ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

এ সবুজের মাটির মানুষেরা

জাহিদ নেওয়াজ খান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৬ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৪
এ সবুজের মাটির মানুষেরা

পড়ন্ত বিকেলে তিনি যখন জলভরা চোখে তার হতাশা এবং আনন্দের কথা বলছিলেন, তখন আর্দ্র হয়ে উঠছিলো সবার মন। দেশকে এক বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলেন তিনি।

কিন্তু প্রতিদান হয়ে এসেছিলো চাকুরিচ্যুতি। তিনি সময় এবং নাম উল্লেখ করেন নি। তবে জানালেন, যে দু’জন তাকে চাকুরিচ্যুত করেছিলেন; কিছুদিনের মধ্যেই প্রকৃতির বিচারে তাদের ঠিকানা হয়েছিলো কারাগার। তিনি সময় না বললেও তাঁর জীবন-বৃত্তান্ত বলছে, সময়টা ১৯৯০ সালের। মানে এরশাদ আমল।

তিনি যখন তাঁর সব অর্জনের পেছনে স্ত্রীর ভূমিকার কথা উল্লেখ করে চশমা খুলে, চোখের জল মুছে স্ত্রীর প্রতি আরো একবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিলেন; তখন আবেগে আপ্লুত শ্রোতারা ওই ভদ্রমহিলার জন্যও দাঁড়িয়ে সম্মান জানিয়ে বুঝতে পারছিলেন, তাঁর চাকুরিচ্যুতির ওই আপাতঃ ‘অপমান এবং কষ্টের সমেয়ে’ কিভাবে সহায় এবং আশ্রয় হয়েছিলেন তিনি।

তবে দেশ তাকে এভাবে অপমান করলেও তাঁর কষ্টের সময় খুব দীর্ঘ হয় নি। তিনিই জানালেন, ভালো কাজের পুরষ্কার হিসেবে যখন তিনি চাকুরি হারালেন, তখন বিদেশীরা তাঁকে ‘ছোঁ’ মেরে নিয়ে গিয়েছিলো। পরের দু’ দশক তিনি তাই কাজ করেছেন বাংলাদেশ ছাড়া এশিয়ার অন্য দেশ, ইউরোপ, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার কৃষির উন্নয়নে।

চ্যানেল আই কৃষি পদক আজীবন সম্মাননা ২০১৪-তে ভূষিত হয়ে ড. এম মতলুবর রহমান তাঁর ছোট কিন্তু হৃদয় ও মস্তিষ্ক নাড়িয়ে দেয়া বক্তৃতায় আমাদের বললেন, এ পুরষ্কার তাঁর কাছে এজন্য বড় না যে তিনি একটি পুরষ্কারে ভূষিত হচ্ছেন; কিন্তু এ কারণে অনেক বড় যে তাঁর এখন মনে হচ্ছে, ভালো কাজের পুরষ্কার হিসেবে তিরষ্কারের পরিবর্তে এখন উপযুক্ত সম্মানও দিতে পারছে বাংলাদেশ।

ড. মতলুবর রহমানের বয়স এখন ৭৫। এর মধ্যে তিনি সরাসরি বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে পেরেছেন মাত্র ১৯ বছর। কিন্তু এর মধ্যেই তিনি সেই মানুষগুলোর একজন যাঁরা বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়নে নিরন্তর কর্মসাধনা চালিয়ে গেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের একেবারে শুরুর দিকে কৃষি গবেষণার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে অপরিসীম অবদান রেখেছেন।

উচ্চফলনশীল জাতের ধান ইরাটম-২৪ এবং ইরাটম-৩৮ উদ্ভাবন করেছেন তিনি। আখের দু’টি উচ্চফলনশীল জাতেরও উদ্ভাবক ড. মতলুবর রহমান। বাংলাদেশে ভুট্টা চাষের প্রচলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। এছাড়া ইক্ষু গবেষণা ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ লাইভস্টক রিসার্চ ইন্সটিটিউট এবং মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠাতেও তাঁর ভূমিকা অনেক।

