ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

'চিলড্রেন অব ওয়ার' চলচ্চিত্রে যুদ্ধশিশু কতটা ব্যক্ত এবং ....

আইরিন সুলতানা, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪১ ঘণ্টা, জুন ৭, ২০১৪
'চিলড্রেন অব ওয়ার' চলচ্চিত্রে যুদ্ধশিশু কতটা ব্যক্ত এবং .... ছবি : সংগৃহীত

ভারতীয় চলচ্চিত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে উপস্থাপনে কার্পণ্য নেই, তবে পরিবেশনায় খুঁত আছে।   'গুন্ডে' সিনেমাটি আমাদের মাঝে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে।

উচ্চবাচ্য না হলেও  'গয়নার বাক্স' সিনেমাটির শেষাংশে ১৯৭১  দৃশ্যায়ন  বাধো বাধো ঠেকেছে অনেকের। এর মাঝেও ১৯৭১-কে ধারণ করে ভারতীয় নির্মাতার চলচ্চিত্র 'চিলড্রেন অব ওয়ার' মুক্তি পূর্বকালেই আমাদের মাঝে আগ্রহ জাগিয়েছিল।

সেন্সরবোর্ড 'দ্য বাস্টার্ড চাইল্ড' নামকরণ অনুমোদন করেনি। চলচ্চিত্র মুক্তি পায় 'চিলড্রেন অব ওয়ার' শীর্ষকে। বাংলা নামকরণ 'যুদ্ধশিশু'। বাংলাদেশের জন্মগাঁথায় অবিচ্ছেদ্য দু'টো অনুচ্ছেদ। বীরাঙ্গনা। যুদ্ধশিশু। নয় মাস যুদ্ধ পরিশেষে যেমন জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ, তৎসঙ্গে জন্ম নিয়েছিল বীরাঙ্গনা গর্ভে যুদ্ধশিশু। চার লাখ নারী বিভৎস নির্যাতনে বিক্ষত হয়েছিল নয় মাসে। একেকটা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে রক্তাক্ত হয়েছিল নারী। এমনই এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি নারীদের অবর্ণনীয় জীবন চিত্রিত হয়েছে 'চিলড্রেন অব ওয়ার' -এ। কিন্তু যুদ্ধশিশু কতটা ব্যক্ত হয়েছে এই চলচ্চিত্রে?

‘যুদ্ধশিশু’র সেলুলয়েডে ‘৭১ এর ইতিহাস পরিস্ফুটিত হয় বর্তমান প্রজন্মের ভেতর দিয়ে। এই বর্তমান প্রজন্ম শাহবাগ গণজাগরণের আদলে উপস্থাপিত। কাহিনী ফিরে যায় ১৯৭১ এ।   ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষ্যাৎকার যুক্ত হয়েছে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সমর্থন ও সহায়তা নিয়ে  মানবিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দ্যর্থহীন সিদ্ধান্ত  জানান দিচ্ছেন ইন্দিরা গান্ধী।

২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার আবহ নির্মাণ একটি প্রশংসাযোগ্য চিত্রায়ন। স্বল্পক্ষণের এই শটটি বোদ্ধা দর্শকের ভেতর চাহিদা জাগাবে- আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে একটি কালজয়ী চলচ্চিত্র নির্মিত হোক। এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সিনেমায় বাংলাদেশি নির্মাতার হাতে বঙ্গবন্ধুকে চিত্রিতকরণ প্রচেষ্টা শূন্য।

'কিল থ্রি মিলিয়নস অব দেম', ইয়াহিয়া খানের সেই নিষ্ঠুর নির্দেশকে শিরোধার্য করে পাক সেনারা ছেয়ে গেল দেশ জুড়ে। তাদের অত্যাচারের পরিকল্পনায় নারী সম্ভ্রম লু্ণ্ঠন ছিল যেন গুরু দায়িত্ব। সে আদর্শে বলীয়ান পাক সেনা অফিসার মালিক। ফিদা-আমির দম্পতির শয়নকক্ষে অতর্কিতে প্রবেশ করে আটক স্বামীর সামনেই বিবস্ত্র স্ত্রীকে ধর্ষণ করে মালিক। ’৭১ এর ভয়াবহতা শরীরের প্রতিটি রোমকূপে অনুভব করার জন্য প্রস্তুত ছিল না ফিদা। কিন্তু কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে অসংখ্য নগ্ন-অর্ধনগ্ন নারীর সাথে অন্ধকার ঘরে কাটিয়ে, বারবার ধর্ষিত হয়ে স্বাধীনতার মূল্য পরিশোধ করতে হল ফিদাকে।

