ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আবিদ ভাই, প্রশ্নের উত্তরটা তাহলে পেয়েই গেলেন!

জিনিয়া জাহিদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৩
আবিদ ভাই, প্রশ্নের উত্তরটা তাহলে পেয়েই গেলেন!

মেলবোর্ন থেকে: বাংলানিউজে লেখালেখির সূত্রে সাংবাদিক আবিদ রহমান ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। শাহবাগের আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে আমরা যারা মেলবোর্নে আছি, তারা কোনো সমাবেশ আয়োজন করতে পারি কি না, তা নিয়ে কয়েকদিন আগেই মোবাইলে ওনার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করলাম।



আমরা প্রবাসে যারা আছি কীভাবে দেশের এই মহৎ উদ্যোগে শামিল হতে পারি, কী কী করা যেতে পারে, তা নিয়ে তিনি তাঁর বিশদ পরিকল্পনা আমাকে জানালেন। আরও কী করা যেতে পারে তা নিয়ে আমার কাছ থেকেও পরামর্শ জানতে চাইলেন।

মেলবোর্নে অবস্থান করা তাঁর প্রিয় ছোট ভাইয়েরা এবং জুনিয়র বন্ধুরা যে কত উদ্যমী আমাকে জানালেন। আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শিগগিরই অরাজনৈতিক একটি সমাবেশের আয়োজন করে আমাকে খবর দেবেন।

খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। একদিন পরই তিনি জানালেন কোথায়, কখন সমাবেশ হবে। ১০ তারিখে ইয়ারা নদীর পাশে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত সব প্রজন্মকে এক ছাতার নিচে আনা যায়! তিনি
দেখিয়ে দিলেন কীভাবে একটা মহৎ উদ্যোগ দেশের বাইরেও সফলভাবে করা যায়!

আবিদ ভাই, আপনাকে আমার সশ্রদ্ধ সালাম।

আবিদ ভাই, আসছে ২৩ ফেব্রুয়ারি মেলবোর্নে মহান একুশের অনুষ্ঠান উদযাপন করার কথা জানিয়ে আমাকে আপনি আমন্ত্রণ জানালেন। ঠিক কোন যায়গায় অনুষ্ঠান হবে আমার জানা না থাকায়, আপনি বললেন ড্যানডিডং এসে আপনাকে ফোন করতে। আপনি আমাকে ওখান
থেকে অনুষ্ঠান স্থলে নিয়ে যাবেন বলে জানালেন। আমি কিন্তু ঠিকই সেদিন যাব.. আবিদ ভাই, আপনি কি আসবেন আমাকে অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে?

আপনি খুব ভাল রান্না জানেন জানিয়ে আমাকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। ভাবি আর আপনার আদরের বরণ যে অতিথি দেখলে ভীষণ খুশি হয় জানিয়েছিলেন। ফোনে কথা বলার ফাঁকেই আপনি ইন্দোনেশিয়ান কী যেন একটা রান্না করছিলেন সেদিন....আর রান্নার মাঝেই সেদিন আপনি
বাংলানিউজের জন্য লিখেছিলেন, "কি করি আজ ভেবে না পাই!" শিরোনামের লেখাটি।

বাংলানিউজের ওই লেখাটিই আপনার শেষ লেখা ছিল কি না আমি জানি না। তবে লেখাটি লেখার সময় আপনি আমাকে জানিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে আজ অব্দি রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের অনেক অজানা ইতিহাস। যে ইতিহাস কেবল একজন নির্ভীক জ্ঞানগর্ভ সাংবাদিকের পক্ষেই জানা সম্ভব। আমি অবাক হয়েছিলাম অনেক তথ্য জেনে। কেন সেসব তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ হচ্ছে না জেনে প্রশ্ন করেছিলাম। আপনি আমাকে জানিয়েছিলেন, সত্য কোনোদিন চাপা থাকে নি,থাকবেও না।

আবিদ ভাই, আপনার সঙ্গে সেসব অজানা সত্যও চলে গেল আজ
বহুদূর।

আপনি আমার লেখা নিয়মিত পড়েন, এটা জানার পর আমি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম।
জানতে চেয়েছিলাম, কীভাবে আরও ভাল লিখতে পারি। আপনি বলেছিলেন ইতিহাস জানতে হবে সবার আগে। লেখার সময় কোনো কিছু খুব জটিল করে ভাবতে না করেছিলেন। কিন্তু ভালো লেখালেখি করার জন্য আপনার কাছে যে আমার আরও অনেক কিছু জানবার ছিল আবিদ ভাই!

