ঢাকা, বুধবার, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ মে ২০২৪, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

খালিপপুরে জখম কেন? ।। পাভেল পার্থ

. | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২২ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৪
খালিপপুরে জখম কেন? ।। পাভেল পার্থ ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম (ফাইল ফটো)

আদিবাসী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক দীপক মাহাতো ১২ মে পাবনা থেকে একটি ক্ষুদেবার্তা পাঠায়, মোবাইলে। ‘তীর-ধনুকে লাগাও শান, জেগে ওঠো আদিবাসী সন্তান, কেড়ে নাও ভূমিদস্যুদের প্রাণ।

পাবনাতে আদিবাসী পরিবারের উপর হামলা, আহত ৫ এর প্রতিবাদে পাবনা প্রেসক্লাবের সামনে আমরা ১১ মে ২০১৪ তারিখে মানববন্ধন করেছি’। আমি তখন ৯ মে দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের খালিপপুর গ্রামে চার সাঁওতাল কৃষিশ্রমিকের উপর অবর্ণনীয় বাঙালি নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটা লেখা তৈরি করছি। লেখাটি সেখানেই আটকে যায়। দুটি জায়গার আহত সংক্ষুব্ধ আদিবাসীদের খবরাখবর নিতে নিতে। ১০ মে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবিত এলাকা পরিদর্শন করেন। যদিও উল্লিখিত বিশ্ববিদ্যালয় ও রাঙামাটি মেডিক্যাল কলেজের বিরুদ্ধে স্থানীয় আদিবাসীরা প্রতিবাদ তুলেছেন, কারণ স্থানীয়দের কোনো মতামত ও পরামর্শ ছাড়াই প্রশাসন এটি বাস্তবায়ন করতে চাইছে।

এর ভেতরেই নওগাঁ থেকে ১৯ মে ক্ষুদেবার্তায় যোসেফ হাঁসদা জানান, নওগাঁর বিনোদপুরে সারিসারনা ধর্মপালনকারী সাঁওতালদের পবিত্র মাঝিথান গুঁড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। খালিপপুর নিয়ে লেখাটি আর দম পায় না। শেষমেষ ৩০ মে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের নাহার খাসিপুঞ্জি রক্তাক্ত হয়ে ওঠে চা বাগান কর্তৃপক্ষের লাগাতার অত্যাচারে। ২০১৪ সনের পুরো মে মাস জুড়ে পাবনা, দিনাজপুর, মৌলভীবাজার কি রাঙামাটি কোথাও দেশের আদিবাসী জীবন এক দুঃসহ রক্তজ্বালা পাড়ি দিয়েছে। কোথাও কোনো বাহিনি, এজেন্সি বা প্রশাসন আদিবাসীদের উপর লাগাতার জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি। যেন পুরো মে মাস জুড়ে সরকার নাকে ঘি ঢেলে ঘুমিয়েছিল। একজন ঠাট্টা করে আমায় জানায়, আম-কাঁঠালের গরমেই নাকি দায়িত্ববানদের এমন বদ-ঘুম, বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ায় অকাল গরমে আহাম্মকী ঘুমের ভেতর দিয়ে মে মাস জুড়ে প্রমাণ করেছে, ‘সত্যি সত্যি দুনিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে’।