নারীর প্রতি সহিংসতার সব সীমা অতিক্রম করেছিল পাকসেনারা ১৯৭১ -এ। যুদ্ধশিশু চলচ্চিত্রে পাক বাহিনীর যৌন রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব ধ্বনিত হয় অফিসার মালিকের কণ্ঠে। প্রতি নারী অন্ত:সত্ত্বা হয়ে জন্ম দিক পাকি বীর্যজাত সন্তান, যেন বাংলাদেশ জন্ম নিলেও এদেশে উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারে পাকসেনারা।

পূর্ব পাকিস্তান যে স্বাধীনতা চেয়েছিল 'বাংলাদেশ' রূপে, তা ক্ষতবিক্ষত করতে সহজ শিকার হয়েছিল আমাদের নারীরা। লরির খাটো দরজাটা খুলে দিতেই  হাত-পা বাঁধা নারীরা ঝুপ ঝুপ করে মাটিতে পড়ল একে অন্যের গায়ে। মাটিতে পড়ে থাকা নারীস্তুপ দেখে মনে হয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে গবাদিপশুর মত অসহায় ছিল নারীরা। নন্দিতা দাশের 'ফিরাক (Firaaq)'  চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যের সাথে এই দৃশ্যটির সাদৃশ্য আছে বলে এনডিটিভি'র ওয়েবসাইটের মুভি রিভিউয়ে লেখা হয়েছে।  

নির্যাতন ক্যাম্পে আনা নারীদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বয়স বিবেচনায় বিভক্ত করা হয়। সন্তান জন্মদানে অক্ষম ধারণায় চল্লিশোর্ধ্ব নারীদের গুলি করা হয়। বাকি নারীরা একত্রে ক্যাম্পের অন্ধকার কক্ষে এই আশংকায় সময় বাহিত করে, এরপর কে পুনরায় ধর্ষিত হবেন? ক্যাম্পের বর্বরতায়  কোন কোন নারী মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন, এক নারী সদ্য ধর্ষিত- অপর নারীকে আগলে রেখে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেছেন, আর এক নারী বনেছেন গেরিলা।

ক্যাম্পের গার্ডদের চোখে ফাঁকি দিয়ে কৌশলে বিথীকা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পৌঁছে দিয়েছে অস্ত্র-বারুদ। জানিয়ে দিয়েছে পাক সেনাদের গতিপথ। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল সফল হামলা চালায় পাকসেনা জিপে। এক গেরিলা হামলায় বিথীকা পরিচিত হয় আমিরের সাথে। জানতে পারে ফিদাকে খুঁজছে আমির। বিথীকা শেষ পর্যন্ত ক্যাম্প পাহারাদারের হাতে ধরা পড়ে। ক্যাম্পের সব নারীর সামনে রাতভর উপুর্যপরি গণধর্ষণে মৃত্যু হয় তার।

বিথীকার সূত্র ধরে ক্যাম্পে হামলা চালায় মুক্তিযোদ্ধা দল। অবশেষে ফিদা আর আমির পুনরায় মুখোমুখি হয়। ফিদার গর্ভে তখন যে মাংসপিণ্ড বেড়ে ওঠা শুরু করেছে, তার পরিচয় সংকটের আভাসেই ফিদা পিছু হটে মুহূর্তেই। কিন্তু তাকে ফেরায় আমির। সেলুলয়েডে পুনরায় আজকের প্রজন্মের আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা সেই তরুণ, যে নিজের পরিচয় দেয় বীরাঙ্গনার দৌহিত্র হিসেবে।   তরুণ গর্বের সাথে জানায়, পাকি সেনা অফিসার তাকে পাকিস্তানি বানাতে পারেনি। সে একজন বাংলাদেশি, বাঙালি আর মুসলমান। তরুণের সামনে গর্বিত অশীতিপর আমিরকে দেখানো হয়েছে, কিন্তু ফিদাকে আর দেখানো হয়নি। আমরা কোন যুদ্ধশিশুকেও দেখিনি পর্দায়।  