আপনি আমাকে জানিয়েছিলেন যে, আপনি ভীষণ অসুস্থ। হার্টের মেজর অপারেশনের জন্য আপনি অপেক্ষা করছেন। হসপিটালে ডেট দিলেই যে কোনো দিন অপারেশন হবে। অথচ, সেদিন ভাবির কাছে শুনলাম যে, দু’বার অপারেশনের ডেট পেয়েও আপনি অপারেশন করতে রাজি হন নি! ভাবির কাছে এমনটি শুনে আমি কিন্তু একদম অবাক হয়ে যাই নি। কারণ, মৃত্যু নিয়ে আপনার ভাবনা আমি জেনেছিলাম।

আপনি জানিয়েছিলেন, যে কোনো দিন, যে কোনো সময়, যেকোনো মানুষ মরে যেতে পারে। জানিয়েছিলেন, মৃত্যুকে আপনি মোটেও ভয় পান না। আপনি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত।

আপনি আমাকে জানালেন যে, মৃত্যুর আগে আপনি কী চান এই প্রশ্নের উত্তর আপনার জানা নেই জন্যই নাকি আপনি এখনও বেঁচে আছেন!

হাসি মুখে নির্বিকারভাবে জানালেন, যেদিন এই প্রশ্নের উত্তর পাবেন, সেদিনই নাকি আপনি দুনিয়া ছেড়ে চলে যাবেন।

আবিদ ভাই, মৃত্যুর আগে কী আপনি দেখতে চেয়েছিলেন, কীভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে প্রবাসে জন্ম নেওয়া এই প্রজন্ম স্লোগান ধরছে? আপনি কী শুনতে চেয়েছিলেন, কদাচিত বাংলায় কথা বলা আপনার বরণ সেই সাথে বরণের মতো আরও অনেকেই নির্ভুল সুরে জাতীয় সঙ্গীত গাইছে?

আবিদ ভাই, ভাবি যখন আপনাকেখবর দিল, “দেখ তোমার ছেলে কী চমত্কার কথা লিখেছে গণস্বাক্ষরের ওই সাদা
কাপড়ে”.....আপনি দৌড় দিয়ে দেখে এলেন....আপনি কী দেখে যেতে চেয়েছিলেন আপনার বংশধর স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে চমত্কার ওই বাণী লিখবে? আপনি কী দেখে যেতে চেয়েছিলেন জাতীয় পতাকা হাতে আপনার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী হাসিমুখে রাজাকারবিরোধী সমাবেশে ছুটে বেড়াচ্ছেন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে?

আপনি কী দেখে যেতে চেয়েছিলেন দলমত নির্বিশেষে আমরা সবাই হাতে হাত রেখে মানববন্ধন করে শপথ নেব "রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ চাই......যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই"?

হ্যা, এখন আমি জানি মৃত্যুর আগে আপনি আপনার জীবনে কী দেখে যেতে চেয়েছিলেন। অজানা কোনো প্রশ্নের উত্তর আপনি জানতে চেয়েছিলেন, আজ জেনে গিয়েছি। সেই প্রশ্নের উত্তরটা পেয়ে গিয়েছিলেন জন্যই ওপারে যাওয়ার জন্য আপনি আর অপেক্ষা করেন নি, তাই না আবিদ ভাই?

জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৩
সম্পাদনা: আসিফ আজিজ, নিউজরুম এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।