কী ঘটেছে খালিপপুরে?
৯ মে ২০১৪ তারিখ সন্ধ্যায় দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার কুশদহ ইউনিয়নের খালিপপুর শ্রীরামপুর সাঁওতাল পাড়ায় কতক বাঙালি মুসলিম পুরুষ চারজন সাঁওতাল কৃষিমজুরের সঙ্গে যা করেছে তা অন্যায়। অবর্ণনীয় নৃশংসতা। তবে প্রশ্নহীন এ জুলুম উত্তরাঞ্চলের আদিবাসী জীবনে এখন ‘সংসারের সঙ্গী’। রাষ্ট্র এখানে নিশ্চুপ। উত্তরাঞ্চলের আদিবাসীরা এখন নিজ জন্মমাটিতে ভূমিহীন। তাই আদিবাসীদের বড় অংশটিই আশপাশের বাঙালিদের জমিতে দিনমজুরি করে চলেন। খালিপপুর গ্রামের সোনারাম টুডু, সোম সরেন, বাবুলাল সরেন ও বাবলু সরেনও তেমনি অভাগা আদিবাসী দিনমজুর। ঘটনার দিন তারা খালিপুরের মো. শহীদুল ইসলামের জমি থেকে বোরো মওসুমের ধান কেটে মজুত করছিলেন পাওয়ারটিলারে। কাটা ধান পৌঁছে দেবেন মালিকের জিম্মায়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে খালিপপুর কাজিপাড়া গ্রামের মাহাবুর রহমান, হাফিজুর রহমান, মো. কালাম, নূর ইসলাম, রফিকুল ইসলাম, রেজাউল ইসলাম এবং খালিপপুর খয়েরপাড় গ্রামের অতুল মিয়া ও খোরশেদ আলী হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হয়ে সোনারাম টুডু, সোম সরেন, বাবুলাল সরেন ও বাবলু সরেনের উপর হামলা করে (সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ২২মে ২০১৪)

দুর্বৃত্ত হামলাকারীরা চার সাঁওতাল শ্রমিককে বেধড়ক পেটায়, মারতে মারতে টেনে হিঁচড়ে খালিপপুর কাজীপাড়ায় নিয়ে বটগাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে এলোপাথারি মারতে থাকে। গ্রামবাসীরা এগিয়ে এলে দুর্বৃত্তরা সবাইকে সরিয়ে দেয়। নির্দয় আঘাতে দুই সাঁওতাল শ্রমিক জ্ঞান হারালে ‘মরে গেছে’ মনে করে দুর্বৃত্তরা সরে যায়। অন্যায় জখম নিয়ে চার আদিবাসীকে নিয়ে প্রতিবেশীরা প্রথম ফুলবাড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসে। সেখান থেকে তাদের দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। অর্থের অভাবে বাবলু সরেন ও সোম সরেনকে জখম নিয়েই হাসপাতাল থেকে বাড়িতে চলে আসতে হয়। সোনারাম টুডু ও বাবুলাল সরেন এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অর্থের অভাবে দুর্বৃত্তদের হামলায় বিনা চিকিৎসায় পঙ্গু হতে চলেছেন চার সাঁওতাল শ্রমিক। ১৪ মে ২০১৪ তারিখে আহত সোনারাম টুডু নবাবগঞ্জ থানায় মাহাবুর রহমান, হাফিজুর রহমান, মো. কালাম, নূর ইসলাম, রফিকুল ইসলাম, রেজাউল ইসলাম, অতুল মিয়া ও খোরশেদ আলী এই আট হামলাকারীর বিরুদ্ধে ১৪৩/৪৪৭/৩২৩/৩২৫/৩২৬/৩০৭/৫০৬/১৪৪ ধারায় মামলা দায়ের করেন। নবাবগঞ্জ থানার ওসি আমিরুল ইসলামের ভাষ্য, মামলার এক নম্বর আসামীকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে, অন্যদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে (সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ২২ মে ২০১৪)

‘মধ্যযুগীয়’ ও ‘পূর্বশত্রুতা’
দিনাজপুরের খালিলপুরে আদিবাসী সাঁওতাল শ্রমিকদের উপর বাঙালি দুর্বৃত্তদের সাম্প্রতিক আক্রমণকে অনেক গণমাধ্যম বলেছে ‘মধ্যযুগীয় কায়দার নির্যাতন’। বিশেষ করে বটগাছে ঝুলিয়ে পেটানোকে তারা ‘মধ্যযুগীয় নির্যাতন’ হিসেবে পাঠ করেছেন। কিন্তু যে নির্যাতন ২০১৪ সনের মে মাসেও বহাল তবিয়তে এক সার্বভৌম রাষ্ট্রে ঘটে চলেছে, যার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র সজোরে দাঁড়াচ্ছে না তা কী করে ‘মধ্যযুগের নির্যাতন’ হয়? এটি কী তাহলে ‘মধ্যযুগ’? কার জন্য তাহলে ‘মধ্যযুগ’? বাঙালি বলপ্রয়োগের না নিপীড়িত আদিবাসীর? উত্তরাঞ্চলসহ দেশ জুড়ে নিত্য আদিবাসীদের উপর নানান সহিংস জখম চলছে। আদিবাসীদের বঞ্চিত রক্তাক্ত চোখে কোনো আদি, মধ্য কি অন্ত যুগ নেই। এ নিপীড়ন চলমান, অনিবার্য। প্রকট থেকে প্রকটতর।

