অতিরিক্ত কয়েক হাজার কোটি টাকার জ্বালানি পোড়ে। নষ্ট হয় আরো অতিরিক্ত হাজার কোটি টাকার শ্রমঘণ্টাও। তাই এই মহাসড়কের যান চলাচল নেটওয়ার্ক সহজ ও স্বচ্ছন্দ রেখেই আমরা উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরো একধাপ এগিয়ে যেতে পারব।

একজন সংবাদকর্মীর এ ধরনের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সাশ্রয়ের ধারণা কতটা বাস্তবসম্মত সেটি যাচাই কিংবা পরীক্ষার জন্য আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা একটি প্রতিযোগিতায় নামতে পারেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী এসব নীতিনির্ধারকদের বিনীত অনুরোধ জানাই, কোনো ধরনের সরকারি প্রটোকল ছাড়াই অনেকটা নিরবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নিজের ব্যক্তিগত যানে চড়ে একদিন যাতায়াত করুন। তাহলে বুঝতে পারবেন বিনিয়োগকারী, বিদেশি পর্যটক, ব্যবসায়ী, যানবাহনের চালক, যাত্রী ও সাধারণ মানুষকে প্রতিদিন কী মারাত্মক ভোগান্তি পোহাতে হয়! শুধু ভোগান্তি আর লান্নত নয়, যানজটে পড়ে নষ্ট হয় তাদের শ্রমঘণ্টা আর কষ্টের টাকাও।

বাংলাদেশ সময়: ২০১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।