যে দেশের আইনে (৩৭৭ ধারায়) বলা হয়েছে প্রকৃতি বিরুদ্ধ যৌন কার্যকলাপের শাস্তি যাবজ্জীবন অথবা ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং যে দেশে অধিকাংশ মানুষ মুসলিম; সে দেশে সমকামীদের কণ্ঠ ‘রূপবান’ নামে একটি পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করেছে। যার স্লোগান হচ্ছে, ‘ভালোবাসতে দাও মোরে’।
উক্ত পত্রিকাটির সাথে সংশ্লিষ্টরা প্রত্যাশা করেছেন, তাদের প্রকাশিত লেখা সমকামীদের প্রতি অন্যদের সহানুভূতিশীল করবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে কাজ করা আইনত অপরাধ এবং ধর্ম মতেও নিষিদ্ধ, সেই কাজের প্রচার করা অপরাধ কি না? হাল-আমলে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে কে কত বেশি ধর্মবান্ধব (ইসলাম), সেই প্রতিযোগিতা করছে। সেখানে শীতল হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক আবহাওয়ায় ‘রূপবান এবং সমকামীতা’ নতুন কোনো ধর্মীয় উন্মাদনার দাবানল সৃষ্টি করবে কি না দেখার আছে।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সমকামীদের পত্রিকা ‘রূপবান’ প্রকাশের খবরটি আসার পরপরই এখন তা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ঝড় তুলেছে। এ বিষয়ে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম গ্রন্থ ‘সমকামিতা’র লেখক অভিজিৎ রায় তার ফেসবুক ওয়ালে ‘রূপবান’ পত্রিকা প্রকাশের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন নিম্নোক্ত ভাষায়-
[সমকামিতা এবং রূপান্তরকামিতা সংখ্যালঘু যৌনপ্রবৃত্তির অংশ। উইকিপিডিয়ার হিসেব মতে সারা পৃথিবীতে এবং সেই সাথে প্রতিটি দেশেই গড়পড়তা দশ ভাগের মতো এলজিবিটি (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল ও ট্রান্সজেন্ডার) সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে। সে হিসেবে বাংলাদেশে ৬ থেকে ১২ মিলিয়ন মানুষ এই ধরণের সমান্তরাল যৌনসম্প্রদায়ের অংশ হবার কথা। অথচ দেশে তাদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়। যা-ও বা দু’একটি কেস এখানে ওখানে উঠে আসে, সেটাকে খুব কঠোর হাতেই দমন করা হয়। এ ধরণের কোন নিউজ প্রকাশিত হলেই দেখা যায় ধর্মীয় ধ্বজাধারী আর নীতি নৈতিকতার ধারক এবং বাহক সংখ্যাগরিষ্ঠ ষাঁড়দের কুৎসিত কুৎসিত মন্তব্যে ভরে গিয়েছে পেইজ।
দেশের প্রধান প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলো কিংবা সচেতন বুদ্ধিজীবী সমাজ নারী অধিকার, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কিংবা বড়জোর পাহাড়ি কিংবা আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়ে আজ কিছুটা সচেতনতা দেখালেও তারা এখনো যৌনতার স্বাধীনতা কিংবা সমকামীদের অধিকার নিয়ে একদমই ভাবিত নয়। প্রকাশ্যে কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকেও দেখা যায় না ইস্যুটি নিয়ে কাজ করতে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে তাদের জন্য এ ধরনের আন্দোলন বা সচেতনতা তৈরির প্রয়াস নেয়া যে কষ্টসাধ্য, তা সহজেই অনুমেয়।
আমি আনন্দিত যে, দেশের সমকামীদের একাংশ সাহস করে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছেন, তাদের ব্যথা বেদনা, কষ্ট এবং অধিকারের কথা বলার জন্য। পত্রিকাটির নাম তারা রেখেছেন ‘রূপবান’। তারা আশা প্রকাশ করছে যে, পত্রিকাটিতে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে, তা মানুষের মধ্যে সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে সক্ষম হবে। এটা দরকার ছিল। বাংলাদেশি এলজিবিটি গ্রুপ তাদের ‘হিডেন মাইনরিটির’ গরাদ ভেঙে সামনে বেরিয়ে এসেছেন, এটা নিঃসন্দেহে বড় অর্জন। আমি তাদের এই সাহসী পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই। ]
