প্রথম তারেক রহমান লন্ডন থেকে, পরে বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতা ঘোষক ও প্রথম রাষ্ট্রপতি। ’ তারেক রহমান ও খালেদা জিয়া।
আমার মনে পড়ে, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া কয়েক বছর আগে ‘জাতীয় সঙ্গীত’ পরিবর্তনের কথা বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধকে ‘গৃহযুদ্ধ’ বলেছেন। সম্প্রতি খালেদা জিয়ার প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান সোহেল বলেছেন, ‘জিয়াউর রহমানকে প্রথম রাষ্ট্রপতি ও স্বাধীনতার ঘোষক না মানলে মুক্তিযুদ্ধই অবৈধ হয়ে যাবে। ’ একজন অবলীলায় মুক্তিযুদ্ধকে ‘অবৈধ’ বলে যাচ্ছে, রাষ্ট্র কেনো এখানে নিশ্চুপ। তার জন্য অবশ্যই মারুফ কামালের শাস্তি হওয়া উচিত, সেই সাথে যারা তার বক্তব্যকে সমর্থন করে যাচ্ছেন, তাদেরও শাস্তি কাম্য। মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননাকর বক্তব্যের মাধ্যমে তারা পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিচ্ছেন, মুক্তিযুদ্ধকে মানেন না। সম্ভবত সে-কারণে বারবার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে চলেছেন। তাদের অনুকূলে নেয়ার চেষ্টা করছেন। এতে যে খুব একটা লাভবান হয়েছেন, বা হবেন, তা কিন্তু নয়। কেননা ইতিহাস তার অবস্থানে নির্ভুল, সঠিক। চাইলে যে কেউ ইতিহাসকে ‘মনগড়া পাতিহাঁস’ বানিয়ে ফেলতে পারেন না।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা বাংলার শেষ নবাব। সিরাজউদ্দৌলাকে মেরে ফেলার পর তার সম্পর্কে নানান অপবাদ দিয়েছিল তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী। মীর জাফরকে বানানো হয়েছিল মহানায়ক। অথচ ইতিহাসে সিরাজউদ্দৌলা এখন একটি উজ্জ্বল চরিত্র। আর মীর জাফর আজীবন ইতিহাস-ধিকৃত। বিশ্বাসঘাতক হিসেবে তার পরিচিতি। তার নামটি চরম ঘৃণার সাথে নেওয়া হয়।
স্বাধীনতার ঘোষণার নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা অনেকদিন ধরে। এখন এর সঙ্গে নতুন করে যোগ হলো প্রথম রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত বিতর্ক। এসব ৪৩ বছর আগেই মীমাংসিত। এ দুটি বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ এখন আর নেই। বিতর্কটি করা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে, ইতিহাসকে বিকৃত ও কলঙ্কিত করা জন্য। একটি রাজনৈতিক দুরভিসন্ধিমূলকও হতে পারে।
১৯৭৫ সালের পর সিরাজউদ্দৌলাকে মীর জাফর আর মীর জাফরকে সিরাজউদ্দৌলা বানানোর একটি অবস্থা তৈরি করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। জাতীয় চার নেতাকে জেলের ভেতর হত্যা করা হয়। এদের বিচার করা যাবে না বলে একটি ইনডেমিনিটি বিল পাস করা হয়। গোলাম আযমকে দেশে ফেরত আনা হয়। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে জামায়াতে ইসলামীকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির নগ্ন খেলা চালানো হয়েছিল দীর্ঘ ২১ বছর। ক্যাঙ্গারু কোর্টের মাধ্যমে অগণিত মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। সামরিক আদালতের রায়ে ১৯৭৭ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত ১১৪৩ জন সৈনিক ও অফিসারকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে গলা টিপে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নাম নেয়া যেতো না এ-দীর্ঘ সময়ে। এসব করে পেরেছে কিছু? পারে নি। তারা মুক্তিযুদ্ধকে মুছে ফেলতে পারে নি। ইতিহাস তার সত্য ও নিভাঁজ অবস্থানে ফিরে এসেছে। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কখনো হারিয়ে যায় নি। মুক্তিযোদ্ধারা ঘুমায় নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ঘুমিয়ে যায় নি। জেগে আছে। ইতিহাসের প্রয়োজন অনুযায়ী যে ব্যক্তি জনগণকে জাগিয়ে তুলতে পারেন, এবং জাগ্রত জনগণের গণবাণীকে সঠিক রূপে প্রতিফলিত করতে পারেন, তিনিই হয়ে ওঠেন ‘ইতিহাসের নায়ক’।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতীয় নেতা। তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলেছেন। তিনি ঐ ভাষণে অত্যন্ত স্পষ্ট ও পরিষ্কারভাবে শুধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, বাঙালির মুক্তির কথাও বলেছেন। জিয়াউর রহমানসহ অনেকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতার জন্য সবুজ সংকেত হিসেবে অভিহিত করেন। এ প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’য় প্রকাশিত জিয়াউর রহমানের ‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ উল্লেখ করতে হয়। তিনি ঐ প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক হিসেবে স্বীকার করেছেন। ৭ মার্চের ভাষণকে স্বাধীনতা সংগ্রামের সবুজ সংকেত হিসেবে মেনে নিয়েছেন। ঐ প্রবন্ধে জিয়াউর রহমান লিখেছেন, ‘তারপর