যুদ্ধশিশু মুক্তিপ্রাপ্তির পূর্বে এর প্রচারে রাইমা সেন দর্শক আগ্রহের কেন্দ্র ছিলেন। তিনি এ চলচ্চিত্রে ফিদা চরিত্র রূপায়ন করেছেন। আমির চরিত্রে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত। ভিক্টর ব্যানার্জি এবং প্রয়াত ফারুখ শেখ ছিলেন দু'টো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। সব শিল্পীই অভিনয়ে সাম্য রক্ষা করে গেছেন। মালিক চরিত্রে পবন মালহোত্রা অনবদ্য ছিলেন। তার অভিনয়, পাক সেনাদের প্রতি ঘৃণা জাগাবে। ফিদা চরিত্রে রাইমা সেন স্রেফ উৎরে গেছেন।

খোদ ভারতীয় মুভি রিভিউয়েও বলা হয়েছে, একজন নির্যাতিতা নারী চরিত্রে রাইমা সেনের মুখশ্রী সৌন্দর্যই প্রাধান্য পাচ্ছিল। এই পর্যালোচনা রাইমা সেনের একার ব্যর্থতা নাকি নির্মাতার সচেতন বাণিজ্যিক ফ্রেমিং তা প্রশ্নবাচ্য। কারণ, যুদ্ধাহত নারী চরিত্র রূপায়নকারীর অভিব্যক্তি, সজ্জা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে স্মরণ করা যায়, নাসিরুদ্দিন ইউসুফ পরিচালিত ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রটিকে। কেন্দ্রীয় চরিত্রে জয়া আহসান বহুমাত্রিক ছিলেন। আহ্লাদি স্ত্রী থেকে স্বামীহারা স্ত্রী, শাশুড়ির গঞ্জনা সহ্যকারী পুত্রবধু, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাকারী সাহসী নারী সাধারণ সাজসজ্জার জয়াই আবার এক দৃশ্যে চোখ ধাঁধানো গ্ল্যামারে হাজির হন পর্দায়। আবার সেই জয়াকেই একই চলচ্চিত্রে কালিঝুলি মাখা মুখে হাতে গ্রেনেড নিয়ে পাক সেনা অফিসারের সম্মুখে চণ্ডিকারূপে আর্বিভূত হতে দেখা যায়।

‘যুদ্ধশিশু’তে রাইমা সেনের চরিত্রে এতসব বৈচিত্র্য ছিল না, তবে ফিদা চরিত্রে নির্যাতিত নারীর মুখাভিব্যক্তিই সব, যা ফুটিয়ে তুলতে স্পষ্টতই রাইমা সেনকে বেগ পেতে হয়েছে। বিথীকা চরিত্রে তিলোত্তোমা সোম নির্যাতিত নারীদের মাঝে জলন্ত বারুদ। ক্যাম্পে নিয়ত ধর্ষিত নারীদের মত তাকেও স্বল্পবসনা দেখানো হয়েছে, তবে কোথাও যেন আবেদনময় উপস্থাপন ছিল। পোস্টার বা ডিভিডি কাভারের জন্য ব্যবহৃত চলচ্চিত্র থেকে নেয়া একটি স্থিরচিত্রে তাঁবুর ভেতরের নারী ছায়াশরীরেও ফুটে উঠেছে আবেদন, অথচ ওই নারীটিকে ধর্ষণের জন্য তাঁবুতে আনা হয়। এই স্থিরচিত্রে নারী ছায়া অবয়বে অসহায়ত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিবস্ত্র নির্যাতিত নারী আবেদনের প্রতীক নয়,  এ বোধদয় ঘাটতি পূরণ ব্যতীত ১৯৭১ এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র নির্মাণ কারিগরি মানে উৎরে যাবে, কিন্তু স্বত:সিদ্ধ ইতিহাস হবে না।

