ঢাকা, রবিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সরকারের রাশিয়া সফর: লাভ-ক্ষতির খতিয়ান

জিনিয়া জাহিদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৩
সরকারের রাশিয়া সফর: লাভ-ক্ষতির খতিয়ান

বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া সফর সচেতন মহলে ইতোমধ্যেই অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কারণ আর আট দশটা গুরুত্বহীন সফরের তুলনায় রাশিয়া সফর বিভিন্ন কারণে অনেক বেশি গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে।

গত ১৫ জানুয়ারি ২০১৩ বিশ্বের অন্যতম দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রফতানিকারক দেশ রাশিয়ার সাথে ছয়টি সমঝোতা স্মারকসহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি চুক্তি সই করে বাংলাদেশ। চুক্তি তিনটির মধ্যে পরমাণু কেন্দ্র স্থাপনে রাশিয়ার কাছে সহায়তা বাবদ মোট ৫০ কোটি ডলার ঋণ, রাশিয়া থেকে সমর সরঞ্জাম কিনতে ১০০ কোটি ডলার ঋণ এবং  ঢাকার বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারে পরমাণুশিল্প তথ্য কেন্দ্র স্থাপন এবং বাংলাদেশ ও রাশিয়া পরমাণুসংক্রান্ত তথ্য বিনিময় উল্লেখযোগ্য।

গুরুত্ব বিচারে বাংলাদেশের জন্য সবার আগে প্রাধান্য পায় সর্বাধুনিক তৃতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি নির্ভর ৬০ বছর মেয়াদী পরমাণু বিদ্যু‍ৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি। বাংলাদেশে পাবনায অবস্থিত রূপপুরে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম পারমাণবিক কেন্দ্র স্থাপনের জন্য রাশিয়া বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সহায়তা দেবে, যা দেশের বিদ্যু‍ৎ ঘাটতি কমাতে সহয়তা করবে। চুক্তির খসড়া অনুযায়ী, পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারিগরি গবেষণার জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ পাবে বাংলাদেশ। এই বিপুল অর্থ ব্যয় করা হবে শুধুমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কত খরচ হবে তা নির্ধারণে কারিগরি গবেষণার জন্য। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংবলিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুটি ইউনিটের প্রতিটি স্থাপনে ১৫০ থেকে ২০০ কোটি ডলার ব্যয় হতে পারে, যার পুরো অর্থ যোগান দেবে রাশিয়া এমনটাই চুক্তিতে রয়েছে বলে মিডিয়াতে প্রকাশ।

এ কথা অনস্বীকার্য যে আমাদের বিদ্যুতের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। প্রতিবছর বিপুল ভর্তুকি দিতে হয় সরকারের অপরিণামদর্শী শ্বেতহস্তিতে পরিণত হওয়া রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্লান্টের জন্য। এই সব স্বল্পমেয়াদের বিদ্যুৎ প্লান্টের পেছনে যে অর্থ ভর্তুকি দেওয়া হয় তার থেকে অনেক অল্প খরচেই রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো আধুনিকায়ন করে সেসবের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে আমাদের বিদ্যুতের ঘাটতি মেটানো সম্ভব ছিল। কিন্তু সেসবের ধার না ধেরে সরকার উচ্চাভিলাষী পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণের জন্য ২০০-২৫০ কোটি ডলারের ঋণের ফাঁস স্বেচ্ছায় গলায় জড়িয়ে নিল।

বিদ্যুত্‍খাতকে শক্তিশালী করার কথা বলে বিপুল অঙ্কের অস্বচ্ছ এই ঋণের টাকায় যে বিপুল অঙ্কের দুর্নীতি হবে না এমন কী কোনও গ্যারান্টি সরকার আমাদের দিতে পারবে? বিদ্যুত্‍সমস্যার সমাধানের নামে বর্তমান সরকার যে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জনগণের উপর নতুন এই ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিল তা থেকে বেরিয়ে আসার কোনও পথ সরকার কী খোলা রাখতে পেরেছে বা পারবে?

বিদ্যু‍তে ঋণের চেয়েও সব থেকে আশঙ্কাজনক হলো রাশিয়ার সাথে ১০০ কোটি ডলারের (প্রায় সাড়ে আট হাজার কোটি টাকা) ঋণ নিয়ে সমরাস্ত্র ক্রয়চুক্তি। বিশাল অঙ্কের ঋণ নিয়ে অস্ত্র কেনার আদৌ কোনও প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশের ছিল কী না তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। অস্ত্র কেনার এই অর্থ অস্ত্র বিক্রেতা রাশিয়ার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে কেনা হবে যার সুদের হার কত, কত বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে, কোনও কারণে ঋণ শোধ করতে না পারলে ফলাফল কী হতে পারে, এসব আমরা কিছুই জানি না। এমন কী আমরা কী ধরনের অস্ত্র কিনব তা-ও রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সমঝোতা চুক্তিতে নির্ধারণ করা হয়নি। এর অর্থ এই নয় কী যে আমাদের আসলেই কোনো অস্ত্রের দরকার কী না তা সরকার নিশ্চিত নয়!

