ঢাকা, রবিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

কি করি আজ ভেবে না পাই!

আবিদ রহমান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১৩
কি করি আজ ভেবে না পাই!

`জয় বাংলা` শব্দটি মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক ও চেতনার উৎসারণ। একটি স্লোগানে পুরো জাতির প্রাণের দাবির আন্তরিক প্রতিফলন।

আমাদের রাজনীতির স্বদেশ প্রেমী চিহ্নও বটে। যারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান কে ধারণ করেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের নিখাদ পক্ষশক্তি। বিরোধিতাকারীদের নিয়ত অন্যত্র সমর্পিত। যদিও স্বাধীনতার প্রকাশ্য ও সশস্ত্র বিরোধিতাকারী জামায়াত ও তাদের দোসররাও আজকাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে প্রকাশ্য। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কত রং-ঢং চলছে!

কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোন সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে বাদীপক্ষ হবেন? রাজনৈতিক বিভাজনে ক্ষমতাসীন হবার সম্ভাবনা ও ক্ষমতাসীন হতে পারা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একমাত্র আওয়ামী লীগই যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ও সক্রিয়। জাতির এই প্রাণের দাবির পক্ষে না-থাকলে আওয়ামী রাজনীতি একেবারেই মূল্যহীন।   মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রমাণিত করতে না পারলে আওয়ামী রাজনীতি মৃতবৎ। রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় আওয়ামীদের রেকর্ড এতো অনন্য ও উজ্জ্বল নয় যে, অন্য কোনো কারণে বাংগালী জাতি তাদের আরেকবার ভোটে জিতিয়ে ক্ষমতাসীন করবে। মূলতঃ যুদ্ধাপরাধের বিচার নিশ্চিতকরণ ও রাজাকার আল বদর সমর্থক রাজনৈতিক শক্তিকে পুনরায় ক্ষমতাসীন না দেখতে অনাগ্রহীরাই আওয়ামী লীগকে এবার নির্বাচনে জিতিয়ে এনেছিলেন। সঙ্গে ছিলো ১৫ আগস্টের কলংক মোচনের দাবিটিও। দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি কায়েমও ছিলো আরেকটি কারণ। মুক্তিযুদ্ধের চার মৌলিক আদর্শ থেকে আওয়ামী লীগ এরই মধ্যেই বহু দূরে অবস্হান নিয়েছে। ধর্ম নিরপেক্ষতার চেতনা থেকে আওয়ামী লীগ আজ রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট।

আওয়ামীরা ক্ষমতাসীন হবার পর দুর্নীতিতে ভেসেছেন বলে বিভিন্ন ঘটনা সাক্ষ্য দেয়। শেয়ারবাজার ও পদ্মাসেতুসহ বিভিন্ন কেলেংকারি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়ামী সদিচ্ছাকে(?) জিজ্ঞাসাবিদ্ধ করে। জাতির জনকের ঋণ বাঙালি কিছুটা হলেও পরিশোধ করতে পারে নায্য ও যর্থাথ বিচার ও রায়ের বাস্তবায়নে। এখনো জেলহত্যার বিচার বাকি।

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জাতি যখন এই বিচার নিয়ে তীব্রভাবে উজ্জ্বীবিত তখনই ঘাতক কাদের মোল্লার যাবজ্জ্বীবন সাজা ঘোষণা জাতির কাছে মালুম হয়েছে তীব্র বিশ্বাসঘাতকতা। জাতি একাত্তরের খুনীদের ফাঁসির কম কোনো সাজা প্রত্যাশা করে নি।

অনেকে বলতে পারেন আওয়ামী লীগ সরকার বাদী মাত্র। আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যালের রায়ে তাদের কোনো হাত নেই। প্রভাব নেই। যতদূর দেখা যায় তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন কোনো নেতার বিরুদ্ধে আইন ও আদালত যান না। সচরাচর কোনো বিরোধী নেতার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত কোনো মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় খারিজ হয় না। কোনো সাজা কমে না কিংবা মওকুফ হয় না। সরকার যাদের টার্গেট করেন রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে, তাদের জামিন বারবার না-মঞ্জুরের পাশাপশি রিমান্ড অতি দ্রুত মঞ্জুর হয়। সেকারণেই বিচার বিভাগের বিভিন্ন প্রক্রিয়া বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে।

আওয়ামী লীগ অন্য কিছু বুঝুক আর না-বুঝুক পাবলিক ডিমান্ড বোঝে। আওয়ামী সরকার যুদ্ধাপরাধী প্রশ্নে জনগণের আদি ও অকৃত্রিম মনোভাব সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল, তবু কেন এ রায়? ট্রাইবুন্যাল গঠনের আইনে (১৯৭৩ সালের আইনের সংশোধনীও) এতো ফাঁক-ফোঁকর কেন?

