ঢাকা, বুধবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ মে ২০২৪, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

সাদাসিধে কথা

কয়েক টুকরো ভাবনা

মুহম্মদ জাফর ইকবাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০০ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১৪
কয়েক টুকরো ভাবনা

১.
গত কিছুদিন থেকে আমাকে সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্ন করা হচ্ছে সেটি হচ্ছে, ওয়ার্ল্ড কাপে আপনি কোন দলকে সাপোর্ট করেন? আমি তখন রীতিমত সমস্যায় পড়ে যাই। সারা পৃথিবী যখন ওয়ার্ল্ড কাপের উত্তেজনায় ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে, খবরের কাগজের মূল অংশই হচ্ছে ওয়ার্ল্ড কাপের খুঁটিনাটি তখন আমি যদি বলি আমার ওয়ার্ল্ড কাপে পছন্দের দল নেই তখন সবাই আমার দিকে কেমন জানি অন্যরকম চোখে তাকায়! সবারই ধারণা হয় আমার নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে।



ওয়ার্ল্ড কাপ বিষয়টাই আমার জন্যে হৃদয়-বিদারক। এমনিতে টেলিভিশন দেখা হয় না, কোথাও গিয়ে যদি দেখি সবাই টেলিভিশনে ওয়ার্ল্ড কাপ দেখছে তখন আমাকেও দেখতে হয়। এমনিতে পছন্দের কোনো দল নেই, কিন্তু খেলা দেখার সময়ে য দলটা একটু দুর্বল তার জন্য কেমন জানি মায়া হয়। নিজের অজান্তেই এক সময় তার পক্ষ নিয়ে নিই। অবধারিতভাবে আমার দুর্বল দলটি হেরে যায় এবং তখন আমার মন খারাপ হয়ে যায়। কাজেই ওয়ার্ল্ড কাপ খেলা থেকে আমি এখনো কোনো আনন্দ পাই নি, অনেক দুঃখ পেয়েছি!

ছেলেবেলায় আমি প্রচুর ফুটবল খেলেছি, কখনো খেলার মাঠে ফুটবলে লাথি দিতে পেরেছি বলে মনে নেই। কিন্তু লাথি দেবার জন্য অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছি এবং তাতেই অনেক আনন্দ পেয়েছি। কিন্তু আজকালকার ওয়ার্ল্ড কাপ খেলা দেখে আমি মাঝে মাঝেই খুব ভাবনায় পড়ে যাই। যে কোনো খেলার মূল কথা হচ্ছে যে দলটি ভালো খেলবে সে জিতবে। ওয়ার্ল্ড কাপে আমরা দেখি দুই দলই ভালো, কেউ কাউকে গোল দিতে পারছে না তখন লটারি করে ঠিক করা হচ্ছে কে বিজয়ী! (খেলা শেষে পেনাল্টি কিক দিয়ে জয় পরাজয় ঠিক করা আসলে লটারি ছাড়া আর কিছু না। ) পেনাল্টি কিক দেবার বেলায় অনেক সময়েই দেখি গোলকিপার উল্টো দিকে ঝাঁপ দিয়েছে-কোন দিকে ঝাঁপ দেবে সিদ্ধান্তটি নিতে হয় কিক দেয়ার আগে। কাজেই পুরোটাই কপালের উপর, পুরোটাই  লটারি। যে খেলার জয় পরাজয় ভাগ্যের উপর নির্ভর করে সেই খেলা কেমন করে সত্যিকারের খেলা হতে পারে সেটি আমি কখনো বুঝতে পারিনি। আমাকে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও আমি বুঝব বলে মনে হয় না।

তবে ওয়ার্ল্ড কাপের সময় বাংলাদেশের চেহারা দেখে আমি সবসময়ই দীর্ঘশ্বাস ফেলি। কোনো একটা বিচিত্র কারণে এই দেশের অনেক মানুষ মনে করে তারা যে দলটার সমর্থক সেই দলের দেশটির পতাকা টাঙাতে হবে। শুধু যে টাঙাতে হবে তা নয়, পতাকাটা হতে হবে অনেক বড়। পতাকা টাঙাতে গিয়ে ইলেকট্রিক শক খেয়ে তরুণেরা মারা গেছে, তার আপনজনের কেমন লেগেছে কল্পনাও করতে পারি না। যশোরের ডিসি এই পতাকা দেখে বিরক্ত হয়ে বলেছেন, স্বাধীন দশে বিদেশি পতাকা এভাবে টাঙানো যাবে না, পতাকা নামাতে হবে। তার জন্য অভিনন্দন, সারা দেশে অন্তত একজন মানুষ আছেন যিনি জানেন পতাকা এক টুকরো কাপড় নয়, পতাকাটা দেশের প্রতীক!