এলো ১লা মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সারাদেশে শুরু হলো ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলন। এর পরদিন দাঙ্গা হলো। বিহারীরা হামলা করেছিল এক শান্তিপূর্ণ মিছিলে, এর থেকেই ব্যাপক গোলযোগের সূচনা হলো। ’ ঐ লেখার আরেকটি অনুচ্ছেদে তিনি লিখেছেনÑ‘৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগন্যাল বলে মনো হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্তরূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তা জানালাম না। বাঙ্গালী ও পাকিস্তানী সৈনিকদের মাঝেও উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠছিল। ’ জিয়াউর রহমানের এ লেখাটি বিএনপি’র ওয়েব সাইটে রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার প্রথম ঘোষক, এটা ইতিহাসের সত্যপাঠ। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র অনুসন্ধানে জানা যায়, ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। আক্রমণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা, রাইফেল সদর দপ্তর ও রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়ার্টার। বঙ্গবন্ধু ওয়ারলেসের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে স্বাধীনতা ঘোষণার একটি বার্তা পাঠান। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে সারাবিশ্বের ইংরেজি ভাষার শীর্ষস্থানীয় দৈনিকগুলোতে খবর প্রকাশিত হয়। এতে দেখা যায়, ২৬ মার্চ সকালে কলকাতায় পৌঁছা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রকৃত বার্তা থেকে এবং ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের সম্প্রচার থেকে সারাবিশ্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা জানতে পারে।
১৯৭১ সালের মার্চে যেসব বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার খবর প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে ভারতের দ্য স্টেটসম্যান এবং দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেস হেরাল্ড; অস্ট্রেলিয়ার দ্য এজ এবং দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ড, মিয়ানমারের দ্য গার্ডিয়ান, কানাডার দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইল, হংকংয়ের দ্য হংকং স্ট্যান্ডার্ড; ইন্দোনেশিয়ার দ্য জাকার্তা টাইমস, জাপানের আসাহি ইভিনিং নিউজ, নেপালের দ্য রাইজিং নেপাল, ফিলিপাইনের ম্যানিলা টাইমস, সিঙ্গাপুরের দ্য স্ট্রেইটস টাইমস, দক্ষিণ আফ্রিকার দ্য প্রিটোরিয়া নিউজ, থাইল্যান্ডের দ্য ব্যাংকক পোস্ট, যুক্তরাজ্যের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য লন্ডন টাইমস, যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর সান, দ্য বোস্টন গ্লোব, শিকাগো টাইমস, ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর, লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য ফিলাডেলফিয়া ইনকুয়েরার, সানফ্রান্সিসকো ক্রোনিকল এবং দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট অন্যতম।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা পাকিস্তানি বেতারতরঙ্গেও ধরা পড়ে। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ সময়কালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের যেসব গোপন নথি প্রকাশ হয়েছে, তা থেকেও জানা যায় যে, তাদের কাছেও বঙ্গবন্ধুর ওয়ারলেস বার্তা ধরা পড়েছে। সেই স্বাধীনতা ঘোষণার বাণীটি হচ্ছে : ``This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh whatever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your flight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh. Final victory is ours. (অনুবাদ : সম্ভবত এটাই আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনসাধারণকে আহবান জানাচ্ছি তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যাই তোমাদের কাছে তার দ্বারাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে হবে। যতক্ষণ না পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ ব্যক্তি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত হবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হবে, তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। ) এই ঘোষণাটি বাংলাদেশের সর্বত্র ট্রান্সমিটারে প্রেরিত হয়।
২৬ মার্চ দুপুর প্রায় আড়াইটায় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র চালুর পর বঙ্গবন্ধুর বাংলায় লেখা ঘোষণাটি পাঠ করেন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান। সন্ধ্যায় এটি সারা বিশ্বে প্রচার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণাটি ছিল : ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সাথে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ আপনাদের কাছে আমার আদেশÑদেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপোষ নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা। ’
