কিছু সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও বাস্তবতার ভিত্তিতে একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। বাংলাদেশের ‘পলিসি ডকুমেন্ট’ এ সে বিষয়ে পরিষ্কার উল্লেখ আছে।
সম্প্রতি এসএসসি’র ফলাফল প্রকাশিত হলো। গড়ে পাশের হার শতকরা ৯১.৪। গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হবার পর এবং বাংলাদেশের ইতিহাসেও পাশের এই হার সর্বোচ্চ। এতে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও সরকারের মাঝে উৎসাহ ও আনন্দের ভাব ছিল। কিন্তু সেই উচ্ছ্বাস সহসাই মলিন হয়ে যায়। যখন প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষা মূল্যায়ন নীতি-পদ্ধতি, প্রশাসন ও শিক্ষা বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত একটি সংঘবদ্ধ চক্রের অনৈতিক কারবারের বিষয়টি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
সস্তা রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা অর্জনের এই বিবেচনাকে কোন ভাবই মেনে নেয়া ও নির্লিপ্ত থাকার সুযোগ নেই। একটি বৃহৎ পাবলিক পরীক্ষার এই অনৈতিক ও অযৌক্তিক সাফল্যকে কি বুনিয়াদি শিক্ষার বড় বিপর্যয় বললে ভুল হবে? সঙ্গতই প্রশ্ন ও সন্দেহ দেখা দিয়েছে পরীক্ষা পদ্ধতি, মূল্যায়ন ও শিক্ষার মান নিয়ে। শিক্ষার মান উন্নয়ন কেন গুরুত্বপূর্ণ? কারণ, শিক্ষার মান নিশ্চিত হবার সঙ্গে এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের প্রশ্নটি জড়িত। আর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি ও এগিয়ে যাবার বিষয়টি যুক্ত। তার সাথে একটি সরকারের সাফল্য ও জাতির ভবিষ্যৎ অন্তর্হিত স্বার্থ সম্পৃক্ত।
বর্তমান গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হবার পর মাধ্যমিক পর্যায়ের ‘অতি মেধাবীদের সাফল্যের’ পরিসংখ্যান ও ইতিহাস খুব অবাক করার মত! এই পদ্ধতি চালু হবার পর ২০০১ সালে এসএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছিল মাত্র ৭৬ জন। ১৩ বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে একই পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লক্ষ ৪২ হাজার ২৭৬ জন। তার মানে মাধ্যমিক পরীক্ষার এই নতুন পদ্ধতি শুরু হবার পর জিপিএ প্রাপ্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৮৭২ গুণ! এটা কি শিক্ষার মান উন্নয়ন বৃদ্ধির কোন নমুনা, না অন্য কিছু?
পাশের হার/সংখ্যা বাড়ার দুইটা প্রক্রিয়া আছে। প্রথমত, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার মান উন্নয়ন, মানে লেখাপড়ায় অধিক মনোযোগী হওয়া ভাল ফল করা।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষাখেত্রে ও পরীক্ষায় অনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়া। প্রথমটি রাতারাতি হবার কোন সুযোগ নেই। কারণ এজন্য যে মানের ও পর্যায়ের আয়োজন দরকার হয় তার সামান্যই হয়েছে।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, বেতন-ভাতা, শিক্ষাখাতে বরাদ্দ, শিক্ষার পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধার অপর্যাপ্ততা ইত্যাদি।
এ বিষয়ে এরইমধ্যে পত্রিকায় প্রকাশিত বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় এই জিপিএ প্রাপ্তদের করুণ অবস্থানের কথা যা খুবই হতাশাজনক। উত্তরপত্র মুল্যায়নের শিথীলতা ও কৌশলগত নির্দেশনার কথাও জানা যায়। শিক্ষার গুণগত মান না বাড়িয়ে কেবল ফলাফলের হার বৃদ্ধির জনপ্রিয় প্রক্রিয়া শিক্ষার উদ্দেশ্যকে প্রশ্ন বিদ্ধ করবে।