সরকার পক্ষ থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনাতে যুক্তি দেয়া হচ্ছে যে, এই সব সমরাস্ত্র কেনা হচ্ছে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সক্ষমতা আরো বাড়াতে। বলা হচ্ছে যে, এই অস্ত্রের ঋণের দায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে শোধ করা হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে হঠা‍ৎ কী এমন দরকার পড়ল যে ঋণ নিয়ে অস্ত্র কিনে আমাদের সামরিক বাহিনীকে পাঠাতে হবে? এছাড়া, শান্তি মিশন থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে দেশের অন্যান্য উন্নয়ন খাতে ব্যবহার না করে জাতিসংঘের মিশনে দরকার নাই তবুও কেন সেখানে অস্ত্র ক্রয়ে ব্যবহার করতে হবে? আর জাতিসংঘ তো আমাদের সেনাদের রেপুটেশন নিয়ে যথেষ্ট সন্তুষ্ট, কাজেই আমাদের আগ বাড়িয়ে ঋণ করে সেনাদের আধুনিক অস্ত্র শস্ত্র কিনে দেয়ার তো কোনও প্রয়োজন নেই।

যে পণ্যের আমাদের অত্যাবশ্যকীয় কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই, সেই পণ্য ক্রয়ের জন্য কেন এই বিশাল অঙ্কের ঋণের ফাঁদে আমরা পড়ছি? যেখানে আমরা মাত্র কিছুদিন আগেই আইএমএফ থেকে ১০০ কোটি ডলারের ঋণ নিয়েছি উন্নয়নের কথা বলে। আইএমএফ-এর কঠিন শর্তের ঋণ নিয়ে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা না করেই আমাদের সরকার সে অর্থ বিভিন্ন খাতে ব্যয় করে ইতোমধ্যে আইএমএফ-এর কাছ থেকে তিরস্কৃত হয়েছে। সেই অর্থের দায় মাথায় আছে, আছে পুরনো অনেক ঋণ এর দায়, তার পরেও নতুন করে কেন এই বিশাল অঙ্কের ঋণ নেয়া হল রাশিয়া থেকে? রাশিয়া তাদের অস্ত্র বিক্রির জন্য পরমাণু বিদ্যুত্‍কেন্দ্র স্থাপনের লোভ দেখিয়ে যে এই বিপুল লোনের ফাঁস আমাদের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নাই।

একথা আমরা সবাই জানি যে, বর্তমার সরকার বিগত সময়ে বিমানবাহিনীর আধুনিকায়নের নামে এই রাশিয়া থেকেই মোট ১২৪ মিলিয়ন ডলার দিয়ে আটটি মিগ-২৯ বিমান কিনে যথেষ্ট বিতর্কের জন্ম দেয়। আবারও ক্ষমতায় এসে মেয়াদকালের এই শেষ সময়ে রাষ্ট্রীয় ঋণে অস্বচ্ছ চুক্তির আওতায় সমরাস্ত্র কিনে পরবর্তীতে যথেষ্ট বিতর্কের জন্ম দেবে বই কী! অচিরেই যোগ হবে অস্ত্র ক্রয় কেলেংকারী।

নির্বাচনের আগে কোনো রকম ভাবনা চিন্তা ছাড়াই এইসব আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এর ফল ভোগ করবে এদেশের খেটে খাওয়া জনগণ। কারণ সরকার আসে-যায়, একজনের ভুলের বোঝা অন্যের কাঁধে চাপিয়ে পাঁচ বছরের জন্য বিদায় নিয়ে তারা তামাশা দেখে, ক্ষমতায় আসা দল সেই ভুল না শুধরে নতুন উদ্যম নিয়ে আবার ভুল করে..এ যেন ভুলের দুষ্টচক্র! আর তার প্রভাব এসে পড়বে সেই দুষ্টচক্রের কেন্দ্রে থাকা খেটে খাওয়া সাধারণ জনগণের দৈনন্দিন জীবনে। জনস্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে শক্তিশালী মহাজনী দেশের সাথে অপ্রয়োজনীয় এইসব চুক্তি যে তাদের আধিপত্য বিস্তার করবে তা বলাই বাহুল্য। এইসব চুক্তির নাগপাশে আটকে রেখে একটি উন্নয়নশীল দেশের ব্যাহত উন্নয়ন হবে এবং বাংলাদেশের জনগণকে ভবিষ্যতেআরও কঠিন সংকট মোকাবিলা করতে হবে তা সহজেই অনুমেয়।

জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০১৩
আরআর; সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।