তার ফেসবুক ওয়ালে বিরুদ্ধবাদীরা নিন্দামূলক মন্তব্য করছেন। তিনি বৈজ্ঞানিক তথ্য, প্রমাণাদি দিয়ে যথাসম্ভব উত্তর দিচ্ছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশে এতদিন হিজড়াদের কোনো পরিচয় ছিল না। পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে তাদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা এখনো নেই। জন্মদাত্রী মা-ও তাদের ত্যাগ করেন। বছর কয়েক আগে হিজড়াদের জীবন কাহিনীকে উপজীব্য করে নির্মিত ‘কমন জেন্ডার’ নামক একটি সিনেমা আমাদের বিবেককে জোরালোভাবে নাড়া দিয়েছে। বাংলাদেশের আদম-হাওয়া শুমারিতে কোনো হিজড়া নেই। তার মানে কি? তারা গাবতলী হাটের মহিষের মতো গরুর নামে বিক্রি হয়েছে। তারা আমাদের মাঝেই ছিল। কিন্তু আমরা অস্বীকার করেছি। কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সরকারের সুমতি হয়েছে, হিজড়াদের আইনগত স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
অভিজিৎ রায়ের মতে, বাংলাদেশে সমকামীর সংখ্যা ৬০ লাখ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ। বিভিন্নভাবে তার কথার সত্যতা মেলে। আমাদের শিল্প-সাহিত্যেও এর নজির আছে। তারেক মাসুদ এর সিনেমা ‘মাটির ময়না’ তে মাদ্রাসার অন্দরের সমকামিতা উঠে এসেছে। হুমায়ূন আহমেদের ছবি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’তেও সমকামিতা দেখানো হয়।
নীতি-নৈতিকতা-ধর্ম মানুষের অনেক কর্ম, ইচ্ছা, রুচি, পছন্দকে দমন করে রাখে। ধর্ম বলে, দুষ্ট প্রবৃত্তিকে দমন করতে হবে। সমকামিতা কি দুষ্ট প্রবৃত্তি? না কি এটা প্রকৃতিরই একটি দিক? একটি সিলেকশন? বিরুদ্ধবাদীরা বলেন, ‘সমকামিতা মানব জাতিকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলবে। বংশবিস্তার বন্ধ হয়ে যাবে’। কেউ কেউ তাদের মন্তব্যের উত্তরে বলেন, ‘পৃথিবীতে মানব জাতি টিকে থাকবে কি না তা ঠিক করবে প্রকৃতি। মানুষের তা নির্ধারণ করার কোনো ক্ষমতা নেই। মহাকালের কাছে মানবজাতি এমন কিছুই না। মহাবিশ্বের গর্ভে যদি মানব জাতির চেয়েও উন্নত কোনো প্রাণী থাকে, তাদের আগমন ঘটবে। প্রকৃতির বৈচিত্র্যতাকে কত দিন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে? সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্মের ক্ষমতা প্রকৃতির কাছে নস্যি। কিংকোবরার দুটি লিঙ্গ। অন্য সাপের মতো না। তাই বলে কি সব কিংকোবরা মেরে ফেলতে হবে? কেচো নিজেই নিজের বংশ বিস্তার করতে পারে। উভলিঙ্গ প্রাণী। আরেকটি কেচোর কাছে তার যেতে হয় না। সুতরাং বৈচিত্র্যতা অপরাধ নয়, খারাপ নয়। বিষয়টি সবাইকে বুঝতে হবে। ’
মত প্রকাশের স্বাধীনতা সাংবিধানিক অধিকার। তবে ধর্মের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করা যায় না। কিসের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করা যাবে? তা সমাজ, রাষ্ট্র এবং ধর্মসাপেক্ষ ব্যাপার। তাহলে ‘রূপবান’ পত্রিকার ভবিষ্যৎ কী? একটি প্রভাবশালী দৈনিক ‘রূপবান’ পত্রিকা প্রকাশের খবর দিলেও পত্রিকাটির সম্পাদকের নাম লেখেনি। এএফপি এর বরাত দিয়ে পত্রিকাটি জানিয়েছে, সম্পাদক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কতখানি আছে?
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমকামীদের পত্রিকা, সিনেমা, গান আছে। তারা রাজনীতি, মিডিয়া, শো-বিজের দাপুটে মানুষ। তারা তাদের পছন্দমতো জীবন যাপন করতে পারেন। আর পাঁচজন মানুষের মতোই তাদের জীবন। তাদের জীবনধারা আইন দিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়নি। ব্রিটিশ আমলের ১৮৬০ সালের পেনাল কোডের আইনের ৩৭৭ ধারায় প্রকৃতি বিরুদ্ধ যৌন কার্যকলাপ বলতে তারা কি বোঝায়? তা আলোচনা সাপেক্ষ। সমকামীরা তো দাবি করছেন, তারা প্রকৃতি বিরুদ্ধ না। তাদের রুচি পছন্দও প্রকৃতিরই অংশ। পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে তারা ভিন্ন রুচির মানুষের কাছ থেকে সহানুভূতি প্রত্যাশা করছেন। দেখা যাক, বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়, না কি প্রতিক্রিয়াশীল হয়?
বি. দ্র. ‘আপনার কথা বলিতে ব্যাকুল যুগে’ প্রতিদিন কত কত পত্রিকা বের হয়, আবার হারিয়েও যায়। ‘রূপবান’ দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
লেখক: কথাসাহিত্যিক [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১১১১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৪