বৃহস্পতিবার আইনমন্ত্রীর একটি বক্তব্য নিয়ে নানা মহলে আলোচনা সমালচনার ঝড় বইছে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়তের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের প্রস্তুতি যখন প্রায় চূড়ান্ত, তখন বৃহস্পতিবার রাতে সুপ্রিমকোর্টে ইউএনডিপি’র এক সেমিনার শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দল হিসেবে জামায়াতের বিচার করা যায় না বলে মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী।
উনি এমন একটা সময় এই ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন যখন পত্র-পত্রিকায় রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুঁলিদের মতবিরোধ নিয়ে খবর প্রায়ই আসছে। এছাড়া আইনের বিষয়টি উনি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সেখান থেকে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ, যারা আইন বোঝেন না তাদের ধারণা- জামায়াতের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে একটি মামলা বিচারাধীন, সেসময় আরেকটি মামলা ট্রাইব্যুনালে চলতে পারে কি-না সেটি নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। এছাড়া তিনি বলেছেন, দেশের প্রচলিত আইনে কোনো কোম্পানির শাস্তি হলে তা ভোগ করে পরিচালনা পর্ষদ। এক্ষেত্রে জামায়াতের শাস্তি হলে তা ভোগ করতে হবে জামায়াত নেতাদের।
ইতোমধ্যে এই নেতাদের অনেকের বিচার হয়েছে বা হচ্ছে। সুতরাং, একই ব্যক্তির দু’বার বিচার কীভাবে করা যায় তা ভাবতে হবে মলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
আমরা যারা সাধারণ মানুষ, আইন বিশেষজ্ঞ নই, তাদের মনে প্রথম যে প্রশ্ন সামনে আসবে তা হলো- ধরুন এক ব্যক্তি তার প্রতিবেশীর বাসায় ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন ধরিয়ে দিলো, তাহলে নিশ্চয়ই ওই বাসার মালিক তার বিরুদ্ধে মামলা করবে। এখন ওই একই ব্যক্তি যদি আরেক বাসার কোনো মেয়েকে ধর্ষণ করে, তাহলে তারাও নিশ্চয়ই মামলা করবে। সেই ব্যক্তিটি যদি অন্য কাউকে খুন করে বসে তাহলে তারাও নিশ্চয় মামলা করবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই তিন মামালা কি তাহলে একসঙ্গে চলতে পারবে না? কিংবা তিন মামলায় শাস্তিও তো তিন রকম হওয়ার কথা! তাহলে কি সেই ব্যক্তিটির কেবল এক মামলার শাস্তি হবে!
এবার ধরুন একটা প্রতিষ্ঠান কিংবা সংগঠন যারা নানাভাবে মানুষকে হয়রানি, প্রতারণা করে যাচ্ছে কিংবা জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত। তাহলে কি আপনি সেই প্রতিষ্ঠানের নেতাদের বিচার করেই ক্ষান্ত হবেন? নাকি সেই সংগঠনটির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেবেন।
আমরা তো অন্তত এতটুকু জানি দেশে হরকাতুল জেহাদসহ এরকম বেশ কিছু সংগঠন নিষিদ্ধ রয়েছে। তাহলে সেটি ঠিক কোন আইনে করা হয়েছিলো- এ প্রশ্নও কিন্তু চলে আসে।
এখন যদি একই ব্যক্তির একাধিকবার বিচার করা না যায় কিংবা সংগঠনের বিচার না করে কেবল সংগঠনের নেতাদের বিচার করা হয় তাহলে এর ফলাফল কেমন হতে পারে সেটি ভেবে দেখার বিষয়।
আইনমন্ত্রী ঠিক কোন পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলেছেন সেটি তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তিনি নিশ্চয়ই এর ব্যাখ্যা দেবেন যাতে আমারা সাধারণ মানুষ অন্তত বুঝতে সক্ষম হই তিনি ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছেন। তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন প্রচলিত আইনে জামায়াতের বিচার দল হিসেবে সম্ভব নয়, আইন পরিবর্তন করতে হবে; নাকি জামায়াতের বিচার আপাতত সম্ভব নয়!
আইনমন্ত্রীকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের কাদের মোল্লার ফাঁসির বিষয়টি ওনাকে ব্যাখ্যা করতে হয়। ওনার তো নিশ্চয়ই জানা থাকার কথা, আমাদের দেশে ফাঁসি দেওয়ার বিধান আইনেই আছে। যদি থেকে থাকে তাহলে ব্যাখ্যা দিতে সমস্যাটা কোথায়। একজন চিহ্নিত ও প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধী যদি বিচারে ফাঁসি হয় তাহলে তো তাঁকে ফাঁসিই দিতে হবে।
ইউরোপ-আমেরিকার সরকার কিংবা প্রতিনিধিরা প্রায়ই মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে থাকে। ওনাদের মানবাধিকারের এই দোহাই ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের বেলায় কই ছিলো? পাকিস্তানে যখন ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা হয়, আর সেই দৃশ্য আমেরিকার প্রেসিডেন্টসহ অন্যরা সরাসরি দেখছিলেন, তখন কি ওনাদের মনে হয়নি বিচারের সুযোগ না দিয়েই একজন মানুষকে তারা হত্যা করে ফেললো। অপরাধী, তা সে যেই হোক তাকে তো আইনের মাধ্যমেই বিচার করতে হয়। তাহলে তখন এসব দেশের মানবাধিকার কোথায় ছিলো?
ভুলে গেলে চলবে না বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সুস্থভাবে করবে সেই আশ্বাস দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছিলো। পুনর্বার যখন তারা ক্ষমতায় আসে, লোকজন অন্তত ভেবে রেখেছে, জামায়াত শিবিরের তাণ্ডব থেকে হয়তো মুক্ত হবে দেশ। তবে বৃহস্পতিবার আইনমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন এরপর কিন্তু মানুষের মনে প্রশ্ন উঠবেই তাদের আন্তরিকতা নিয়ে। এছাড়া ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুঁলিদের মধ্যেও বিরোধ রয়েছে বলে প্রায়ই শোনা যায়। এখন এই বিরোধ তাদের আন্তরিকতা নিয়ে কিনা সে প্রশ্নও সামনে চলে আসবে। আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের পরে বিভিন্ন আইন বিশেষজ্ঞও বিষয়টি ব্যাখ্যা করছেন। এসব মতবিরোধ কিন্তু শেষ পর্যন্ত জামায়াত নিষিদ্ধে সরকারের আন্তরিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলবে।
কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধেই কিন্তু শাহবাগ আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিলো। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের পরও শাহাবাগের তরুণরা কিন্তু তাদের দাবি থেকে সরে আসেনি। ছয় দফা যে দাবি ছিলো এর মধ্যে অন্যতম ছিলো জামায়াত শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। এখন সে দাবি যদি হুমকির মুখে পড়ে তাহলে শাহবাগের তরুণরা কিন্তু আবার জেগে উঠবে। এদেশের তরুণরা কখনোই কোনো অন্যায় মাথা পেতে নেয়নি। তাই অনতিবিলম্বে জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধের বিষয়টি পরিষ্কার করাই বাঞ্ছনীয়।
আমিনুল ইসলাম: গবেষক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট
ইমেইল- [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১২১৮ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৪