ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ফ্ল্যাশ মব

পলাশ মাহবুব, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ৩১, ২০১৪
ফ্ল্যাশ মব

অনেকে বলে আমরা জাতে মাতাল। কিন্তু তালে আবার ঠিক।


পাগল হলেও ‘ভাত ফালানো’র রেকর্ড আমাদের কম।
কিন্তু ক্রিকেটটা এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
এই একটি বিষয় আমাদের সত্যিকারের পাগল বানিয়ে ছাড়ে। যে কারণে ক্রিকেট পাগল জাতি হিসেবে আমাদের নাম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। স্টেডিয়ামে যে দলের খেলা থাকুক না কেন গ্যালারি ফাঁকা থাকে না।
ক্রিকেট আমাদের কাছে এক উন্মাদনার নাম।
এবারের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়েও আমাদের উন্মাদনার কমতি ছিল না। নিজের মাঠে ঘরের ছেলেরা পরের দেশকে কুপোকাত করবে এই স্বপ্ন ছিল সবার মনে। আয়োজনও ছিল।
স্বপ্ন সবসময় সত্য হবে তেমন কথা নেই।
মাঠের ফলে এবার নতুনত্ব ছিল না। (আগে হংকংয়ের বিপক্ষে হারি নি। এবার হেরেছি। এটাকে অবশ্য নতুনত্ব ধরা যেতে পারে)।
মাঠের ফল বাদ দিলে এবারের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে সত্যিকারের কিছু নতুনত্ব ছিল।
অন্তত দুটি বিষয় তো বেশ চোখে পড়েছে।
বিশ্বকাপ উপলক্ষে ঢাকাকে যেভাবে বিয়েবাড়ির মতো আলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল তার রেশ পড়েছে মাঠেও। দুটোর মধ্যে পার্থক্য-- একটি দৃষ্টিকটু অন্যটি দৃষ্টিনন্দন।

বিশ্বকাপ ক্রিকেটে এবারই বোধহয় প্রথম এমন স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হয়েছে যাতে বল লাগলে জ্বলে ওঠে। আগামীতে হয়তো এ ধরণের বলও দেখা যেতে পারে। ব্যাটে বল লাগলেই জ্বলে উঠবে।