খালিলপুর ঘটনাকে গণমাধ্যমসহ এমনকি নির্যাতিতের মামলার এজাহারেও বলা হয়েছে এটি ‘পূর্ব শত্রুতার জের’ (সূত্র: মামলার এজাহার, মামলা নং-১০, নবাবগঞ্জ থানা, দিনাজপুর, ১৪/৬/২০১৪)। গণমাধ্যম বা মামলার এজাহার কোথাও ‘পূর্বশত্রুতাটি’ কী তা কোথাও স্পষ্ট উল্লেখ নেই। ২০১২ সনে খালিপপুর-শ্রীরামপুর গ্রামের এক আদিবাসী স্কুল ছাত্রীকে সাম্প্রতিক হামলাকারী মাহবুর রহমানের এক আত্মীয় স্কুলে যাওয়ার পথে ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। এলাকাবাসী ওই যুবককে আটক করে থানায় সোপর্দ করে। পরে নির্যাতিত সেই স্কুল ছাত্রীর পরিবারকে জোর করে মামলা আপোষ করাতে বাধ্য করানো হয়। এরই জের ধরে মাহাবুর রহমান সম্প্রতি খালিপপুরে সাঁওতাল শ্রমিকদের উপর হামলা করে বলে আদিবাসীদের অভিযোগ (সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ২২ মে ২০১৪)। কিন্তু এটিই কী ‘পূর্বশত্রুতার ধরণ বা কারণ’? কারণ এর আগেও ২০১২ সনের ১৯ সেপ্টেম্বর খালিপপুর গ্রামের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এক আদিবাসী শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে গ্রামবাসী মোহাম্মদ আলীকে (৫৫) আটক করে ও মামলা দায়ের করে। খালিপপুর গ্রামে তো আদিবাসী শিশু নারী শ্রমিক প্রবীণ সকলের উপরই নানান কায়দার জুলুম ও অন্যায় নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে ওঠেছে। নিত্যদিনের নিপীড়ন কি কোনোভাবেই ‘পূর্বশত্রুতা’ হয়? পূর্বশত্রুতা তো তাই, যে শত্রুতা পূর্বে ঘটে আর চলমান নেই, শেষ হয়েছে। কিন্তু খালিপপুরে প্রবল বাঙালি বাহাদুরি বহাল তবিয়তে দিনকে দিন ভুঁড়িঅলা হচ্ছে।

শেষ কথা
কল্পনা চাকমা, পীরেন মস্নাল, গীদিতা রেমা, বিহেন নকরেক, সত্যবান হাজং, আলফ্রেড সরেন, অবিনাশ মুড়া, লেবিনা হাউই, চলেশ রিছিল হত্যার তাই কোনো বিচার হয় না। রাষ্ট্রকে আদিবাসী জনগণের প্রতি তার রাষ্ট্রীয় দায় ও দায়িত্ব ফায়সালা করতে হবে। খালিপপুরে সাঁওতাল শ্রমিকদের উপর সাম্প্রতিকহামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার রাষ্ট্রকেই নিশ্চিত করতে হবে। মারাত্মকভাবে জখম হওয়া আদিবাসী পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কাজ হারানো অনাহারী আদিবাসী পরিবারগুলোর পাশে স্থানীয় প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদকে যাবতীয় শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আহত সাঁওতাল শ্রমিকদের দ্রুত চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা প্রথম জরুরি শর্ত। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে আরেক স্বজন প্রতিবেশীর এই বিপদের সময় দাঁড়ানোই বাংলাদেশের দর্শন। তা অব্যাহত থাকুক তাই আমরা প্রত্যাশা করি।

pavel_partha

 

 

লেখক : গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ

 

 

বাংলাদেশ সময়: ১৩২০ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।