'৭১ এ অবমাননার শিকার নারীরা চুল পেঁচিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করতেন বলে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নারীদের  বিশেষত লম্বা কেশধারীদের ন্যাড়া করে দেয়া হত, নয়তো ছোট করে ছেঁটে দেয়া হত মাথার চুল। পরনের কাপড় দিয়েও ফাঁস দেয়ার চেষ্টা হত বলে নারীদের গায়ে কোন বসন ছিল না। বীরাঙ্গনাদের নিয়ে অসংখ্য প্রামাণ্যচিত্রে এ সব তথ্য দেয়া আছে। পরিচালক নির্যাতন ক্যাম্পের নারীদের এমন দুর্দশাচিত্রও তুলে ধরতে পারতেন চলচ্চিত্রে। কেবল তরুণী- যুবতিরাই ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন তা নয়, কেবল পাকি উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতেই ধর্ষণযজ্ঞ চালায়নি পাকিসেনারা। ৭ থেকে ৭৭ বছরের নারীও ধর্ষিত হয়েছেন। অন্ত:সত্ত্বা নারীও ধর্ষিত হয়েছেন, ধর্ষণের পর হত্যা হয়েছে। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে তাদের উদর। নির্মাতা নারী নির্যাতনের এই নৃশংস দিকটি তুলে আনেননি।

কারিগরি দিক বিবেচনায় প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে নির্মাতা বহু শটে মুনশিয়ানার স্বাক্ষর রেখেছেন। রক্তস্রোতে ভেসে যাওয়া গলিপথের নালা,  মৃত মায়ের পাশে ক্রন্দরত শিশু-দৃশ্যুগুলো স্তম্ভিত করে দেবে। ‘চিলড্রেন অব ওয়ার’ এর সিনেমাটোগ্রাফি অসাধারণ। কথায়, সুরে, গায়কীতে হিন্দি-বাংলা উভয় সংস্করণেই চলচ্চিত্রের গানগুলোর প্রতি স্তবক শিড়দাঁড়া বেয়ে নেমে আসে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা কতটা তমসাগ্রস্ত ছিল একাত্তরে তাও ফ্রেমবন্দি হয়েছে। বোনের নিরাপত্তা বর্ম হয়ে থাকা রফিক নামক বালকটি যে মুহূর্তে থান ইট হাতে ক্রমাগত আঘাতে হত্যা করে এক পাক সেনাকে, সে এক মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠে, কিন্তু সে বিসর্জন দেয় তার কৈশোর। হত্যাযজ্ঞ পাকসেনাদের কাছে হোলিখেলার মত হয়ে উঠেছিল। গুলি করে গরু হত্যার দৃশ্যটি চমকে দেবে দর্শকদের। অন্যদিকে পাকসেনাদের ভয়ে জঙ্গলে আত্মগোপনে থাকা পরিবার কোলের শিশুর কান্না থামাতে মুখ চেপে রাখে। খানসেনাদের হাত থেকে পরিবারটি সেসময় বেঁচে যায়, কিন্তু শিশুটি যে মায়ের কোলে দু'দিন আগে ভূমিষ্ট হয়েছিল, সে মায়ের কোলেই মারা যায়।   মৃত্যুর মত অমোঘ নিয়তি নিয়েই মানুষ বাঁচে। মৃত্যু ততটা ভয়ানক নয়, তবে মৃত্যুর এহেন ধরন মৃত্যুকে বিভীষিকাময় করে তোলে। একাত্তরে মৃত্যুবিভীষিকা দেখেছিল এ জাতি। তারই খণ্ড খণ্ড রূপ দেখা গেছে যুদ্ধশিশু চলচ্চিত্রে।

পরিচালক মৃত্যুঞ্জয় দেবব্রত অবশ্য ইতিহাস বিকৃতির ডিসকোর্স এড়াতে সচেতন ছিলেন বলে ধারণা করা যায়, তবে ইতিহাস পাঠের সূত্র এবং ইতিহাস গবেষণায় কতখানি সময় ব্যয়িত হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা ন্যায্য। চলচ্চিত্রে আজকের প্রজন্মের যুবকের মুখে ছিল বাঙালি, বাংলাদেশি, মুসলমান পরিচয়। কিন্তু এ জাতির মুক্তিযুদ্ধ কেবল মুসলমান পরিচয় উদ্ধারে ছিল না। বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলমান, এরাই তো ছিল আমাদের প্রেরণা একাত্তরে।

চলচ্চিত্রে যে ধরনের নাম ব্যবহৃত হয়েছে, তা ঠিক বাংলাদেশের সামাজিক আবহের সাথে যায় না। যেমন, ফিদা কিংবা আমির, বা কয়সর (কায়সার নয়) নামগুলো অনেকবেশি ভারতীয় মুসলিম ঘরানার। পাকিস্তানি ঘরানাতেও এ ধরনের নামের চল স্বাভাবিক। বাংলাদেশের ইতিহাস  ভিত্তিক চলচ্চিত্রে এ ধরনের নামের ব্যবহার আলাদা শোনায়।   