চার-ছক্কা হই হই
বল গড়াইয়া গেলো কই . . .
flash_mob_01
তখন আর এই গান গাওয়ার সুযোগ থাকবে না। বল গড়িয়ে বা উড়ে যেখানেই যাক, জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের মতো তা দেখা যাবে। তখন ক্যাচ ড্রপের হার বেড়ে যেতে পারে। আগুন ধরে অনেক ফিল্ডারই হয়তো হাত পোড়াতে চাইবেন না। অবশ্য আইসিসি অনেকদিন ধরেই ক্রিকেটে এক্সসাইটমেন্ট বাড়ানোর কাজ করে যাচ্ছে। বলে লাইট জ্বললে ক্যাচ মিসের হার বাড়বে। ক্যাচ মিস হলে ব্যাটসম্যান টিকে যাবে। ব্যাটসম্যান টিকে গেলে রান বাড়বে। রান বাড়লে এক্সসাইটমেন্টও বাড়বে। এইতো চাই। ভবিষ্যতে তাই আগুল-জ্বলা-বল যে আসবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
অবশ্য যা এখনো হয়নি তা বলে লাভ নেই।
জ্বলন্ত স্ট্যাম্পের প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
বল বা হাতের ছোঁয়ায় স্ট্যাম্পের জ্বলে ওঠার বিষয়টি বেশ উপভোগ্য।
দর্শকদের আনন্দের পাশাপাশি এতে করে আম্পায়ারদের সিদ্ধান্ত নিতেও সুবিধা হচ্ছে। তবে ইদানীংকালের আম্পায়াররা বোধহয় মাঠে এসে শরীরচর্চার কাজটা সেরে নিতে চান। যে কারণে রান আউট কিংবা স্ট্যাম্পিংয়ের সবচেয়ে সহজ সিদ্ধান্তের বেলায়ও তারা দু হাত ওপরে তুলে থার্ড আম্পায়ারের বাক্স আঁকেন। ভাবটা এমন, থার্ড আম্পায়ার বসে বসে বেতন নেবে কেন!
তবে এবারের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় যে নতুনত্ব সেটা হচ্ছে ফ্ল্যাশ মব।
ফ্ল্যাশ মব বিষয়টি সম্পর্কে আগে আবছা একটা ধারণা ছিল।
ধারণাটা এরকম যে, ফ্ল্যাশ মব জাতীয় কিছু একটা আছে। কোথায় যেন শুনেছি। কবে যেন দেখেছি।
বিশ্বকাপের আগে আগে পরিচিত এক পরিচালক একদিন আফিসে আসলেন।
ভাই, বিশ্বকাপ উপলক্ষে কয়েকটা ফ্ল্যাশ মব বানাইছি। আইসিসি’র খ্যাপ। আপনাদের চ্যানেলে পারলে গ্যাপে গ্যাপে চালাইয়া দিয়েন।
আমি: জ্ঞানের গ্যাপ ফিলাপের সুযোগ নেই।
ফ্ল্যাশ মবটা যেন কি?
ও। আচ্ছা . . .
আমার ফ্ল্যাশ জ্বলে না ওঠায় পরিচালক বোধহয় আমাকে টিউবলাইট ভাবে।
ফ্ল্যাশ শব্দের অর্থ ঝলকানি। আর মব মানে তো জানেনই- অনেক মানুষের জমায়েত। দুটোর সম্মিলিত অর্থ হঠাৎ অনেক মানুষের গ্যাদারিং।
পরিচালক বোঝানোর চেষ্টা করে।
আমার কাছে ইংলিশ টু বেঙ্গলি ডিকশনারি আছে। কেতাবি কথা না বলে সহজ কথায় বলেন।
সেটাই বলছি। তবে বোঝার সুবিধার জন্য একটু ভূমিকা দিয়ে নিলাম আর কি!
ডিকশনারির ফ্ল্যাশ মব আর বিশ্বকাপকে ঘিরে যে ফ্ল্যাশ মব হয়েছে তা অর্থের দিক দিয়ে খানিকটা আলাদা। এই ফ্ল্যাশ মবে যুক্ত ছিল গান আর নাচ। ফ্ল্যাশ মবের বিশেষত্ব হচ্ছে ব্যস্ততম কোনও জায়গায় হঠাৎ কিছু মানুষ জমায়েত হয়ে নাচ-গান, ধুম-ধারাক্কা করে আবার ভিড়ের মধ্যে মিশে যাবে।
এ পর্যন্ত বলে পরিচালক তার ল্যাপটপে একটা ফাইল ওপেন করল।
শুরু হলো এবারের বিশ্বকাপের থিম সং।
চার ছক্কা হই হই . . .
অমনি হই হই করে কিছু ছেলে-মেয়ে রাস্তার ওপর নাচা শুরু করল।
আমি ফ্ল্যাশ মবে মিশে গেলাম।
বিশ্বকাপকে মাথায় রেখে আইসিসি’র উদ্যোগে সারাদেশের এগারোটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এগারোটি ফ্ল্যাশ মব তৈরি করে। তারপর তা ছড়িয়ে দেয় ইউটিউবে। ঘোষণা দেয়া হয়- যে ইউনিভার্সিটির ফ্ল্যাশ মব সবচেয়ে বেশি লাইক পাবে বিশ্বকাপের খেলার মাঝে চালানো হবে সেটি।
ফ্ল্যাশ মবের ঝলকানিতে চোখ ঝলসায় সবার।
ইউটিউবে ফ্ল্যাশ মব দেখে দেশের অন্যান্য ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে।
এ হতে পারে না।
অমুক ইউনিভার্সিটি ফ্ল্যাশ মব করছে। আমরা পিছিয়ে থাকবো কেন? ওদের চেয়ে তো আমাদের টিউশান ফি বেশি। আমরা কম কিসে!
শুরু হয় নিজস্ব উদ্যোগে ফ্ল্যাশ মব তৈরি।
এগারোটি ফ্ল্যাশ মব এসে ঠেকে একশ এগারোতে। কেউ কেউ একাধিকও করেছে।
এক ইউনিভার্সিটির ফ্ল্যাশ মব দেখে বোঝার উপায় নাই এরা ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রী নাকি প্রফেশনাল অ্যাক্রোবেট।
এখনও প্রতিদিন ফ্ল্যাশ মব তৈরি হচ্ছে। মূল বিষয়কে ছাপিয়ে তাতে যুক্ত হচ্ছে নানা মাত্রা।
ভিড় ঠেলে চলতে হয় বলেই হয়তো ভিড়ের প্রতি জাতিগতভাবে আমাদের দুর্বলতা আছে।
রাস্তায় গর্ত খুঁড়তে দেখলেও আমরা শ’ খানেক লোক দাঁড়িয়ে যাই।
সেখানে নামে নাচ-গান হলে তো কথাই নেই।
ফ্ল্যাশ মবের নেশায় পেয়ে বসে আমাদের।
বোঝা যাচ্ছে ফ্ল্যাশ মবের নেশা কাটতে কিছুদিন সময় লাগবে আমাদের।
কিন্তু বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাবে। তখন কি নিয়ে হবে আমাদের ফ্ল্যাশ মব?
এ বিষয়ে কিছু আইডিয়া করা যেতে পারে।
বিশ্বকাপের পর প্রথম যে বিষয়ে ফ্ল্যাশ মব হতে পারে তা হচ্ছে- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এই দাবিতে ফ্ল্যাশ মব তৈরি করতে পারি আমরা।
এরপর সমসাময়িক নানা বিষয়ের ওপরে হতে পারে ফ্ল্যাশ মব।
বাজারে চালের দাম বেড়েছে?
দু-চারটা ফ্ল্যাশ মব হতেই পারে!
বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, সিএনসি চালকদের দৌরাত্ম্য- এসবও হতে পারে ফ্ল্যাশ মবের বিষয়।
প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ফ্ল্যাশ মব কিন্তু মন্দ হবে না।
এটা গণতান্ত্রিকও বটে।

পলাশ মাহবুব : সাহিত্যিক ও নাট্যকার। প্রোগ্রাম ম্যানেজার, বৈশাখী টেলিভিশন।
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।