ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

শাবিপ্রবি এবং আমাদের কিছু কথা

সুশান্ত দাস গুপ্ত, সৌরভ রায়, সুব্রত দাস, কামাল চৌধুরী, সুজয় সুব্রত, কল্লোল তালুকদার, তৌসিফ নূর, নিক্সন কান্তি পাল, মোঃ তানজীম শামস, অনুপমা দাস, হাবিবুর রহমান সালমান, মোহাইমিনুল হক পল্লব, পংকজ কুমার দাস ও সানী আব্দুল্লাহ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০১৩
শাবিপ্রবি এবং আমাদের কিছু কথা

১৯৮৭ সালের ফাগুনের আগুন ঝরা সকালে সিলেটের পূণ্যভূমিতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম। দেশের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠার ঊষালগ্ন থেকেই সেমিস্টার পদ্বতি চালু, গ্রেডিং পদ্ধতিতে ফলাফল, নতুন নতুন উদ্ভাবন, গবেষণা ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বর্তমানে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় দেশের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।



একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মোবাইল খুদে বার্তার মাধ্যমে এডমিশন টেস্টে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে বর্তমানে দেশের তথ্য প্রযুক্তি খাতে নতুন  নতুন কৌশল উদ্ভাবন এবং তার প্রায়োগিক সহজলভ্যতার কারণে শাবিপ্রবি আজ  বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় শাবিপ্রবি যেভাবে দেশের সবচেয়ে সৃজনশীল বিদ্যাপীঠে  উপনীত হয়েছে তার কৃতিত্ব এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, এলাকাবাসী সবার।

এই সাফল্যের পথ মোটেও সহজ ছিল না । শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের  অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সিলেটের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের ঐকন্তিক চেষ্টায় দীর্ঘ কণ্টকময় পথ পাড়ি  দিয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আজ একটা শক্ত অবস্থানে দাঁড় করিয়েছি ।

আমরা ঠিক মেলাতে পারছি না সমন্বিত পদ্বতিতে ভর্তি পরীক্ষা হলে সিলেট অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষা থেকে কিভাবে বঞ্চিত হবেন?  পাশাপাশি এই পদ্বতিতে পরীক্ষা হলে কিভাবে শিক্ষার সুযোগ সংকোচনের সম্ভাবনা আছে তাও  আমাদের বোধগম্য নয়।

প্রচলিত পদ্ধতিতে কোন আবেদনকারীকে আবেদনকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীরে গিয়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়। এতে যাতায়াত খরচ থেকে শুরু করে সব ধরনের ভোগান্তি ছাত্র-ছাত্রীসহ তাদের অভিভাবকদের পোহাতে হয়। ফলে আর্থিক কারণে ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের তাদের পছন্দের তালিকা থেকে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কে বাদ দিতে হয়।

তাছাড়া একই দিনে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ায় অনেক ছাত্রছাত্রী ইচ্ছা থাকা সত্বেও সব পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে না, যার ফলে তার উচ্চশিক্ষার পথ সংকুচিত হবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়া হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যাতে একই প্রশ্নপত্রে একটি পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের নিকটবর্তী কেন্দ্রে বসে ছাত্রছাত্রীরা তাদের আবেদনকৃত একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবে।

এতে করে ভর্তির জন্য যে আর্থিক, মানসিক ও শারীরিক ভোগান্তি পোহাতে হয়, সেটা অনেকাংশে কমানো সম্ভব হবে। এটা ছাত্রছাত্রীদের জন্য অধিক সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে। যেমন- এ প্রক্রিয়াটি সফল হলে সিলেট বিভাগের একজন ছাত্র কিংবা ছাত্রী সিলেটে বসেই বাংলাদেশের যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাবে।

আর একটা ব্যাপার আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে যে, অনেকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা  এবং গুচ্ছ পদ্বতিতে পরীক্ষাকে এক বলে মনে করছেন।

তাদেরকে আশ্বস্ত করে বলছি যে, গুচ্ছ পদ্বতিতে পরীক্ষা হয় মেডিকেলে সেখানে একটা সম্মিলিত মেধা তালিকা তৈরি করা হয়, কিন্তু সমন্বিত পদ্বতিতে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনকারীদের মধ্যে আলাদা আলাদা মেধা তালিকা তৈরি করা হবে এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ নিয়ম অনুযায়ী ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।

কাজেই এ  পদ্ধতির কারণে কোন শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে বঞ্চিত হবার কোন প্রশ্নই আসে না। মেধার ভিত্তিতে আগে যেভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি হত, সমন্বিত  পদ্ধতিতেও শিক্ষার্থীরা একই নিয়মে ভর্তি হতে পারবে।

কিন্তু আমরা অতীব দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি, এই সুন্দর এবং সময়োপযোগী উদ্যোগ আমাদের সুধীজনদের অনেকেই অনুধাবন করতে পারেননিফলে শাবিপ্রবি ও সাধারণ সিলেটবাসির মধ্যে একটা ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে  যা খুবই হতাশাজনক।