‘চিলড্রেন অব ওয়ার’ মূলত হিন্দি ভাষায় নির্মিত, যা পরে বাংলা ডাবিং ও সাবটাইটেলযোগে যুদ্ধশিশু নামে মুক্তি পায়। সম্ভবত রাইমা সেনের পরামর্শে হিন্দির পাশাপাশি বাংলা সংস্করণও করা হয়। এই উদ্যোগ ধন্যবাদযোগ্য। কেবল মাত্র উর্দু সংলাপগুলোকে  কাহিনীর প্রয়োজনে উর্দুতে রাখা হয়। হিন্দি ব্যতিরেকে যারা বাংলা সংস্করণ দেখেছেন, তাদের কাছে যুদ্ধশিশু চলচ্চিত্রকে গ্রহণ করা দু:সাধ্য হয়ে উঠছিল সংলাপের উচ্চারণগত জটিলতায়। কোলকাতার বাংলা আর আমাদের বাংলা ডায়লেক্টে তফাৎ রয়েছে। কোলকাতার সিনেমায় তাদের ঢংয়ে বলা সংলাপ যতটা মানানসই, বাংলাদেশের জন্মইতিহাস নিয়ে চলচ্চিত্রে ততটাই বেমানান। ডাবিংয়ের জন্য বাংলাদেশি শিল্পীদের সহায়তা নিলে কাজটিতে দক্ষতার ছাপ মিলত। ‘যুদ্ধশিশু’র অধিকাংশ বাংলা সংলাপে আঞ্চলিক ও চলতিশুদ্ধ ভাষার সংমিশ্রণ, তাও আবার একই সংলাপে, পীড়াদায়কই বটে। আমিরের বেঁচে থাকার খবর শুনে ফিদার সংলাপ 'আমির জিন্দা আছে', যেখানে 'জিন্দা আছে' নয়, হতে হবে 'বেঁচে আছে'। জিন্দা শব্দটি বাংলাতে খুঁজে পাওয়া গেলেও এর ব্যবহার পরিসর নিত্য নয়।

বরং উর্দু-হিন্দিতে 'জিন্দা' শব্দের ব্যবহার নিয়মিত। বাংলা সংলাপের সাবটাইটেলে অনেক বানান ভুল দেখা যাবে। যেমন, গেরিলা শব্দটিকে ‘গরিলা’ লেখা হয়েছে। সাবটাইটেলে যে ফন্টে বাংলা দেখানো হয়েছে, তা দৃষ্টিকটু ঠেকেছে।   চলচ্চিত্র ক্রু'তে যারা ছিলেন, তারা মেকিংয়ে অনেক বিষয়ে দক্ষতার ছাপ রাখলেও, এই ক্ষেত্রগুলো দুর্বল ছিল।

চিলড্রেন অব ওয়ার চলচ্চিত্রের পুরো টিমকে নির্মাণের পূর্বে, নির্মাণকালে ও পরে এদেশের ইতিহাসবিদ, শিল্পীদের সাথে মেলবন্ধন গড়ে তোলা জরুরি ছিল। বাংলাদেশি শিল্পীদের এড়িয়ে বাংলাদেশের জন্মইতিহাসকে পর্দায় রূপান্তর অবশ্যই অসম্ভব নয়, তবে তা বিচক্ষণতার পরিচায়কও নয়।

যে প্রশ্নটা গোড়ায় ছিল, তারই দ্বিরুক্তি- যুদ্ধশিশু কতটা ব্যক্ত হয়েছে এই চলচ্চিত্রে? উত্তর, যুদ্ধশিশুদের জন্মপরবর্তী যুদ্ধ অনুচ্চারিত। ফিদার মত বীরাঙ্গনারা এত সহজ পারিবারিক-সামাজিক স্বীকৃতি পাননি।   জাতির কাছে যারা যুদ্ধশিশু তাদের নিয়ে বিবাহিত, অবিবাহিত, তরুণী নারীদের দুর্দশাচিত্র আর যুদ্ধশিশুদের কথা ব্যতিরেকে 'যুদ্ধশিশু' নামক কোন চলচ্চিত্র একটি অপূর্ণাঙ্গ নির্মাণ। সিনেমাটির পোস্টারে রাইমা সেনের ছবি, কিংবা তিলোত্তোমা সোমের ছবি একাত্তরের নারীর দুই রূপ যদিও, কিন্তু যুদ্ধশিশু বিষয়বস্তু অনুপস্থিত।

