২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখ গণ মানুষের জোয়ারে প্লাবিত হয়েছিল শাহবাগ।
এই প্লাবনে ছিল অন্যায়কে দুমড়ে-মুচড়ে ধ্বংস করে দেওয়ার এক নব প্রতিজ্ঞা।
মুক্তিকামী ও সচেতন মানুষের চোখের সামনে ভেসে ওঠে শাহবাগ আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্ত।
শুধু প্রজন্মের শক্তি নয় বরং শাহবাগের নাম শুনলেই অপরাধীর ভিত নড়ে ওঠে। মনে মনে একবারের জন্যে হলেও ভাবে, না জানি আমাকে নিয়ে কখন শুরু হয় নতুন আন্দোলন!
৫ই ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩:৩০ মিনিটে আমরা যে প্রতিবাদ শুরু করি তা ছিল একটি রায়ের বিরুদ্ধে আমাদের ক্ষোভ প্রকাশ। অল্প কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথেই ৫ ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে ইতিহাসের অংশ!
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য অভিযুক্ত আসামি কাদের মোল্লার বিচারের রায় ঘোষণা করে।
রায়ের পর পরই বিক্ষুব্ধ ব্লগার অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের কয়েকজন নিজ নিজ দায়বদ্ধতা থেকেই শাহবাগে এসে মিলিত হয়। ব্লগার অ্যান্ড অন লাইন অ্যাক্টিভিস্টদের নেটওয়ার্ক( BAON) এর ব্যানারে শাহবাগ যাদুঘরের সামনে দাঁড়িয়ে যায় কিছু তরুণ। যুক্ত হতে থাকে সর্বস্তরের মানুষ। দেশের প্রতিটি স্থানে রায়ের বিরুদ্ধে রূপ নেয় আন্দোলনের নব জোয়ার।
শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের আদলে দেশের বাইরেও গণ-মানুষের এ আন্দোলন রঙ ছড়ায়। ফলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধিত হয়, যুক্ত করা হয় সরকার পক্ষের আপিল। তারই ধারাবাহিকতায় কসাই কাদের মোল্লাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়।
কিন্তু এই পথ পরিক্রমায় ঠিক ঝুলে যাওয়ার আগেও নাটকীয়ভাবে মোড় নিচ্ছিল প্রতিটি মুহূর্ত। কসাই কাদেরের ভি চিহ্ন দেখানো যেমন সহ্য করে নি সাধারণ আমজনতা ঠিক তেমনি তার স্ত্রী যখন ‘ভি চিহ্ন’ দেখিয়ে বসে তখনও ক্ষোভে ফেটে পড়ে এ দেশের প্রতিটি তরুণ।
তরুণ বলতে বয়সগত দিক দিয়ে তরুণ নয়, বরঞ্চ ৭১ এর চেতনা ধারণকারী প্রতিটি মানুষকে আমি তরুণ বলতে চাই। কেননা প্রতি মুহূর্তেই এদের যেমন রয়েছে মৃত্যুর ভয়, ঠিক মৃত্যু হলেও এরা আবার সাধারণ আমজনতার মাঝেই জন্ম নেয়। তাই প্রতিটি মুক্তিকামী জনতা চির তরুণ।
১২ ডিসেম্বর ২০১৩ কাদের মোল্লাকে ১০ টা ১ মিনিটে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলানো হয়। দেশে ফিরে আসে স্বস্তির। কিছুটা কলঙ্কমুক্ত পরিবেশে দেশে প্রথমবারের মত বিজয় দিবস উদযাপিত হয়ে গেল বছর। এই রায় কার্যকর হওয়ার পেছনে সরকারের থেকে শাহবাগ আন্দোলনের আমজনতার ভূমিকাকেই আমি বেশি প্রাধান্য দেব। কেননা সরকারের কাজই হচ্ছে জনগণের চাহিদা আইন অনুযায়ী পূরণ করা।
অন লাইন থেকে রাজপথে নামার ইতিবৃত্ত:
ব্লগ ও ফেইসবুক থেকে রাজপথে এই আন্দোলন কীভাবে ছড়ায় বা কে জানিয়েছিল আহ্বান তা জানার অধিকার রয়েছে সবার। অতীতে এই সোনার বাংলায় বহুবার ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে; আর ইতিহাস বিকৃতির কারণেই অনেক ক্ষেত্রে ১৩ এর জন্ম।
কয়েকদিন ব্লগ ও ফেইসবুক ঘেঁটে একটা খসড়া দাঁড় করাই।
যেখানে দেখা যায়, রায় ঘোষণার পরপরই প্রথম রায়ের বিরুদ্ধে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেয় নির্ঝর মজুমদার। তিনি বলেন -" বিকাল ৩ টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে আমরা জমায়েত হব, বিক্ষোভ সমাবেশ হবে। "
এই স্ট্যাটাসের নিচেই প্রথমে জনৈক রাকিবুল বাশার রাকিবের মন্তব্য করেন, ''আমি ঢাকার দায়িত্ব নিলাম'' সঙ্গত কারণে স্ট্যাটাসের পুরো অংশ তুলে ধরে হল না। এরই মাঝে ব্লগার অ্যান্ড অন লাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক একটি আহ্বান জানায় যেখানে ইমরান এইচ সরকার ও বাঁধন স্বপ্নকথক ( মাহমুদুল হক মুন্সি) তাঁদের নিজস্ব ফোন নং দিয়ে সকলকে শাহবাগে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানান।
