বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বকর সিদ্দিক (এবি সিদ্দিক) অপহরণের ৩৫ ঘণ্টা পর মুক্তি পেয়েছেন। অপহরণের পর এবি সিদ্দিকের মুক্তি আমাদের স্বস্তি দিয়েছে।
কেন তাকে অপহরণ করা হয়েছিল? টাকার জন্য? বেলার নির্বাহী পরিচালক রিজওয়ানাকে ভয় দেখানোর জন্য? নাকি, এটা ছিলো একটি ‘সাজানো নাটক’?
টাকার জন্য যে এবি সিদ্দিককে অপহরণ করা হয়নি, এটা নিশ্চিত। কারণ, অপহরণকারীরা কোনো পর্যায়েই মুক্তিপণ দাবি করেনি। বরং এবি সিদ্দিকের ভাষ্য অনুযায়ী, তাকে ছেড়ে দেওয়ার সময় তার পকেটে ৩০০ টাকা গুঁজে দেওয়া হয়। যদিও এবি সিদ্দিক গণমাধ্যমের কাছে বলেছেন, তারা (অপহরণকারীরা) বলাবলি করছিলো যে, ‘অনেক টাকা পাওয়া যাবে’।
এবি সিদ্দিকও পরে বলেছিলেন, টাকার জন্যই তাকে অপহরণ করা হতে পারে। কিন্তু টাকার জন্য অপহরণ করলে টাকা চাওয়া হতো, কোথাও যোগাযোগের চেষ্টা করা হতো, মুক্তিপণ দাবি করা হতো। এমন কিছুই ঘটেনি।
আমরা ধরে নিতে পারি, টাকার জন্য রিজওয়ানার স্বামীকে অপহরণ করা হয়নি। এমন কোনো আলামতও আমাদের সামনে নেই।
অপহরণের পর থেকেই রিজওয়ানা বলে আসার চেষ্টা করছিলেন যে, তার কাজের ফলে(পরিবেশ সংগঠন বেলার কার্যক্রম) যাদের স্বার্থে আঘাত লাগতে পারে তারা কেউ এ কাজটি করতে পারেন। এমনকি রিজওয়ানা পুলিশের কাছে লিখিত এজাহারেও একথা বলেছেন।
রিজওয়ানা পরিবেশ আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক। পরিবেশ আন্দোলনে সচেতনতা সৃষ্টি এবং জাগরণ সৃষ্টির চেয়ে বরং প্রতিষ্ঠানটি মামলা মোকদ্দমার পথে গিয়ে বিভক্তির সৃষ্টি করে বেশি। বিশ্বের পরিবেশবাদী আন্দোলনের এখন মূল উপজীব্য হলো, সচেতনতা সৃষ্টি, বিরোধ সৃষ্টি নয়। কার্বণ নির্গমনের কারণে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো যখন বিপদাপন্ন, তখনও বাংলাদেশ, মালদ্বীপের মতো সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলো আন্তর্জাতিক আদালতে মামলার বদলে বিশ্বসভায় দেন-দরবার করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে মরণদশা, জলবায়ুর কারণে উদ্বাস্তুর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশ এখন এক ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে। এ বিপর্যয় নিরসনের চেষ্টাই হলো বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের প্রধান দিক।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রধান কারণ নিয়ে নয়। বাংলাদেশের প্রধান পরিবেশ সমস্যা যা উন্নত দেশগুলোর সৃষ্টি, তা আড়াল করতেই দাতারা তাদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় বেলার মতো সংগঠন গড়ে তুলেছে। যেমন, এক সময় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে কমিউনিস্ট বিপ্লব ঠেকাতে এনজিওর সৃষ্টি করা হয়। এসব এনজিও নদী দূষণ, শিল্প দূষণ, যানবাহন দূষণ ইত্যাদি বিষয়ে ২৫০টিরও বেশি মামলা করেছে।
মামলা করে পরিবেশ রক্ষা যে সম্ভব নয়, জার্মানির গ্রিন পার্টি তাদের ঘোষণাপত্রেই তা উল্লেখ করেছে। বিশ্বের পরিবেশবাদীরা এখন সামাজিক জাগরণ এবং জাতীয় ঐক্যকেই পরিবেশ রক্ষার প্রধান হাতিয়ার মনে করেন।
তাছাড়া পরিবেশ নিয়ে বেলা একা কাজ করছে না। সরকারের পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন) ছিলেন মুনীর চৌধুরী। পরিবেশ রক্ষায় তার সাহসী ভূমিকার জন্য তিনি প্রশংসিত হয়েছিলেন। বহু শিল্প প্রতিষ্ঠানকে তিনি জরিমানা করেছিলেন। কোথাও কেউ তাকে হুমকি দেয়নি কিংবা ভয়ভীতিও দেখায়নি।
আমাদের নিশ্চয়ই রোকনউদ্দৌলার কথা মনে আছে। পরিবেশ এবং ভেজালবিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন এক দৃষ্টান্ত। কই তাকেও তো কেউ হুমকি দেয়নি।
বেলার কার্যক্রমের বিরুদ্ধে কেউ বেলাকে বা তার নির্বাহী পরিচালককে হুমকি দিয়েছে এমন কথা আমরা শুনিনি। সাম্প্রতিক সময়ে এমন কোনো ঘটনাও ঘটেনি যাতে মনে হতে পারে, এই বিশেষ ঘটনার জন্যই ক্ষুব্ধ হয়ে এরকম একটি কাণ্ড কেউ ঘটাতে পারে। গত কিছুদিন ধরে বেলার কার্যক্রম নিয়ে তেমন কোনো আওয়াজও শোনা যায়নি। কেউ বেলার কাজে ক্ষুব্ধ হয়েছেন এমন খবরও আমাদের জানা নেই।