আমার সৌভাগ্য যে চ্যানেল আই ছাদ বারান্দার অনুষ্ঠানটিতে আমি ঠিক তাঁর পরিবারের সদস্যদের পাশে বসতে পেরেছিলাম। তাঁদের যে মুখচ্ছবি, তাতে স্পষ্ট তাদের জন্য বিশেষ একদিন আজ; স্বামী-বাবা-ভাই’র আনুষ্ঠানিক সম্মানিত হওয়ার মধ্য দিয়ে মুছে যাচ্ছে তাঁদের উপর চাপিয়ে দেয়া এতোদিনের কথিত সকল গ্লানি, তাঁদের সব কষ্ট-অভিমান।

তাদের মনের ভেতরের কষ্ট খুলে যাওয়ার মতোই অনুষ্ঠানে নিজের ভেতরে লুকিয়ে রাখা সব কথার ঝাঁপি খুলে দিয়েছিলেন চ্যানেল আই কৃষি পদক ২০১৩-তে ভূষিত সেলিনা জাহান। শুনিয়েছেন নারীর প্রতি পদে পদে বাধা আর সেই বাধা জয় করার চিরন্তন গল্প। জৈব কৃষির এক সরব অভিযাত্রী নরসিংদীর এ নারী। ড. মতলুবর রহমানের কথার সূত্র ধরে তিনি বললেন, পরিবার থেকে ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। তিনি যখন জননী মাটিকে পুষ্টি দেয়ার মিশনে জৈব কৃষির বার্তা নিয়ে শিবপুর ও রায়পুরা উপজেলার গ্রামগুলোতে তাঁর অভিযাত্রা শুরু করেছিলেন, তখন তাঁর স্বামী নানাভাবে তাঁকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছেন। অনুষ্ঠানে তাঁর স্বামীও উপস্থিত ছিলেন।

তিনি যখন সলাজ হাসিতে দাঁড়ালেন, তখন সেলিনা জাহান জানালেন, পরোক্ষভাবে স্বামীর সহায়তাও নিয়েছেন তিনি। জৈব কৃষির অভিযাত্রার প্রাথমিক অনেক খরচই তিনি স্বামীর পকেট কেটে নিয়েছেন। তবে জেলা প্রশাসকের সম্মাননার পর থেকে অবশ্য দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছেন তাঁর স্বামী।

শুধু তিনি একা নন, এ মানুষগুলোকে খুঁজে বের করা শাইখ সিরাজের ভাষায় আমরাও এখন বুঝতে পারছি, মাটি ও প্রতিবেশের আপন স্বজন হয়ে গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে চলা সেলিনা জাহান আজকের পরিবর্তিত কৃষির সময়ে আমাদের জন্য এক অনন্য সাহস। জৈব কৃষির বারতা ছড়িয়ে দিতে এখন জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার উপকূলীয় অঞ্চলেও যাচ্ছেন সেলিনা জাহান।

এরকমই আরেকজন একই অনুষ্ঠানে চ্যানেল আই কৃষি পদক ২০১২-তে ভূষিত সিরাজুল ইসলাম। উপকূলীয় কৃষি-প্রতিবেশের এক অকৃত্রিম বন্ধু তিনি। বারবার ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার হায়বাতপুর গ্রামের এ মানুষটি স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানো এক কৃষক সংগঠক। কৃষকদের সচেতন করার জন্য কৃষক সেবা সংগঠন গড়ে তোলা ছাড়াও ২০০৬ সালে শুরু হয় তাঁর মাটি, পানি ও জলবায়ু সহনশীল দেশী জাতের ধান সংগ্রহ ও গবেষণা। এখন পর্যন্ত তিনি ৩৬৭ প্রজাতির স্থানীয় জাতের ধান সংগ্রহ করে ফলন পরীক্ষাসহ নানামুখি গবেষণা করেছেন।

তাঁর মতো কৃষকদের আত্মবিশ্বাস ও সাহসকে পুঁজে করেই সিডর-আইলা-মহাসেন এবং অতিরিক্ত লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা মোকাবেলা করে এগিয়ে চলেছেন লবণাক্ত উপকূলীয় জনপদের কৃষক।