সিলেটের সম্মানিত সুধীজনদের কাছে আমাদের আন্তরিক অনুরোধ, আমাদের কথা একবার শুনুন, আমাদেরকে ডাকুন, কোন প্রশ্ন থাকলে আমাদের জিজ্ঞেস করুন। আমরা আপনাদেরই সন্তান, আমরা আমাদের মেধা দিয়েই নিজের জায়গা করে নিয়েছি এবং আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি আমাদের অনুজরাও কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজের যোগ্যতা দিয়ে ইতিহাসের পাতায় তাদের নাম লেখাবে। সিলেটের শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের মেধার সাক্ষর রেখেছেন  এবং আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি সিলেটের শিক্ষার্থীদের কোন অনুগ্রহের প্রয়োজন নেই।

আমরা দৃঢ় কণ্ঠে সবাইকে বলতে চাই, এই সমন্বিত পরীক্ষা পদ্বতির ফলে কারও কোন ন্যূনতম ক্ষতি হবার কোন সম্ভাবনা নেই। এই অনাহুত পরিস্থিতির কারণে আমরা প্রাক্তণ শিক্ষার্থীরা বিব্রত।

আমরা আমাদের দীর্ঘ শিক্ষাজীবনে শাবিপ্রবিতে সিলেটী হবার কারণে কোন বঞ্চনার শিকার হই নি এবং আমরা যদি দেখি কোন কারণে সিলেটীদের বঞ্চিত হবার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে তাহলে সর্বপ্রথম আমরাই এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবো।

শাবিপ্রবি এবং যবিপ্রবি’র সমন্বিত ভর্তি কার্যক্রম সম্পর্কে দ্বিমত জানিয়ে ‘সচেতন সিলেটবাসী’ নামক সংগঠন ভর্তি প্রক্রিয়া বন্ধ করার যে আন্দোলন করছে, আমরা মনে করি তা ভুল বুঝাবুঝির ফল এবং সারাদেশের কাছে সিলেটবাসীর সম্মান এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে জানা  যায়, ‘সচেতন সিলেটবাসী’ নামের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেটীদের জন্য কোটা দাবি করেছেন, যদিও আমরা বিশ্বাস করি এমন অযৌক্তিক দাবি সিলেটের সাধারণ জণগণ করতে পারেন না। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এ ধরনের অবাস্তব দাবি তোলা আক্ষরিক অর্থেই  সিলেটবাসীল শতবর্ষের লালিত গৌরবোজ্বল অতীতের গায়ে কালিমা লেপন করার নামান্তর। মনে রাখতে হবে, ব্রিটিশ- পাকিস্তান আমলে সিলেটিদের আলাদা একটা অবস্থান ছিল শিক্ষা-দীক্ষায়, মাঝে তাতে ভাটা পড়ে গিয়েছিল, এখন তা আবার শুরু হয়েছে, এটাকে কোনভাবেই নষ্ট হতে দেয়া যাবে না।

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মত একটি প্রতিষ্ঠানে বিশেষ কোটার মাধ্যমে নয়, বরং সামগ্রিক শিক্ষাক্ষেত্রে এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের সাফল্যের দ্বার উন্মুক্ত করা সম্ভব।

আমরা শাবিপ্রবির সিলেট অঞ্চলের প্রাক্তণ শিক্ষার্থীরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমরা কোন কোটা পদ্ধতির পক্ষে নই।

আমরা আশা করব, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উদ্ভূত পরিস্থিতে সমন্বিত  পদ্ধতির উপকারিতা এবং তার খুঁটিনাটিসহ সামগ্রিক তথ্য সিলেটের অধিবাসীদের মাঝে জানানোর ব্যবস্থা করবেন।

একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার ব্যাপারেও আমাদের আপত্তি আছে। যারা এ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন এবং যারা এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন, তারাই জানেন কোন পথে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গল আসবে।

কিন্তু আমারা অবাক  হয়ে লক্ষ্য করলাম, উদ্যোগের ভালোমন্দ বিবেচনায় না এনে এবং যথেষ্ট সময় নিয়ে পর্যালোচনা না করেই সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে এবং এর পরে বুধবার জরুরি বৈঠকে ৩০ নভেম্বর এর ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত করা হয় এবং এ ব্যাপারে পরবর্তীতে সংশ্লষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্বান্ত নেয়া হবে বলে জানানো হয়।

কিন্তু ওইদিন রাতেই সচেতন সিলেটবাসির পক্ষ থেকে, সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের  জন্য ৩ দিনের আল্টিমেটাম দেওয়াসহ ভর্তি পরীক্ষার  আগের দিন সিলেটে অবরোধ ও পরীক্ষার দিন হরতাল ডাকার হুমকি দেওয়া হয়- যা খুবই উদ্বেগজনক।

প্রিয় সিলেটবাসী, আপনাদের কাছে অনুরোধ আপনারা আমাদের উপর ভরসা রাখুন, কোন প্রশ্ন থাকলে আমাদের জিজ্ঞেস করুন।   আমরা আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই অতীতে শাবিপ্রবিতে সিলেট অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা যেমন বঞ্চিত হয়নি, ভবিষ্যতেও যেন বঞ্চনার শিকার না হয় সেদিকে আমরা সতর্ক দৃষ্টি রাখবো। আমরা আপনাদের সন্তান, এতটুকু দাবিতো আপনাদের কাছে আমরা করতেই পারি, তাই না?

লেখকগণ বৃহত্তর সিলেটের অধিবাসী, শাবিপ্রবির শিক্ষক ও প্রাক্তণ শিক্ষার্থী

বাংলাদেশ সময়: ১৯১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।