শিক্ষার অন্য চিত্রটি আরও বেদনাদায়ক। এবার পরীক্ষার্থী ছিল ১০ লক্ষ ৮৭ হাজার ৮৭০ জন, পাস করেছে ১০ লক্ষ ০৮ হাজার ১৭৪ জন। পাশের হার ৯১.৪ শতাংশ। কিন্তু আমরা যদি আরও একটু পেছনে তাকাই তাহলে দেখব অন্যচিত্র। প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল প্রায় ২৯ লক্ষ শিশু। তারমানে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত আসতে পেরেছে ১০ লক্ষ ৮৭ হাজার ৮৭০ জন। আর ঝড়ে পড়েছে ১৮ লক্ষ ১২ হাজার ১৩০ জন। প্রায় দ্বিগুণ শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়েছে। এটি শিক্ষাব্যবস্থার আরেকটি বড় দূর্বলতা ও হতাশার দিক।
এই আলোচনা আমার কাছে বেশ বাহুল্য মনে হয়। তাহলে কি হবে? প্রথমে আমাদের নীতি নির্ধারকদের নীতিগত সিন্ধান্ত নিতে হবে শিক্ষার বর্তমান পরিস্থিতিকে আমরা “শিক্ষার জরুরি অবস্থা” মনে করি কি’না? এই প্রশ্নে যদি আমরা নীতিগত সিদ্ধন্ত নিতে পারি তাহলে “সমাধানের কর্মপদ্ধতি” তৈরি করা খুব কঠিন কাজ হবে না। আমাদের দেশে অনেক চিন্তাশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই কাজ করার জন্য যথেষ্ট মনে করি। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বিশ্বের বৃহত্তম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনার কাজটি কিছু কিছু করে এগিয়ে যাচ্ছে। বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেবার মত বড় চ্যালেঞ্জ যদি সাফল্যের সাথে সম্পন্ন হতে পারে, তাহলে এই কাজটিও করা সম্ভব।
এই আলোচনায় আমি তিনটি বিষয়কে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে অগ্রসর/কার্যকর করার কথা উল্লেখ করছি; এক. নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত শিক্ষার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যা সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত।
দুই. শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করতে প্রশ্নপত্র তৈরি ও উত্তরপত্র মূল্যায়নের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করা। এক্ষেত্রে এই ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজ করা ও প্রযুক্তির সাহায্য নেয়া গুরুত্বপূর্ণ তিন. শিক্ষাখেত্রে নৈরাজ্য, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি দমন ও নিয়ন্ত্রণে অধিক কঠোর আইন প্রণয়ন ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
শিক্ষামন্ত্রীর উদ্যোগে গত ১১ জুন শিক্ষামন্ত্রণালয়ে শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীরা উপস্থিতি হয়ে শিক্ষার দুর্বলতা ও মান উন্নয়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন।
ড. আনিসুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রশ্ন ফাঁস রোধে আমরা একটা রূপরেখা দিয়েছি। প্রশ্ন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে সরকারকে বলা হয়েছে। এ ছাড়া কঠোর শাস্তির বিধান রেখে যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছেন সবাই। ’
শিক্ষামন্ত্রীও বলেছেন, তারা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করবেন এবং তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ভবিষ্যতে আর যাতে কোনো পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস না হয়, তা নিশ্চিত করতে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। ’
তার কথায় বিশ্বাস হারাতে চাই না, অন্তত আন্তরিকতায়। সময়ের জন্য রেখে দেই, সেই প্রশ্নের জবাব। আমাদের কেবল রাখতে হবে অব্যাহত চাপ। সে কারণে এখানে নতুন করে কোন মতামত ও পরামর্শ দেয়াকে বাড়তি মনে করি। কেবলি অনেকের সাথে নিজের উদ্বেগের বিষয়টি বলছি এই কারণে যে, যতটুকু অর্জন তা যেন কোনভাবেই সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় ধ্বংস না হয়।
মঞ্জুরে খোদা টরিক: লেখক, গবেষক, ইনস্টিটিউট অব পলিসি সাইন্স, জাপান, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৫ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৪