আমার অনেক কিছুতেই লোকের আপত্তি! আপত্তির কারণ যে অজানা, তা নয়। কখনো কখনো আমার লেখা, বক্তব্য, মন্তব্য, অনেকের জন্য বিপত্তির কারণ ঘটায়।
শিক্ষিত হলেই যে তার মধ্যে যুক্তিপ্রবণতা কাজ করে তা নয়, বরং লেখাপড়া জানা লোকের মধ্যে কখনো কখনো যুক্তিহীনতা ভয়াবহ মাত্রায় বেশি। বেশি এই কারণে যে, প্রচলিত শিক্ষা তাকে একটা ছকের মধ্যে থাকতে, ভাবতে, শিখতে সাহায্য করে। এই ছক থেকে সে সহজে বেরুতে পারে না। ফলে ছকের বাইরে বা বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে কেউ তাকে কোনো বিষয়ে বললে, সে তখন প্রস্তুত থাকে না, তার কথা শুনতে। তখন স্বাভাবিকভাবেই বৃত্তের বাইরের মানুষটিকে শক্র বলে ভাবে। অথচ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এলেই, বাইরে এসে দাঁড়ালেই বরং মোহভঙ্গ ঘটে, নির্মোহভাবে দেখা যায়, ভাবা যায়, বোঝা যায় ভেতরে কি ঘটছে। ভেতরে থাকলে অনেক সময় বোঝা যায় না, বাইরে আসতে হয়।
অনেক সময় আমরা যা বলি তা করি না। সব সময় যে বুঝে করি না ব্যাপারটা তা নয়, না বুঝেও করি না অনেক সময়, যা বলি। মুখে আমরা সবাই প্রগতিশীল। বিজ্ঞানমনস্ক। প্রকৃতিপ্রেমী। প্রকৃতি ভালোবাসি, ভী-ষ-ণ ভালোবাসি বলে ফেনা তুলি মুখে। অথচ প্রকৃতি যে কী তাই বা ক’জনে বুঝি?
কখনো কখনো চারপাশ দেখে মনে হয় , আমরা বড্ড হুজুগে, সবাই করছে তাই আমাকেও তা করতে হবে, সবাই যাচ্ছে তাই আমাকেও যেতে হবে, সবাই খাচ্ছে তাই আমাকেও খেতে হবে। কেন, কি কারণে, কি করবো বা করব না- তা একটি বারের জন্যও ভাবি না, ভাববার চেষ্টাও করি না আমরা।
বৈশাখ। বর্ষবরণ। ঋতুচক্রের খেলা। এতো প্রকৃতিরই উৎসব। প্রকৃতিকে বরণ করে নেওয়ার, প্রকৃতির সঙ্গে মিলবার, নিজেকে মেলাবার উৎসব। একজন বাঙালি হিসেবে পহেলা বৈশাখকেই সবচেয়ে বড় উৎসব বলে মনে করি। এমন সার্বজনীন, অসাম্প্রদায়িক উৎসব বাঙালির জীবনে আর কোথায়? যেখানে দিপালী রায় কিংবা জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া, কনক বড়ুয়া কিংবা জোসেফ বাড়ৈ- সকলে এক হতে পারে। সকলে এসে গাইতে পারে বৈশাখের গান।
যতই পূজা বলি, ঈদ বলি, বড় দিন বলি, চিবরদানের উৎসব বলি- শেষ পর্যন্ত সবই তো ধর্মের উৎসব, ধর্মের বিভেদ। সব বিভেদ ভুলে প্রকৃতির এমন বন্দনার দিনটি আর কোথায়? কিন্তু সেকি! সেকি কান্ড! প্রকৃতির এই উৎসবে, এমন দিনে, এমন প্রকৃতিবিরোধিতা! হ্যাঁ, আমি প্রকৃতিবিরোধিতাই বলবো, পহেলা বৈশাখের নামে ইলিশ নিধন, প্রকৃতি বিরোধিতা ছাড়া কিছু নয়। ইলিশ বৈশাখের নয়। বৈশাখের সঙ্গে, ইলিশের কোনো সম্পর্ক নেই। বৈশাখের সঙ্গে ইলিশকে যুক্ত করে যে ইলিশ নিধন তা নেহায়েত পুঁজি, বাণিজ্য ও মুনাফা সর্বস্বতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