অন্যদিকে একাত্তরের ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় প্রথমবার মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা পাঠ করার সময় জিয়াউর রহমান নিজেকে স্বাধীন বাংলার প্রভিশনাল হেড অব স্টেট বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে সেনা কর্মকর্তা হয়ে এমন ঘোষণা দেওয়ায় তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাকের বদলে বিশ্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একাংশের বিদ্রোহ হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার আশঙ্কা থেকে অন্যদের অনুরোধে পরক্ষণেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন জিয়াউর রহমান। তাঁর ভাষণটি হচ্ছে : ÔI, Major Zia-ur-Rahman,on behalf of our great national leader and supreme commandar Sheikh Mujibur Rahman do hereby proclaim the independence of Bangladesh.' বঙ্গবন্ধুর নামে তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণা অনেককে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এই ভূমিকার স্বীকৃতি তাঁকে তার সমগোত্রীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য দান করে।
জীবদ্দশায় মেজর জিয়াউর রহমান কখনোই নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। জিয়াউর রহমানের প্রথম ঘোষণায় নিজেকে স্বাধীন বাংলার প্রভিশনাল হেড অব স্টেট বলে ঘোষণা করার এই তথ্য পাওয়া যায় এ কে খন্দকার, এস আর মির্জা ও মাঈদুল হাসানের আলাপচারিতার ভিত্তিতে লেখা বই ‘ইতিহাসের পূর্বাপর’ থেকে। তবে জীবদ্দশায় জিয়াউর রহমান ওই ভাষণের কথা উল্লেখ করেননি কখনোই। নিজেকে রাষ্ট্রপতি দাবি করার কথাও বলেননি। এমনকি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালে গঠিত অথেনটিফিকেশন কমিটির প্রতিবেদনেও এমন কোনো তথ্যের উল্লেখ নেই। আর একাত্তরের ২৪ মার্চ থেকে পরবর্তী কয়েক দিন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে থাকা তখনকার মেজর শওকত আলী, লে. শমসের মবিন চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন এনামুল হকের স্বাধীনতা-পরবর্তী সাক্ষাৎকারেও জিয়াউর রহমানের নিজেকে রাষ্ট্রপতি, হেড অব স্টেট বা চিফ আর্মি কমান্ড দাবি করার মতো কোনো তথ্য নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ডে তাঁদের ওই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়।
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনকালে এহিয়া নামের এক বেতার কর্মকর্তা তার কাছে প্রস্তাব রেখেছিলেন, তিনি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে দেয়া ঘোষণার টেপ এমনভাবে সম্পাদনা করে দেবেন, যাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে অংশটি মুছে দেওয়া হবে। জিয়াউর রহমান তার বক্তব্য শোনার পর মন্তব্য করেছিলেনÑHistory cannot be deleted.. তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে, তিনি ক্ষমতা থাকাকালে স্বাধীনতা ঘোষণার প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নামটি মুছে ফেলতে চাননি। এটা সত্য বঙ্গবন্ধু নামটি মুছে ফেলা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জিয়াউর রহমান ছিলেন ২নং সেক্টর ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক। এই ফোর্স গঠন করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার। তিন মাস তিনি এই ফোর্সের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। দীর্ঘ ২৩ বছরের মুক্তি সংগ্রামে জিয়াউর রহমানের কোনো অবদান ছিল এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মতো যারা বিশ্বাস করতে চায় জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, তারা বাংলাদেশের দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রামকে অস্বীকার করে, মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে, মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্তবর্তীকালীন সরকার এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সব সরকারকে অস্বীকার করে। অর্থাৎ ইতিহাস বিকৃতির পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধকেই অস্বীকার।