বেলার ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সর্বশেষ গত ১০ মার্চ বেলা বগুড়ার ধুনটে বাঙালি নদীর ওপর একটি বাঁধ নির্মাণে আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞা আদেশ নেয়। কাজেই সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে কেউ তার ওপর ক্ষুব্ধ হবে এমন সম্ভাবনা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবেশ নিয়ে শুধু বেলাই নয়, বহু সংগঠন কাজ করছে এবং ভালো কাজ করছে। যাদের কাজগুলো গণমাধ্যমে আসে না।
ইউরোপিয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ‘ডিপিকো’ প্রকল্প বাংলাদেশের পরিবেশ রক্ষায় ব্যাপক কাজ করছে। অ্যাকশন এইড, সেইভ দ্য চিলড্রেন, ওয়াটারএইড, চর লাইলি হুড- এর মতো সংগঠনগুলোও পরিবেশ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে। গণমাধ্যমের নজরে না এলেও তাদের কাজে বাংলাদেশের তৃণমূলের মানুষ কিছুটা হলেও পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাচ্ছেন। পাচ্ছেন বেঁচে থাকার বিকল্প পথের সন্ধান।
কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যম আজ এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যাতে মনে হয় পরিবেশ নিয়ে যা কিছু কাজ সব বোধহয় বেলা, আরো নির্দিষ্ট করে বললে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানই করছেন।
বাংলাদেশ হলো পরিবেশের দিক দিয়ে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা বিপদাপন্ন দেশ। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকই পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে রয়েছেন। এ থেকে রক্ষার জন্য বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো জাতীয় ঐক্য। কিন্তু কিছু সংগঠন কাউকে কাউকে পরিবেশের শত্রু বানিয়ে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছে। আর তাতে বাতাস দিচ্ছেন কিছু সুশীল। তারাই আবার কার্বণের বিষক্রিয়া সৃষ্টিকারী পশ্চিমা দাতাদের কাছে পরিবেশ রক্ষার আবদার করছেন। দাতারাও নিজেদের ‘অপরাধ’ আড়াল করতে সমর্থন দিচ্ছে এসব বেসরকারি সংগঠনকে।
ইউএনডিপি’র সর্বশেষ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, আমাদের পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য ৯০ শতাংশের বেশি দায়ী হলো পশ্চিমাদের যথেচ্ছ কার্বণ নির্গমন। অথচ বাংলাদেশে বেলার মতো সংগঠনগুলো এমন কাজ করছে, যাতে মনে হতে পারে কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানই বোধহয় বাংলাদেশের সর্বনাশ আনছে। তাই, প্রশ্ন উঠতেই পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর কাছে আমাদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের দাবিকে দূর্বল করতেই কি এই সংগঠনগুলো কাজ করছে?
এখন এবি সিদ্দিকের অপহরণের সঙ্গে আবার কারো কারো দিকে সন্দেহের তীর ছোঁড়ার পেছনে কি অন্য লক্ষ্য আছে? ঝিমিয়ে পড়া বেলাকে আবার চাঙ্গা করা কিংবা পরিবেশের আসল সমস্যাকে আড়াল করা? রিজওয়ানার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে কেন তার স্বামীকে অপহরণ করা হবে? অপহরণের পর আবার তাকে ছেড়েও দেওয়া হবে কেন? ক্ষুব্ধ হয়ে কেউ অপহরণ করলে আর যাই হোক দু’চার ঘা তো দিতো, জামাই আদরে অন্তত রাখতো না। আদর করে তিনশ’ টাকা বকশিশ দিতে না।
এ ‘অপহরণ নাটকে’ সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। গণমাধ্যম তাকে ‘সাহসিকা’ তকমা দিয়েছে। এর ফলে, তার পক্ষে জনমত তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতে যদি পক্ষপাতপূর্ণভাবে তিনি কারো চরিত্র হনন করেন, তা হলেও সেই ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি এ ঘটনার আতঙ্কে কোথাও ন্যায়বিচার প্রার্থনাও করতে পারবেন না।
কোনো অপহরণকারী কি এসব পূর্বাপর বিবেচনা না করেই কেবল রিজওয়ানাকে জাতির সামনে অজেয় করার জন্য এ রকম ‘নাটক’ করবে?
এবি সিদ্দিককে অপহরণ, মুক্তি, সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠে কলাবাগান পুলিশ চেকপোস্ট পর্যন্ত আসা- এ ঘটনাগুলোর মধ্যেও রয়েছে অনেক অসামঞ্জস্য, অনেক প্রশ্ন। ভবিষ্যতের জন্য, ন্যায়বিচারের স্বার্থেই এসব অসামঞ্জস্যের উত্তর খোঁজা দরকার।
সৈয়দ বোরহান কবীর, নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত
ই-মেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৪