যেমন এগিয়ে চলেছে সময়ের বিবর্তনে প্রাকৃতিক উৎসের বিপন্নপ্রায় সময়ে বাংলাদেশের মৎস্য খাত। যখন দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছিলো আমাদের পুষ্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত রসনার তৃপ্তি, গভীর ভালোবাসা আর ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত দেশী জাতের মাছ, তখন গভীর মনোযোগী এক উদ্যোক্তার হাত ধরে ঘুরে দাঁড়ায় মৎস্য সম্পদ। তিনি ময়মনসিংহ সদরের চর পুলিয়ামারি গ্রামের নুরুল হক। দেশী মাছের জাত গবেষণা ও সম্প্রসারণের এ নায়ককে চ্যানেল আই কৃষি পদক ২০১১-তে ভূষিত করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতে অনার্স-মাস্টার্স এ মৎস্যচাষীর সময়কে জয় করার গল্পটাও অনেকটা সেলিনা জাহানের মতোই। তবে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন বাধা, ভিন্ন সাফল্য। সেলিনা জাহান যেমন চ্যানেল আই’র ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষে’ অনুপ্রাণিত; নুরুল  তেমনই অনুপ্রাণিত বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মাটি ‍ও মানুষে’।

সেটা ১৯৮৯ সালের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে পরিবারের সকলের অমতেই শুরু করে দেন মাছের রেণু থেকে পোনা উৎপাদনের কাজ। শুরুতে সময়টা এমন ছিলো যে তাকে বাড়ির বাইরে বাইরে থাকতে হতো। বাবা যখন বাড়ির বাইরে মা তখন গোপনে ছেলেকে খাইয়ে দিতেন। বাবা কোনোভাবেই ছেলের এ ‘অধঃপতন’ মেনে নিতে পারছিলেন না। সমাজের বাধাও কম ছিলো না। বাজারে যখন তার কর্মীরা পোনা বিক্রি করতে যেতেন, তখন তিনি দাঁড়িয়ে থাকতেন দূরে। তা না হলে যে লোকে আঙুল দিয়ে তাকে ‘জাউলা’ বলবে।

সেই ‘জাউলা’ নুরুল হক ১৯৯৯ সালে প্রথম এক বৈপ্লবিক সাফল্যবার্তা জানান দেন। বাণিজ্যিকভাবে প্রথম দেশীয় শিং মাছের পোনা উৎপাদন গবেষণায় সফল হন তিনি। তারপর নিরন্তর গবেষণায় সাফল্য আসে দেশী পাবদা, খলিসা, চিতল, ফলি, আইড় ও শোল মাছের বাণিজ্যিক পোনা উৎপাদনে। ২০০৩ সালে তিনি থাই কৈ-এর বাণিজ্যিক পোনা উৎপাদন গবেষণায় সফল হন। ২০০৮ সালে সফল হন থাই কৈ-এর অল ফিমেল জাত গবেষণায় যার মধ্য দিয়ে ৭০ ভাগ উৎপাদন বাড়ার নিশ্চয়তা আসে।

বাস্তবতা হচ্ছে, এখন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সুপার তেলাপিয়ার জাত উৎপাদনে তাঁর সঙ্গে গবেষণায় নিয়োজিত। তাঁর মতো ‘জাউলা’দের হাত ধরেই দেশের মোট মাছ উৎপাদন ২০ লাখ টন থেকে ছাড়িয়ে গেছে ৩৪ লাখ টন।

নুরুল হক, সিরাজুল ইসলাম, সেলিনা জাহান এবং ড. মতলুবর রহমানের কথায় শুক্রবারের বিকেলটিতে অনুষ্ঠানে উপস্থিত শ’ দেড়েক মানুষ বারবার যেমন আর্দ্র হয়েছেন, তেমনই তাদের সাফল্যগাথার আনন্দেও সিক্ত হয়েছে তাদের চোখ। অনুষ্ঠানের বাজারে প্রতিদিন যখন হাজারো রকমসকম তখন সবুজ বাংলাদেশের এরকম মাটির মানুষদের সম্মাননা জানানোর অনুষ্ঠানে থাকতে পারাটাও অসাধারণ এক অনুভূতি।

জাহিদ নেওয়াজ খান: সাংবাদিক।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।