মনে আছে নিশ্চয়ই ৯/১১ এর কথা? বিমান এসে আঘাত করলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারের একটিতে। পুরো পৃথিবীর মানুষ যখন টেলিভিশনের পর্দায় এ খবর দেখছিলো ঠিক সে সময়ে আরেকটি বিমান এসে আঘাত করে টুইন টাওয়ারের অন্য ভবনে।
এই ওসামা বিন লাদেনকেই ওই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী বলা হয় এবং সর্বশেষ আমরা দেখতে পাই, পাকিস্তানের এক ছোট শহরে মার্কিন বাহিনী ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। আর এ অপারেশনের পুরো দৃশ্যটিই আমেরিকায় বসে দেখেন দেশটির প্রেসিডেন্টসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কথা মনে পড়ে গেলো। উপসাগরীয় যুদ্ধে সাদ্দাম বাহিনীর পতনের পর তাঁর সব কর্মকাণ্ডের বিচার শুরু হয় সে দেশটিতে এবং সেই সময়টিতে মার্কিন সৈন্য অবস্থান করছিলো ইরাকে। বিচারে সাদ্দামের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং সেটি কার্যকর করা হয়। ওসামা বিন লাদেন কিংবা সাদ্দামের পরিণতি হয়েছিলো মৃত্যু।
আমাদের এই মাতৃভূমিতে ওসামা বিন লাদেন কিংবা সাদ্দাম হোসেনের চেয়েও ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী রয়েছে। যারা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে ১৯৭১ সালে হত্যার হোলি খেলায় মেতে উঠেছিলো। স্বাধীনতার জন্য আমাদের কম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত ও লক্ষ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা।
এই স্বাধীন দেশে ১৯৭১ সালে যারা হত্যা যজ্ঞে মেতে উঠেছিলো, সেই রাজাকারদের বিচার হয়নি গত ৪২ বছরে। এবার যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হয় তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মসহ বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই আশায় বুক বেঁধেছিল, এই বার যদি বিচার হয়!
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু করে। অনেক দীর্ঘ সময়, নানান ঘাত প্রতিঘাত ও আন্দোলনের পর যখন ফাঁসির দণ্ড প্রাপ্ত আসামি কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার কথা সবাই জানতে পারলো, তখন অনেকের মাঝেই একটি দায় মুক্তির অনুভূতি বয়ে যেতে শুরু করে। অনেকেই ভাবতে শুরু করে, এবার হয়তো নতুন একটি সূর্য উঠবে, যেখানে একটি জাতি ৪২ বছরের দায় থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত হবে।
এই যখন অবস্থা, রায় কার্যকর করার ঘণ্টা দেড়েক আগে জানা গেলো, সুপ্রিম কোর্টের একজন চেম্বার জজের আবেদনের প্রেক্ষিতে কাদের মোল্লার রায় কার্যকর বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে।
এর মাঝেই আবার একটি খবর পেলাম, যেখানে বলা হচ্ছে- জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে বলেছেন, ‘জাতিসংঘ যে কোনো মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে, সেটা যে পরিস্থিতিতে হোক না কেন, এমনকি সবচেয়ে জঘন্য অপরাধের ক্ষেত্রে হলেও। ’
রক্তক্ষয়ী একটি যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে এই দেশটি স্বাধীন হয়েছে। এটি একটি স্বাধীন দেশ। আমাদের নিজস্ব সংবিধান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে আমাদের সার্বভৌমত্ব। আমাদের দেশের আইনে মৃত্যু দণ্ড রয়েছে। যেহেতু দেশের আইনে মৃত্যুদণ্ড রয়েছে, সেখানে অন্য কোন সংস্থা বা দেশের কেউ এসে আমাদের দেশের বিষয় নিয়ে নাক গলানোর সুযোগ কতটুকু রাখেন তা বিবেচনার বিষয়। এখন যদি জাতিসংঘ বলে বসে, আমাদের দেশের আইন থেকে মৃত্যু দণ্ড উঠিয়ে নেয়া হোক, তাহলে আমরা কি সেটা করবো?
তাছাড়া এতো যে মানবতার দোহাই দেয়া হয়, মানবতার ঝাণ্ডাধারী খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যখন ওসামা বিন লাদেনকে মেরে ফেলার দৃশ্য দেখছিলেন তখন তো কোন প্রশ্ন উঠতে দেখিনি। সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুদণ্ড যখন কার্যকর করা হলো তখন এসব মানবাধিকার সংস্থা কি ঘুমিয়ে ছিলো?
একটি পরিবারের গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাইছি। ৪২ বছর ধরে এই পরিবারটি দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ফুপু সবার মৃত্যু দিবস একই দিন পালন করে আসছে। ওই পরিবারের ছেলেটি শুধু বেঁচে ছিলো, কারণ সে যুদ্ধে গিয়েছিলো। সেই ছেলেও বৃদ্ধ হয়েছে। এইতো কিছুদিন আগেও সে তার তরুণ ছেলেকে জিজ্ঞেস করছিলো, এতো মানুষ মেরে ফেললো আর এদের কারও বিচার হবে না? দেখে কি যেতে পারবো না? তার সেই তরুণ ছেলে সেদিন লজ্জায় মাথা নত করে ছিলো। ফের যখন সুযোগ এলো মাথা তুলে দাঁড়াবার, তখন আবার নত হতে হয়েছে তরুণটিকে। তবে তরুণটি জানে সে একদিন ঠিকই মাথা উঁচু করে বলবে বাবা আমরা পেরেছি, কিছুটা হলেও দায় মুক্ত হতে পেরেছি।
আমিনুল ইসলাম: শিক্ষক, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ০৯০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৩
সম্পাদনা: জাকারিয়া মন্ডল, আউটপুট এডিটর