চিলড্রেন অব ওয়ার চলচ্চিত্রটি কি মাস্টারপিস? নির্মাতার প্রয়াসকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তবে ভারতীয়  কোন কোন মুভি রিভিউ যেমন করে 'চিলড্রেন অব ওয়ার'কে মাস্টারপিস আখ্যায়িত করার চেষ্টায় রত, তা সহজেই খারিজ করে দেয়া যায়। চলচ্চিত্র শীরোনাম অনুযায়ী কাহিনী বিন্যস্ত হয়নি। এই চলচ্চিত্রের নাম অ্যান্থনি মাসকারেনহাস এর 'দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ' এর মত হতে পারত। এই চলচ্চিত্রের ক্রু'দের অধিকাংশই নির্মাণের পূর্বে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিস্তর ইতিহাস জ্ঞান রাখতেন না, বিধায় চলচ্চিত্রটি কালজয়ী হয়ে উঠতে পারেনি। সম্ভবত চলচ্চিত্রটির শ্যুটিং এদেশে হওয়ার কথা ছিল এবং কোন ধরনের জটিলতায় তা ঘটেনি পরবর্তীতে। লোকেশন বাছাই কিংবা সেট নির্মাণে অদক্ষতার ছাপ না থাকলেও এ চলচ্চিত্রের সবুজ গ্রাম, শহুরে গলি, তরুণ প্রজন্মের সভাস্থান যেন আমাদের পথঘাটগলি হয়ে উঠতে পারেনি।   

আমরা কি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ভারতীয় চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবো? চলচ্চিত্র নির্মাণে আমাদের প্রযুক্তিগত পরিবর্তন এসেছে। কুশীলবও অপ্রতুল নয়। আমাদের ইতিহাসকে পর্দায় সঠিকভাবে, আন্তর্জাতিক মানে তুলে ধরার দায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে আমাদেরই। আমাদের ভূমিকা কেবল দর্শকের নয়।

ওয়ার বেবি বা যুদ্ধশিশু স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরে যতখানি উচ্চারিত, ’৭১ পরবর্তীতে ছিল ততখানি লজ্জার। আজ যে বীরাঙ্গনাদের আমরা সম্মাননা জানাই, যুদ্ধশেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করেও এই সমাজে সহজে পুনর্বাসন করতে পারেননি। সমাজের চোখে যুদ্ধশিশু  গ্রহণ ছিল দুষিত রক্তকে শরীরে ধারণ করার সামিল।

শেখ মুজিব চেয়েছিলেন, যুদ্ধশিশুরা অন্তত মানুষ পরিচয়ে বড় হোক। তাই গোপনে, নীরবে দত্তক হিসেবে যুদ্ধশিশুরা চলে গেছে কানাডা, সুইডেন কিংবা ফ্রান্স। নথিপত্রে আর খোঁজ মেলেনা কত সংখ্যক যুদ্ধশিশু ভূমিষ্ট হয়েছিল। পঁচিশ হাজার? ত্রিশ হাজার? লাখ? আরো বেশি? যুদ্ধশিশুদের কতজন আজকের বাংলাদেশকে জানে তা আমরা জানিনা। জাতি হিসেবে আমরাও গরজহীন।

একাত্তরে পাক সেনাদের হাতে একবার আমাদের নারীরা নির্যাতিত হল, আর যুদ্ধশেষে বীরাঙ্গনাদের বারাঙ্গনা তুল্য করে আমরা পুনরায় তাদের নিগৃহীত করি। বীরাঙ্গনা আর যুদ্ধশিশুদের নিয়ে আজ অশ্রসিক্ত হওয়া যতটা সহজ, প্রকৃত সত্যের মুখোমুখি হওয়া এ জাতির জন্য ততটা সহজ নয়। জাতি হিসেবে এ ব্যর্থতার দায় কি করে এড়াবো আমরা?

আইরিন সুলতানা: ব্লগার, কবি, কলামিস্ট

বাংলাদেশ সময়: ১০৪০ ঘণ্টা, জুন ৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।