স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিএনপির মিথ্যাচারের সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলে দাবি। এ ধৃষ্টতাপূর্ণ এই মিথ্যাচারের শুরু করেছেন তারেক রহমান। যিনি জিয়াউর রহমানের জ্যেষ্ঠ্ পুত্র। লন্ডনে প্যারোলে চিকিৎসাধীন আছেন। প্যারোলের নিয়মানুযায়ী তিনি এ সময়ে রাজনৈতিক বক্তব্য রাখতে পারেন না। এটা করা হলে তা প্যারোলের শর্ত ভঙ্গ করা হবে। তারেক রহমান সেখানে ২৫ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের এক আলোচনা সভায় জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবির পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বলেও দাবি করেন। একদিন পর ২৭ মার্চ ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিউশনে স্বাধীনতা দিবসের আলোচনাসভায় খালেদা জিয়াও একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। তিনিও জিয়াকে প্রথম রাষ্ট্রপতি বলে দাবি করলেন।
তর্কের খাতিরে তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির দাবিটি মেনে নিলাম। তবে এ প্রশ্নটি উঠে এসেছে, প্রশ্নটি অযৌক্তিক হবে না, ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি? এ জন্মকালটি নিশ্চয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের বাংলাদেশ নয়। এ বাংলাদেশ কোন বাংলাদেশ? খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়া গংদের কাল্পনিক অন্য দেশ? এ বাংলাদেশের জন্য হয়তো তাদের এতো হা-হুতাশ।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিদের ধারাবাহিক কার্যভার গ্রহণ ও কার্যকালের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় গঠিত এ সরকারে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করা হয়েছিল তাঁরই অনুপস্থিতিতে। তার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়েছিল ’৭০ এর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে। এ সরকারকে বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃৃতি দিয়েছে, কার্যত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের প্রথম বৈধ রাষ্ট্রপতি। জিয়াউর রহমান সামরিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের কাছ থেকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরে ১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন হলে সেখানে তিনি নির্বাচিত হন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে ছিলেন। তার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭১ সালের এপ্রিল ১২ থেকে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭৩ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন আবু সাঈদ চৌধুরী। এরপর মোহাম্মদ উল্লাহ (১৯৭৩ এর ২৪ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫ এর ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত), খন্দকার মোশতাক আহমেদ (১৫ আগস্ট ১৯৭৫-৬ নভেম্বর ১৯৭৫), আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম (৬ নভেম্বর ১৯৭৫-২১ এপ্রিল ১৯৭৭)। জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের আগে ছয়জন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ হচ্ছে ইতিহাসের সারকথা।
সমাজ ও রাজনীতিতে সবাই ‘নেতা’ বা ‘নায়কের’ স্থান করে নিতে পারে না, হাতে গোনা কিছু মানুষের পক্ষেই কেবল তা সম্ভব হয়। মাঝে মাঝে অসাধারণ ক্যারিশমা-সম্পন্নরা অবশ্য ‘বড় নেতা’ অথবা ‘মহানায়কের’ আখ্যায়ও ভূষিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। তারা সবাই সমসাময়িক কালের নেতা, চলতি পারিপার্শ্বিকতার প্রেক্ষাপটের নায়ক। কিন্তু ‘ইতিহাসের নায়ক’ হওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ সব কালে, সব যুগে সৃষ্টি হয় না। ইতিহাস আপন তাগিদেই তার ‘নায়কের’ উদ্ভব ঘটায়, আর সেই ‘ইতিহাসের নায়ক’-ই হয়ে ওঠে ইতিহাস রচনার প্রধান কারিগর-স্থপতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান দেশের একজন বড় মাপের নেতা ও রাজনীতির একজন মহানায়কই শুধু ছিলেন না, তিনি ছিলেন ‘ইতিহাসের নায়ক’। আরো সত্য করে বললে, তিনি ছিলেন ‘ইতিহাসের এক মহানায়ক’।
যারা ইতিহাস বিভ্রান্তি করছে। একদিন তাদের নামও মীর জাফরের মতো উচ্চারিত হবে। এটা ইতিহাসের দায়। এ দায় কেউ এড়াতে পারবে না। ইতিহাসকে নিয়ে যে-ই বা যারাই খেলুক, তাতে কিচ্ছু যাবে আসবে না। ক্ষমতার পালাবদল হয়তো হবে, কিন্তু ইতিহাস বদলানোর কোনো উপাদান কারো হাতে নেই। দীর্ঘদিন ধরে দেশে তরুণ প্রজন্মের লড়াই চলছে। এ লড়াই দীর্ঘমেয়াদী। নতুন প্রজন্মের এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য শেখ হাসিনার হাত হাত সবল করা বা খালেদা জিয়ার হাত দুর্বল করা নয়, এ আন্দোলন অতীত ইতিহাসের দায়-পরিশোধের আন্দোলন।
হাবীব ইমন: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কবি, গণমাধ্যমকর্মী।
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০১৪