ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কথা না হয় বললাম, কিন্তু লেখা?

ড. জিনিয়া জাহিদ, কনট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৪
কথা না হয় বললাম, কিন্তু লেখা?

ফেব্রুয়ারি মাস এলেই বাঙালি নড়েচড়ে বসে। হঠাতই ‘বাংলা ভাষা’ সচেতন হয়ে যায়।

সরকারের টনক নড়ে। কিছু রাস্তার নাম বদল হয় কিংবা অমুক তমুক এখন থেকে বাংলায় হবে- এমন আদেশ জারি হয়।

সোশ্যাল ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সেলিব্রেটিরা ‘নেক্সট জেনারেশনের’ কি যে হবে, বাংলা ভাষা এখন বাংলিশ হয়ে যাচ্ছে বলে নিজেরাই ইংরেজি-বাংলার সমন্বয়ে টক শো করেন, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন।   সংবাদপত্রগুলো হারিকেন দিয়ে খুঁজে বিস্মৃতপ্রায় ভাষা সৈনিক বা তাদের আত্মীয়-পরিজনের কলাম প্রকাশ করে।  
 
এ প্রজন্ম একুশে ফেব্রুয়ারির দিন খুব সকালে একুশের গান গাইতে গাইতে ফুল নিয়ে শহীদ মিনারে দিয়েই একটু পর বেলা বাড়লেই কানের মধ্যে হেড ফোন লাগিয়ে মোবাইলে বা আইপডে হিন্দি, ইংলিশ গান শোনে। আমাদের মা-বোনরা সন্ধ্যা হলেই হিন্দি সিরিয়ালে মজে যান।
 
ব্যস এভাবেই একুশে ফেব্রুয়ারির দিন পার। মফস্বলের পাড়ায় পাড়ায় যে মাইকে একুশের ও দেশাত্মবোধক গান বাজছিল, সেখানেই বাজে ‘শীলা কি জাওয়ানি’র মত চটুল কোনো গান। এই হয়েছে এখন ভাষামাস ও ভাষা দিবসের চালচিত্র।
 
বাঙালি দেশে থাকলেই বাংলা জানবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। পারিবারিক আবহ যতই পাশ্চাত্য বা ভারতীয় ধারার হোক না কেন, বাংলা সবাই শিখবে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বা ইংরেজি মাধ্যমে যতই পড়ুক না কেন, বাঙালি বাংলায় কথা বলা অন্তত ভুলবে না এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কিন্তু আমার দুশ্চিন্তা হলো বাংলা হস্তাক্ষর বা বাংলায় লেখা নিয়ে। একসময় বাঙালি না আবার হাতে বাংলা লেখাটাই ভুলে বসে।   
 
ছোটকালে বাংলায় লেখা শিখি আমরা। হাতের লেখা সুন্দর করার জন্য বাবা-মায়েরা যথেষ্ট চাপে রাখেন। সুন্দর হস্তাক্ষরের জন্য শিক্ষকরা নির্দিষ্ট মার্কসও বরাদ্দ রাখতেন। সুন্দর হস্তাক্ষর প্রতিযোগিতাও হতো। আমি জানিনা এখনো এসব চালু আছে কি না।   
 
আজকালকার স্কুলে, বাসায়, অফিসে সবখানেই কম্পিউটার নির্ভরতা তৈরি হওয়ায় বাংলা লেখার প্রয়োজন হলেই বাংলা সফটওয়ার ডাউনলোড করে সব কাজ সারা যায়। হাতে লেখার দরকারটা কি?
 
অন্যদের কি অবস্থা জানি না, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তেমন একটা সুবিধার নয়। বাংলা হাতের লেখা আমার কখনই ভালো ছিল না। কিন্তু লেখা ঝরঝরে পরিষ্কার হবার কারণে পড়তে অন্তত পাঠকদের তেমন কোনো সমস্যা হত না। অথচ দীর্ঘদিন হাতে বাংলা না লেখায় বানানের যাচ্ছেতাই অবস্থা তো আছেই, সেই সঙ্গে লেখা কাকের ঠ্যাং-বকের ঠ্যাংকেও হার মানিয়েছে।

ভেবেছিলাম ভালবাসার মানুষটিকে জন্মদিনের উপহারে নিজ হাতে বাংলায় একটা কিছু লিখে দেব। কাগজ কলম নিয়ে বসেছিলামও। কিন্তু আগেকার নাটকে দেখা কবিদের অবস্থা হয়েছিল আমার। একটু করে লিখি। এত জঘন্য লেখা আর বানান ভুলের কারণে পৃষ্ঠা ছিড়ে ছিড়ে ঘরের ১২টা প্রায় বাজিয়ে দেবার উপক্রম হয়েছিল। গুনগুন করে ‘আমার লাইন হইয়া যায় আঁকাবাঁকা, ভালোনা হাতের লেখা.....’  গাইতে গাইতে শেষমেষ সেই বাংলা সফটওয়ারই ভরসা।
 
এখনকার প্রেমিকরা কাউকে পছন্দ হলে প্রেমপত্র লিখে না। ফেসবুকের ইনবক্সে ম্যাসেজ বা মোবাইলে টেক্সট করে। বাংলায় হাতে লিখে মনের ভাব প্রকাশ করার তো আসলেই দরকার নেই।
 
আজকালকার গৃহিনীরাও বাজারের ফর্দ মোবাইলে টেক্সট করেন কিংবা কর্তা নিজেই তা শুনে নিয়ে মোবাইলে নোট করে নেন।  
 
 
অফিস আদালতের চিঠিপত্র যাও দু’একটা বাংলায় লেখা হয়, তাও কেরানিসহ সবাই কম্পিউটারেই টাইপ করে নেয়। বিলবোর্ডগুলোও তো আজকাল বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে লেখা হয়।   

তাহলে বাংলা লেখার অভ্যাস হবে কিভাবে? বাংলায় কথা বলা হয়ত আমরা কখনই ভুলব না, কিন্তু অনভ্যাসের কারণে একসময় বাংলা হস্তাক্ষর ভুলে যাই কি না সেটাই এখন চিন্তার বিষয়।

ড. জিনিয়া জাহিদ: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক

বাংলাদেশ সময়: ১২৪৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।