বেশ কিছুদিন ধরে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় ভিন্ন কিছু সন্দেহ হচ্ছিলো, শত হোক ঘরপোড়া গরু! অতীতে মৌলবাদীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার টালটামাল  অবস্থার মধ্যেই আওয়ামী লীগ মুফতি আমিনীর মতো মৌলবাদীকে জোটে টেনেছিল ভোটের রাজনীতিতে। এবারের ’ধরা যায় না ছোঁয়া যায় না’ ধরণের অতি সূক্ষ্ণ জামায়াতপ্রীতি বিভিন্ন জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়। জন্ম দেয়াটা কি অস্বাভাবিক?

কাদের মোল্লার অপরাধের শাস্তি নূন্যতম দুইশত বার ফাঁসি। তার মৃতদেহকেও শাস্তি দেয়া উচিত ফাঁসির পর। বাংলার মাটিতে তার লাশ দাফন নিষিদ্ধ করা উচিত কারণ শহীদের রক্তস্নাত পবিত্র মাটিতে এধরণের নরাধমের লাশ দাফন হতে পারে না। শহীদদের প্রতি নূন্যতম শ্রদ্ধাবোধে কাদের মোল্লার মৃতদেহ তার প্রিয়দেশ পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। বাংলার মাটিতে কাদের মোল্লার চিরনিদ্রা হতে পারে না। যাবজ্জীবন সাজার নামে কাদের মোল্লার এই শাস্তিহীন রায়ের বিরুদ্ধে পুরো বাংলাদেশ আজ ফুঁসে উঠেছে। শাহবাগ পরিণত হয়েছে প্রতিবাদী বাংলাদেশের প্রতীকে।

স্বতঃস্ফূর্ত এই এ-সমাবেশে সাধারণ মানুষ একাট্টা হয়েছেন। এই প্রতিবাদের কোনো আনুষ্ঠানিক নেতা নেই। কোনো আনুষ্ঠানিক সংগঠন এই প্রতিবাদের মালিকানা ও নেতৃত্ব দাবি করেনি। কিন্তু হাবভাবে মালুম হচ্ছে, খুব শিগগিরই এই প্রতিবাদ হাইজ্যাক হবে। ইতোমধ্যেই নেতাদের আগমন ও পৃষ্ঠপোষকতার ইংগিত পাওয়া যাচ্ছে। এতোদিন ব্লগাররা বিভিন্ন ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ ভুমিকা ও অবস্হান রেখেছিলেন। আগামী প্রজন্ম ও ব্লগাররা দেশে সুস্হ ও ঐক্যবদ্ধ ইতিবাচক রাজনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছিলেন। আশা করা হচ্ছিল, আগামীতে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির বাইরে রাজনীতিকে নিয়ে আসতে তারা ভূমিকা রাখবেন। বিষয়টি রাজনীতিকদের উদ্বেগ ও মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছিলো।

এই প্রতিবাদের ভবিষ্যৎ কি হতে পারে? সম্ভাব্য ফলাফল কিংবা ষড়যন্ত্র কল্পনা করে দেখতে পারি কী? ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনের দলীয় স্বার্থে জামায়াতীদের সাথে কোনো আঁতাত করে থাকে, তাহলে শাহবাগের এই প্রতিবাদী সমাবেশকে ছত্রভংগ করতে বাধ্য। কিন্তু কাজটা পুলিশ দিয়ে নিশ্চয় করা হবে না!

কাজটা করা হতে পারে, সাঈদীকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আদেশ দিয়ে। (আশংকা করি পরবর্তী সময়ে আপিলে সে রায় যাবজ্জীবনে রূপান্তরিত হবে। কিছুদিন পর ‘হৃদরোগে আক্রান্ত’ সাঈদীকে চিকিৎসার জন্যে বিদেশ পাঠানো হবে প্যারোলে। ) একই সংগে শাহবাগ আন্দোলন আওয়ামী সরকারকে জামায়াতের সাথে নেগোসিয়েশনে আপার হ্যান্ড দেবে (যদি কোনো আঁতাত আদৌ হয়ে থাকে)।

ট্রাইবুন্যালকে বিতর্কিত কিংবা জিজ্ঞাসাবিদ্ধ করা গেলে জামায়াতের আন্তর্জাতিক অপপ্রচারে লাভ হবে। পালে হাওয়া পাবে। মিসরের তাহরির স্কয়ারের স্বতস্ফূর্ত আন্দোলন সে দেশের জামায়াত মুসলিম ব্রাদারহুডের হাতে ছিনতাই হয়েছিলো নির্বাচনের ফলাফলে।   উত্তাল রাজপথ থেকেও রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা এখানেও জামায়াতের থাকবে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বাদীর ভূমিকায় থাকা ছাড়া আর কী কিছু করতে পারে? জানি না। সরকারে থাকার অনেক সীমাবদ্ধতা থাকে।   রাজপথের রাজনীতি আর রাষ্ট্র পরিচালনার রাজনীতি এক ও অভিন্ন নয়। প্রত্যাশা করি আওয়ামী সরকার ভোট ও জোটের রাজনীতির বাইরে ভূমিকা রাখবেন।

ইমেলঃ [email protected];
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।