ভারতের নির্বাচনে বিজেপি জিতেছে নাকি বিএনপি- বাংলাদেশে বিএনপি নেতাদের উচ্ছ্বাস দেখে তা বোঝা ভার। বাংলাদেশের সবক’টি পত্রিকায় বিএনপির উল্লাস নিয়ে প্রতিবেদন হয়েছে।
মোদীর বিজয়ের পর বিএনপির বগল বাজানোর মতো কী এমন ঘটনা ঘটল সেটা বোঝা উঠতে পারছেন না অনেকেই। বিএনপি কি ভাবছে, মোদী এসে তাদের ক্ষমতার চেয়ারে বসিয়ে দেবে? এমন না ভাবলেও তার কাছাকাছি কিছু একটা ভাবছে এটা যে কেউ বোঝেন। বিএনপির এতো খুশি হওয়ার পেছনে বিজেপির সঙ্গে বিএনপির কোনোকালে বা কস্মিনকালেও কোনো মধুর বা আনন্দিত হওয়ার মতো ঐতিহাসিক কোনো সম্পর্ক ছিল কি-না তা খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। ‘অদ্ভুত সব মিল’ টাইপের চটি বইয়ে কেনেডি ও লিঙ্কনের জীবনের মতো সঙ্গে বিজেপির কিছু বিষয়ে মিল খুঁজে বের করা যায়।
ইতিহাসে ঘেঁটে দেখা যায়, মুসলিমলীগকে প্রতিরোধের লক্ষ্যে হিন্দুবাদী কিছু নেতা ১৯১৫ সালে 'হিন্দু মহাসভা' নামে একটি দল সৃষ্টি করেন। হিন্দু মহাসভাই পরে ১৯৮০ সালে হয় বিজেপি।
মহাসভার স্বনামে পরিচিত এক কর্মী নাথুরাম গডসের হাতে ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর পর এই হিন্দু মহাসভার বিনাশ ঘটে। এরপরই মহাসভার নেতারা নাম পাল্টে ১৯৫১ সালে 'ভারতীয় জনসঙ্ঘ' নামে নতুন দল তৈরি করেন । ভারতীয় জনসঙ্ঘ ১৯৮০ সালে হয় ভারতীয় জনতা পার্টি। বিএনপির সঙ্গে এখানেই মিল বিজেপির। বিএনপিও একাত্তরের পর বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত দল মুসলিম লীগের কর্মীদের দ্বারা সংগঠিত এবং মুসলিম লীগের উত্তরসূরি। দু’টি দলই এন্টি-সেকুলার, ধর্মনিরপেক্ষবিরোধী। দু’দলেরই সৃষ্টি সমসাময়িক সময়ে। দু’দলই জাতির জনক হত্যার উসকানিতে অভিযুক্ত। এছাড়া দু’দলের ঐতিহাসিক কোনো সম্পর্ক টানা অসম্ভব।
তবু মোদীর জয়ে বিএনপি একটি অসম্ভব সুখস্বপ্নে বিভোর। হাসিনা সরকারকে উৎখাত করা সময়ের ব্যাপার। এবার বিএনপিও ক্ষমতায় আসবে। বিএনপির আনন্দ চোখে মুখে উপচে পড়ছে। আনন্দ দেখে কেউ মন্তব্য করতে পারেন, বিশ্বের সর্ববৃহৎ গনতান্ত্রিক এ দেশের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে বিএনপির কোনো ধারণা নেই বোধহয়। কেননা ভারতে সরকার পাল্টালেও তাদের বিদেশনীতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয় বলে দেখা যায় না। এছাড়া কাঠামোগতভাবে শৃঙ্খলে প্রধানমন্ত্রী যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারেন না। সেটা যদি হয়ও, তবে আওয়ামী লীগের বাংলাদেশের জন্য একটু বেশি দুশ্চিন্তার। অবৈধ বাংলাদেশি ইস্যু, ছিটমহল ইস্যু, তিস্তা ইস্যুতে বাংলাদেশ বেকায়দায় পড়তে পারে। ।
বিএনপির অস্থির মতিত্বের কারণে এর বিদেশ বিষয়ক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো ইতোপূর্বে সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিদেশি শক্তির উপর অতি নির্ভরতা তাদের জাতীয়তাবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ওয়াশিংটন পোস্টে চিঠি লেখা অতঃপর অস্বীকার, প্রণবের ঢাকা সফরে খালেদা জিয়ার দেখা না করার অসৌজন্যতা, মার্কিন দূতের বাসায় গোপন যাতায়াত, তার উপর ঈশ্বরসম নির্ভরতা- এগুলোই বিএনপিকে ডোবাতে কাজ করেছে।
এখন প্রশ্ন হলো- কেন হঠাৎ বিএনপির মনে হলো ভারত তাদের পাশে থাকবে। সারাজীবন ভারত বিরোধিতা করে এখন কেন তারা পাকিস্তানমুখী কেবলা পরিবর্তন করে ভারতমুখী হচ্ছেন? তাও আবার গুজরাটে মুসলমানদের রক্তে হাত রাঙানো মোদীর মতো দাঙ্গাবাজ হিন্দু নেতার আনুকূল্য পেতে মরিয়া হয়েছেন। ধর্মকর্ম কোথায় গেল? অতীতের মতো তারা কী এখনো জনগণের পরিবর্তে বিদেশি রাষ্ট্রকে ক্ষমতার উৎস মনে করেন? এসব প্রশ্নের উত্তর তাদের কাছে মানুষ জানতে চাইবেই। এর চেয়েও বড় প্রশ্ন, বিজেপিই বা কেন বিএনপিকে সমর্থন দেবে?
এর একটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে। বিজেপি ও বিএনপি দুটোই মৌলবাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়। এছাড়া বিএনপির সঙ্গে জামায়াত রয়েছেই। বিশ্বব্যাপী মৌলবাদী দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের গোপন সম্প্রীতি ও আত্মিক টান লক্ষ্য করা যায়। এক নেশাসক্ত ব্যক্তি যেমন আরেক নেশাসক্ত ব্যক্তির প্রতি আত্মিক টান দেখায় ঠিক তেমন টান। এরা স্বগোত্রীয় না হলেও চারিত্রিক বিচারে স্বজাতীয়। তাই পৃথিবীর এক প্রান্তের মৌলবাদীরা অন্য প্রান্তের মৌলবাদীদের আনুকূল্য পাবে এমন তাত্ত্বিক আশা করাই যেতে পারে। সেই হিসেবে আশার আলো আছে। এছাড়া আর কোনো আলো সুড়ঙ্গে নেই।
কিন্তু এটা শুধুই একটি কথিত তত্ত্ব। বিএনপির ক্ষেত্রে এর সম্ভাবনা জিরো। এই তত্ত্ব কিতাবে আছে, কিন্তু গোয়ালে যদি কাজ না করে তখন বিএনপির ভবিষ্যৎ কী? আশার গুড়ে যদি পুরোটাই বালি মাখা হয়, তখন? তখনতো কর্মীদের কাছে ভারতবিরোধী ইমেজও থাকবে না। তখন বিএনপির করণীয় কী। এখনই তার ছক করে ফেলা দরকার।
মনোয়ার রুবেল
ইমেইল: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৫ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৪