ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

স্বদেশ, মাফিয়া ও আসন্ন নববর্ষ

অজয় দাশগুপ্ত, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৩
স্বদেশ, মাফিয়া ও আসন্ন নববর্ষ

‘মাফিয়াচক্র’ শব্দবন্ধটির সাথে পরিচয় থাকলেও সম্যক ধারণা নেই আমাদের। ভাসা ভাসা জানার যুগে অনেক কিছুই আধো জানা থেকে যায়।

ইতালি বললেই ‘মাফিয়া’ বুঝি  আর ‘মাফিয়া’ বললেই বুঝি সন্ত্রাস।

কিন্তু বুঝি না যুগের পরিবর্তনে মাফিয়ার চরিত্রেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আগের মত রাজনীতি বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধ নেই এই চক্র। জীবনের সব অনুষঙ্গে তার প্রবেশ ও আধিপত্য। তার নিয়ন্ত্রণে সমাজ। তার অধীনে দেশ। আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ যে তারুণ্য তাকেও ছাড় দেয় না মাফিয়া। আর ক`দিন পর আমরা নতুন এক বছরে প্রবেশ করব। যে যা-ই বলুক, ইংরেজরাই পৃথিবীর ইতিহাস ও শাসন বদলে দেয়ার কাজ করেছে।  

আদিকাল থেকে সাম্রাজ্যবিস্তারের চেষ্টায় ব্যস্ত আধিপত্যকামী জাতিগুলোর ভেতর এরাই ছিল সবচেয়ে কৌশলী আর চতুর। বাদবাকিরা আধিপত্য শেষ হবার পর ইতিহাস বা অতীত হয়ে আছে। ইংরেজ আছে ছায়ার মত। পৃথিবীর যেকোনো দেশের বিমানবন্দরে নেমেই টের পাই ইংরেজি সাইন না থাকা বা না দেখা অব্দি আমরা কতটা অসহায়। এটা কেবল ইংরেজ উপনিবেশ বলে নয়।

নেদারল্যান্ডসের এক তরুণী তার বিশুদ্ধ উচ্চারণের ইংরেজিতে চমকে দেবার পর প্রশ্ন করেছিলাম: "এতো ভালো ইংরেজি জানা বা শেখার কারণ কি?" তার উত্তর: আজকের দুনিয়ায় ঝাঁ-চকচকে স্মার্ট হতে হলে এর কোনো বিকল্প নেই। ইংরেজি নববর্ষ তেমনই এক উৎসব। যাকে ঘিরে দুনিয়া জেগে ওঠে। দেশে-দেশে শুরু হয়ে যায় আনন্দ উৎসবের প্রস্তুতি।

বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। আমাদের তারুণ্য এ নিয়ে মেতে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আর সব বিষয়ের মতো আমরা এ বিষয়েও মাত্রাহীন। জীবনে স্বাভাবিক আনন্দের পরিবর্তে অস্বাভাবিক উত্তেজনাই যেন প্রিয় ও কাঙ্ক্ষিত। তারুণ্যকে বল্গাহীন করার পেছনে যে মাফিয়া, তাকে খুঁজে বের না করে আমরা এদের দোষারোপ করতে পারলেই বর্তে যাই। অথচ এই যে থার্টি ফার্স্ট নাইটের উত্তেজনা বা নেশাগ্রস্ত করে মাতাল করে দেয়ার প্রবণতা তার পেছনে আছে অবৈধ অর্থ সামাজিক তস্করদের প্ররোচণা আর কালো বাণিজ্যের হাতছানি। প্রতিবেশী দেশের সস্তা ফেনসিডিল আর গাঁজার অবদানও কম নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা সব জানি সব বুঝি। কিন্তু ঠেকাবে কে?

যাদের ঠেকানোর  কথা তারা কি করছেন? নেতা বা সমাজ-পুরোধাদের আমরা কি করতে দেখছি? নেতারা তো বরবাদের শেষ সীমায়। সারা দিনরাত দোষারোপ আর একে অপরের মণ্ডুপাত করা ছাড়া তাদের কোনো কাজ নেই। তাদের না আছে সামনে যাবার ইচ্ছে, না আছে তারুণ্যকে জাগানোর দায়বোধ। তারা নিজেরাই এক একটি মাফিয়া। মিডিয়ায় নেতাদের সম্পত্তি নিয়ে প্রতিবেদন বেরুনোর পর যতো বড় কথাই তারা বলুক না কেন বাস্তবে রাজনীতি এখন বড় ব্যবসা। ব্যবসা বা লাভজনক না হলে গাঁও-গেরামের প্রার্থীরা হেলিকপ্টার চড়ে নির্বাচনী প্রচারে নামতে পারতেন না। তাই তাদের কাছে আশা করাটাও বাতুলতা। আমার বিস্ময় ও রাগের জায়গাটা সুশীল নামধারী বুদ্ধিজীবীদের ওপর। এরা ইদানীং এমনসব কাণ্ড করছেন যাতে এটা বিশ্বাস করতেই হবে, টাকা পয়সাসহ নানা জাতীয় প্রলোভনে এরাও এখন মাফিয়ার নিয়ন্ত্রণে।