তবে ফেইসবুকে ইভেন্টের প্রধান প্রচারক ছিলেন সিডাটিভ হিপনোটিক্স (পরাগ)। কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের টেস্ট খেলা হুমকির মুখে পড়ার সাথে সাথেই পরাগ ইভেন্ট করে এবং তার আহবানে শাহবাগে জড়ো হয় শত শত ক্রিকেট-প্রেমী। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে ৭ তারিখ থেকে শাহবাগ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলাম। আমার প্রসঙ্গটি নিয়ে আসার কারণ-যেহেতু আমি নিজেও ব্লগার; দাবি করেই বসতে পারি সেই ৫ তারিখ থেকেই শাহবাগে আছি! এই ছিল শাহবাগ আন্দোলনের ঠিক প্রথম মুহূর্ত। কিন্তু এই মুহূর্তকে সৃষ্টি করতে ব্লগ জগতের রয়েছে দীর্ঘ দিনের অবদান। রাজাকারবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি হিসাবে কয়েকটি ব্লগ বেশ পরিচিত, তার মধ্যে সুশান্ত দাশ গুপ্তের মালিকানাধীন আমার ব্লগ ডট কম সব থেকে আলোচিত।
প্রত্যাশা:
শাহবাগ আন্দোলনের প্রথম মুহূর্তে একটিই প্রত্যাশা ছিল, যে কোনো মূল্যে কসাই কাদেরকে ফাঁসি দিতে হবে। ধীরে ধীরে এর সাথে সংযুক্ত হতে থাকে নতুন নতুন টপিক। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধসহ এদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারিকরণের দাবি তুলে ধরা হয়। ধর্মের নামে রাজনীতি বন্ধের দাবি জানানো হতে থাকে গলা ফাটিয়ে। শেষ অবধি যুক্ত হয় পাকিস্তানি পণ্য বর্জনের কর্মসূচি। গণ সচেতনতা গড়ে তোলা হয়। বলা চলে আন্দোলনের মূল স্রোত যা চেয়েছিল তার আংশিক মাত্র বাস্তবায়িত হয়েছে।
প্রাপ্তি:
অনেক ক্ষেত্রেই শাহবাগ আন্দোলনে প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তি অনেক বেশি। নিজস্ব মতানুসারে একটা ক্রম সাজিয়েছি।
১. কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরে সরকারকে সহযোগিতা প্রদান।
২. মানবতাবিরোধীদের পক্ষের শক্তিকে কোণঠাসা করে দেওয়া।
৩. সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপক্ষে কথা বলার মত শক্ত ভিত গড়ে ওঠা।
৪. জামায়াত-শিবিরকে আর্থিক সাহায্য প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া, তোমারা ভুল পথে আছো। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলায় তাঁদের পক্ষ নিয়ে তোমার প্রতিটি কর্মকাণ্ড পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অপরাধ।
৫. প্রতিটি মানুষের মুখে-মুখে "জয় বাংলা" স্লোগানটি উচ্চারিত হওয়া।
৬. জনগণই ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দু বা জনগণ যে কোনো সময় যে কোনো অপরাধের বিপক্ষে গণ-রোষের মাধ্যমে সরকার তথা রাষ্ট্র-যন্ত্রকে ভুল ধরিয়ে দিতে সক্ষম- আবারও প্রমাণিত।
৭. পাকিস্তানপ্রীতিতে ভাটা পড়ার অনুঘটক।
৮. ছোট্ট ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে আবাল বৃদ্ধবনিতার মাঝে নব উদ্যমে দেশপ্রেম জন্ম হওয়া ও ’৭১ এর অপশক্তিকে যে কোনো মূল্যে রুখে দেওয়ায় বদ্ধ পরিকর হতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ উৎসাহ দান।
ব্যর্থতা:
প্রতিটি মহৎ উদ্যোগ বা মহৎ ব্যক্তির জীবনে যেমন কিছু ব্যর্থতা থাকে, ঠিক তেমনি শাহবাগ আন্দোলনের কিছু কিছু ব্যর্থতা রয়েছে। অনেক দাবি থেকেই সময়ের স্রোতে আমরা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হই। গত বছর দেশের রাজনীতিতে মূল একটিই আলোচ্য বিষয় ছিল গণজাগরণ মঞ্চ। তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের মিত্র জামায়াত-শিবিরের চক্ষুশূলে পরিণত হয় গণজাগরণ মঞ্চ। ধর্মপ্রাণ ভাইদের মাঝে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়, আস্তিক-নাস্তিক ইস্যুতে। ব্লগার রাজীব হায়দারকে ছুরিকাঘাত করে হত্য করা হয়। বলা হয় সে নাস্তিক। একটাই অপরাধ লেখালেখি। মুক্তমতের শিকল টেনে ধরার অপচেষ্টা বরাবররই অব্যাহত রয়েছে। ’৪৭-এ দেশভাগ, ৫২ তে ভাষা আন্দোলন,৭১এ স্বাধীন বাংলা এমনকি ১৩ তে গণজাগরণেও মুক্তমতকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলার মাটিতে যেমন উগ্র ধর্মান্ধ লোকের বসবাস আছে ঠিক তেমনি কতিপয় ধর্মহীন লোক থাকাও অস্বাভাবিক নয়!
