ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

পাকি সম্পর্ক ছিন্ন করা কোনো সমাধান নয়

ড.জিনিয়া জাহিদ, কনট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৩
পাকি সম্পর্ক ছিন্ন করা কোনো সমাধান নয় ইমরান খানের কুশপুতুল দাহ

যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা নিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বিবৃতি ও পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে আনা নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপিত হবার প্রতিবাদে বাংলাদেশে সমালোচনার ঝড় বইছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে পাকিস্তান তাদের নোংরা নাক গলিয়ে অবশ্যই কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ করেছে।



এর প্রতিবাদে আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিকরা প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠব, তা অত্যন্ত স্বাভাবিক ও যৌক্তিক। পত্র-পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, এমনকি রাজপথেও কুশপুতুল জ্বালিয়ে আমাদের প্রতিবাদ আমরা জানিয়েছি।
 
কিন্তু কূটনৈতিক সমস্যার সমাধান কূটনৈতিকভাবে হওযাই শ্রেয়। আমাদের সরকার কূটনৈতিকভাবে এই নিন্দনীয় আচরণের বিরুদ্ধে কড়া ও জোরালো ভাষায় যথাযথ প্রতিবাদ জানিয়েছে।

ইতোমধ্যেই ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার মিয়া আফরাসিয়াব মেহেদী হাশমি কুরেশিকে জরুরি কৈফিয়তের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়েছিল। হাশমি কুরেশি তাদের রাজনৈতিক নেতাদের এই ঘৃণ্য আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে কি বলেছিলেন আমরা জানি না। আমাদের চার পাতার চিঠির জবাবে পাকিস্তান সরকারের জবাবও এখনো আমাদের জানা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আমাদের সরকার তড়িৎগতিতে যেভাবে এই আচরণের কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে তা সত্যি প্রশংসনীয়।

পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত আমরাই আগে বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। একটু পিছনের দিকে তাকাই।

২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ এ সাংবাদিক ওয়াল্টার শুয়ার্টজ এর লাহোর থেকে করা রিপোর্ট দি অবজার্ভারে প্রকাশিত হয়। যার শিরোনাম ছিল "Kisses seal the Mujib deal"। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যখন বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে প্রথম পাকিস্তান সফরে গিয়েছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে বাংলার পাঁচের মত মুখ করে থাকা অসুখী ভুট্টোর দিকে বন্ধুত্বের হাত প্রথম বঙ্গবন্ধু বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। জড়িয়ে ধরে বন্ধুত্বের চুম্বন দিয়ে শত্রুতার মুখে সীলমোহর এঁকে দিয়েছিলেন তিনি। শত্রুর সঙ্গেও বন্ধুত্বের নজির স্থাপন করেছিলেন তিনি।

সেদিনের বন্ধুত্বের সেই হাত আস্তে আস্তে বিভিন্নভাবে প্রসারিত হয়েছে। সন্দেহ নেই, আমরা পাকিদের সঙ্গে আমাদের তিক্ত সম্পর্ক হৃদয়ের ভেতর পুষে রেখেই ৪২ বছর ধরে সুসম্পর্কের ভান করে গেছি।

কিন্তু কূটনৈতিক সম্পর্কের ধরনটাই আসলে এরকম হয়। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের সঙ্গে আমাদের যতই সুসম্পর্কের কথা কাগজ-কলমে থাকুক না কেন, ওদের দাদাগিরিকে আমরা চরমভাবে ঘৃণা করি। ইন্দো-চীন, ইন্দো-মার্কিন এরকম প্রায় সব দেশের সঙ্গেই সবার সম্পর্ক উপরে উপরে ভালো। কারণ, বিশ্বায়নের এই যুগে সম্পর্ক ভালো রাখতে হয়। ঝগড়া-কাজিয়া করে সামনে এগিয়ে যাওয়া মুশকিল হয়ে ওঠে।

কোনো দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের মানে হলো অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক-কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন। নিজের স্বার্থ সবার আগে দেখতে হবে। তেতো মুখ করে হলেও নিজেদের স্বার্থেই সম্পর্ক ভালো রাখতে হবে।

আমরা আবেগী জাতি এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আবেগের বশে আমরা অনেক কিছুই করে বসি। ঠিক যেমন এখন আমরা আবেগের বসেই পাকিস্তানের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি করছি। আমরা বাংলাদেশে অবস্থিত পাক দূতাবাস ঘেরাও করছি। দূতাবাসের সব কার্যক্রম গুটিয়ে তাদের বিদায় করে দেবার দাবি তুলছি।

গণজাগরণমঞ্চ থেকে পাকিস্তান হাইকমিশন ঘেরাও কর্মসূচি কি আমাদের অতি আবেগের বহিঃপ্রকাশ নয়? কাদেরের ফাঁসির বিরোধিতা করায় আমরা কি এখন জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য সবার সঙ্গেই এখন সম্পর্ক ছিন্ন করব? কূটনৈতিক পাড়ায় এভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে আমরা আসলে কি প্রমাণ করতে চাইছি?
 
বিশ্বায়নের যুগে কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা কোনো সমস্যার সমাধান হতে পারে না। সব কথার শেষ কথা হলো, পাকিস্তানকে শিক্ষা দেবার দায়িত্বটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই নিতে দিই না কেন? এগিয়ে দেয়া হাত গুটিয়ে নয়, নিজের আত্মসম্মানবোধ যথাস্থানে সমুন্নত রেখেই পাকিস্তানকে তাদের কৃতকর্মের জন্য আমরা ক্ষমা চাইতে বাধ্য করতে পারি।

ড. জিনিয়া জাহিদ: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও গবেষক

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।