কোনো রকম প্রস্ত্ততি ছাড়া পড়াশুনা ছাড়া হাসিনা-খালেদা বা এরশাদ বিষয়ক কথা বলা আর সংবিধান বা র্যাব-পুলিশ ও সমাজ বিষয়ে নিজের মত জাহিরের নাম বুদ্ধিবৃত্তি নয়। জেনেও আজ তারা এপথের পথিক; সমাজের নিম্নগামী প্রবাহে ভেসে যাওয়া মানুষের সাথে পাল্লাদিয়ে নীচে নামতে থাকা এদের দিকে তাকলে করুণা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। আমাদের সামনে যে দু:সময় তারুণ্যের ভেতর যে হতাশা বা অস্হিরতা তা নিয়ে বিন্দুমাত্র বিচলিত নন এরা।   বুদ্ধিজীবীদের এই ভূমিকা প্রমাণ করে আমাদের সমাজ একদিকে যেমন দেউলিয়া হবার পথে, আরেক প্রান্তে মাফিয়াই তার নিয়ন্ত্রক। মিডিয়াকেও দায়িত্বহীন ভূমিকায় দেখতে পাচ্ছি আমরা।

বলছিলাম নববর্ষের কথা। দুনিয়াজুড়ে যখন মানুষ নববর্ষ উদযাপনের প্রস্ত্ততি নিচ্ছে, আতশবাজি আলোর ফোয়ারা আর বিনোদনে জেগে ওঠার জন্য তৈরি হচ্ছে, তখন আমাদের দেশ মহাবিপদের দ্বারপ্রান্তে। রাজনীতির নামে লড়াইরত দু’দলের কেউই নববর্ষ মানে না। আনন্দ মানে না। তাদের হাতে রয়েছে পাওয়ার—হয় বোমা, নয়তো হরতাল বা ককটেল। এখন নতুন যোগ হয়েছে ‘জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া’। এই আগুনের রেশ কতদূর যাবে বলা মুশকিল। তবে সদ্যপ্রয়াত ম্যান্ডেলার একটা কথা স্মরণ করতে চাই: ‘ নিজের লোকদের সাথে লড়াই করো না। তার রেশ হয় দীর্ঘস্থায়ী। ’ রাজনীতি কিভাবে তার জঞ্জাল সাফ করবে সেটা সাধারণ মানুষের ভাবনা নয়। অথচ এদের জিম্মি রেখেই তারা খেলছেন।

নব আনন্দে জীবনের নতুন আগুনে জেগে ওঠার পরিবর্তে আমাদের তারুণ্যের সামনে এখন হিংসার আগুন। দেশ জ্বলছে সমাজ জ্বলছে; পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে আগামী। এই দুর্যোগ বা বিপদ সামনে রেখে নববর্ষের আনন্দ মানায় না। অথচ এদেশের কোটি কোটি মানুষ আনন্দপ্রবণ। সারাবছরের জ্বালা-যন্ত্রণা আর দু:খ ভুলে তারা সামনে যাবার জন্য প্রস্তুত। কোনো নেতৃত্ব যদি ব্যর্থ হয় বা পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারে বা  যুগোপযোগী না হয় কিংবা অচল  হয়ে পড়ে, তবে তার নিজেরই সরে দাঁড়ানো উচিত। তা না হলে কি হয় বা হতে পারে সেটা তো সময়ই বলে দেয়। বারংবার জানান দিয়ে যায়।

আমাদের দেশের সামনে দাঁড়ানো নববর্ষটি কি আবারো মাফিয়ার কবলে পড়ে আতঙ্ক আর ভয়াবহতায় কুঁকড়ে থাকবে নাকি নতুন দিনের কথা বলবে? আমাদের জন্য এটা জানা জরুরি।

অজয় দাশগুপ্ত: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৩
সম্পাদনা: খুররম জামান, ডিপ্লোম্যাটিক অ্যাফেয়ার্স এডিটর/জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।