একটু লক্ষ করলেই দেখবেন, বুঝবেন- এই ইলিশ বাণিজ্য ও বাণ্যিজিক মিডিয়ার। যদি প্রকৃতি সম্পর্কে, প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্পর্কে ন্যূনতমও কোনো জ্ঞান থাকে তাহলেই বোঝা যায়, ইলিশের সঙ্গে বৈশাখের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রকৃতিই নির্ধারণ করে দিয়েছে কোন সময় কোন ফুল ফুটবে, কোন ফল ধরবে, কোন মাছ পাওয়া যাবে কখন। এইসময় ইলিশের প্রজননের। এখন ইলিশমিথুন কাল। ইলিশ এখন সঙ্গম করবে, যৌনসুখে সুখ সাগরে ভাসবে, সাত আসমান ঘুরে আসবে। এই সময় ইলিশ নিধন নিতান্ত প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজ। এখন ইলিশ খেলে ইলিশের বংশ বিস্তার হবে কিভাবে? আইনগতভাবেও এই সময় ইলিশ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে কী আইনও ভঙ্গ করছি না আমরা? তাজা ইলিশ, টাটকা ইলিশ বলে ‘সুপারশপে’ অতি উচ্চ মূল্যে যে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে তা কেন খাচ্ছি? এই ইলিশ তো স্বাদহীন, গন্ধহীন, বাসি। প্রকৃতি, আবহাওয়া, বিজ্ঞান কোন বিচারেই ইলিশ খাওয়ার সময় বৈশাখ নয়, বর্ষা।
আমার সুযোগ হয়েছিল খ্যাতিমান পুষ্টিবিদ সিদ্দিকা কবীরের সঙ্গে কাজ করার। তিনি ছিলেন খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ে দেশে-বিদেশে সম্মানিত পরিচিত নাম। তার কাছে একদিন জানতেও চেয়েছিলাম, বৈশাখবরণের খাদ্য তালিকা সম্পর্কে। তিনি বলেছিলেন, বৈশাখে ইলিশ খাওয়া নিতান্ত মুর্খতা, বিজ্ঞানহীনতা। আবহমান কাল থেকে গ্রামবাংলায়, বৈশাখের দিনে পান্তাভাত, যে কোন বড় মাছের ভাজা টুকরো, ছোট মাছের ঝোল, ডাল-সবজি চচ্চড়ি, নানা প্রকারের ভর্তা, টক দই- এ সবই বর্ষবরণে খাবার রীতি।
পুঁজি ও বাণিজ্য তার মুনাফার জন্য কত কিছুই না করে! কত কিছুই না ধ্বংস করে! ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম কোন কিছুই বাদ যায় না তার হাত থেকে। বর্ণবাদী পুঁজিবাদ কালো মানুষকে ফর্সা হতে বলে। স্লিম ফিগারের প্রচারণায় ‘বুলেমিয়া’র মতো রোগ ছড়িয়ে পড়ে। আধুনিকতার নামে কাপড় খুলে উদোম করে- মেয়েদের। লোম তুলতে ‘ব্লিচ ক্রিম’ বিক্রির হিড়িক পড়ে যায়। পুরুষদেরও ছাড়ে না পুঁজি, বাধ্য করে ‘মেন্স অ্যাকটিভ’ কিনতে। যৌনতা, যৌনাঙ্গেও হাত দেয় পুঁজি। রেহাই পায় না নারী-পুরুষ কেউই!
পুঁজির এই বাণিজ্যিক প্রচারণায় মিডিয়াও যুক্ত হয়, নিজেকে যুক্ত করে মুনাফার লাভে-লোভে। কারণ মিডিয়া, সেও তো পুঁজিরই!
জব্বার হোসেন: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, সাপ্তাহিক কাগজ ও মিডিয়াওয়াচ, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৪