ব্লগার রাজীব হায়দারের (থাবা বাবা) মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু এখনও বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় নি। শাহবাগে দায়িত্ব পালন করে এক পুলিশ সদস্য বাসায় ফেরার পথে জামায়াত-শিবির দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন, বিচার হয়নি। বুয়েটের ছাত্রলীগ নেতা ও শাহবাগ আন্দোলনের সাথে জড়িত আরিফ রায়হান দ্বীপ হত্যারও কোন বিচার হয় নি। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে শাহবাগ আন্দোলনের সাথে জড়িত অনেকেই জামায়াত-শিবিরের হাতে আক্রান্ত হয়েছে। এইসব ব্যর্থতার দায়ভার খানিকটা শাহবাগ আন্দোলনের ব্যর্থতার তালিকায় পড়ে।
গণজাগরণ মঞ্চের সকল সাফল্য আওয়ামীলীগের থলিতে উঠলেও অন লাইনে অনেক আওয়ামী নেতা বর্তমানে এর বিরুদ্ধাচরণ করছেন। তাদের মতে গণজাগরণের সাথে জড়িত নেতাদের জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। আর গণজাগরণ মঞ্চের নেতাদের প্রশ্ন: ‘কার কাছে জবাবদিহি করব?’
গণজাগরণ অতিমাত্রায় বামকেন্দ্রিক হয়েছে বলে শোনা যায়; ঠিক তেমনি এনজিও সংস্থা থেকে সাহায্য নেওয়ার কথাও প্রকাশ্যে আসে। এখানে এনজিও সংস্থার বিরুদ্ধে বলার মূল কারণ এরা কখনো আমাদের দেশের ভালো চায় না, বরং দেশকে শোষন করে চলছে তলেতলে।
আরও একটি বিষয় অনেক ছাত্র ও চাকুরিজীবী বন্ধু দেশের স্বার্থে এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পথে অনেকটা বেকার হয়ে পড়েছেন। এক্ষেত্রে মনে রাখা উচিৎ পূর্ববর্তী সময়ের ইতিহাস দেখা গেলে দেখা যাবে প্রতিটি মুক্তিকামী নেতাই দেশের স্বার্থে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থ থেকে ছিটকে পড়েছেন (ট্র্যাকচ্যুত)।
মূলত শাহবাগ নিয়ে লিখতে বসলে প্রতিটি আন্দোলনকারীই লিখতেই থাকবে, এ ইতিহাস শেষ হবার নয়। শাহবাগ আন্দোলন যেমন বহু-নামে পরিচিত হয়েছে ঠিক প্রতিটি আন্দোলনকারীর ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত থাকতে পারে। তবে মূল দাবির জায়গা একটিই ছিল। শাহবাগ আন্দোলন বেঁচে আছে প্রতিটি আন্দোলনকারীর মনে ও চেতনায়; দু একটি ভুল ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পাশাপাশি মানবতার মুক্তি ও সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্যে শাহবাগ আন্দোলন বাংলার ইতিহাসে এই প্রজন্মের গড়া সফল এক আন্দোলন।
এমদাদুল হক তুহিন , ব্লগার ও কবি
মেইল[email protected]
মুক্তমত
শাহবাগ আন্দোলনের এক বছর: ইতিহাসের নতুন পথ রচনা
এমদাদুল হক তুহিন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।