পৃথিবীর সবদেশে জাতীয় পতাকার সম্মান রাখার জন্য নিয়ম কানুন আছে, ইচ্ছেমত কেউ বিদেশি পতাকা তুলে ফেলতে পারে না। বিদেশি পতাকার সাথে নিজের দেশের পতাকাটা আরো উঁচুতে তুলতে হয়, বিদেশি পতাকা থেকে নিজের দেশের পতাকাটা আরো বড় হতে হয়।

আগে একেবারেই ছিল না, তবে আজকাল দেখছি প্রায় অনেক জায়গাতেই বিদেশি পতাকার সাথে বাংলাদেশের পতাকাটাও আছে, দেখে ভালো লাগে। যদি এরকম হতো, যে কয়টি বিদোশ পতাকা আছে ঠিক সেই কয়টা কিংবা তার থেকে বেশি আমাদের লাল সবুজ পতাকা উড়ছে, তাহলে সেই দৃশ্য দেখে আমাদের বুকটা ভরে যেতো। আমাদের যে প্রজš§ মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বড় হয়েছে তারা জানে আমাদের লাল সবুজ পতাকার লাল রঙটি আসলে মোটেও লাল রঙের একটা কাপড় নয়, সেটি আসলে আমাদের আপনজনের বুকের রক্ত দিয়ে রাঙানো। এর মধ্যে এক বিন্দু অতিরঞ্জন সেই! সেই জন্য জাতীয় পতাকাটা আমাদের কাছে এতো গুরুত্বপূর্ণ।

২.
যারা ভাবছেন ‘ওয়ার্ল্ড কাপ’ নামক যে বিষয়টি নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই আমি সেটা নিয়েই লিখতে বসেছি, আমি তাদেরকে আশ্বস্ত করতে চাই! আমি আজকে আমার কিছু টুকরো টুকরো ভাবনার কথা লিখতে চাই। ভিন্ন ভিন্ন কিছু ভাবনা।

কিছুদিন আগে আমার সঙ্গে একটি প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ করে আমাকে তাদের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হওয়ার অনুরোধ করলেন। ‘প্রধান অতিথি’ ‘মাঝারি অতিথি’ ‘দায়সারা অতিথি’ এই বিষয়গুলো আমার জন্য বোঝা কঠিন, তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে আমি এই বিভাজন নিয়েই প্রায় খুনোখুনি হবার অবস্থা ঘটতে দেখেছি! যাই হোক এই প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণটি আমি খুব আগ্রহ নিয়ে গ্রহণ করলাম। কারণ তাদের অনুষ্ঠানে তারা প্রায় দুইশ বাচ্চাকে নিয়ে আসবেনÑতাদের সবাই গৃহকর্মী। সোজা বাংলায় বাসার কাজের মেয়ে। এরকমটি আগে কখনো ঘটেনি।

ঢাকা শহরে ঠিক সময়ে কোথাও পৌঁছানো অসম্ভব একটি ব্যাপার, বেশি সতর্ক হয়ে অনেক আগে রওনা দিয়ে অনেক আগে পৌঁছে গেছি, না হয় ঠিক সময়ে রওনা দিয়ে দেরি করে পৌঁছেছি। তবে সেদিন ভাগ্যের জোরে আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে গেলাম এবং পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাকে স্টেজে তুলে দেওয়া হলো।

মঞ্চে বসে আমি অনুষ্ঠানের দর্শক শ্রোতাদের দেখতে পেলাম এবং আমার বুকটা ব্যথায় টনটন করে উঠল। যারা আমার সামনে বসে আছে তাদের বয়স দশ বারো বছর কিংবা আরো কম। এই বয়সের শিশুদের মুখে এক ধরনের সারল্য থাকে, এক ধরনের নির্দোষ কমনীয়তা থাকে। তাদের সবার মুখে সেটা আছে। আমার সামনে যারা বসে আছে তাদের সবাই নিজের বাবা মা ভাইবোনকে ছেড়ে একা একা অন্য একটা পরিবারের বাসায় কাজ করে। যে বয়সে স্কুলে যাবার কথা, বন্ধুদের সাথে হৈ হুল্লোড় করার কথা, মা বাবার আদরে বড় হবার কথা, তখন তারা কাপড় কাচে, বাসন ধোয়, রান্না করে, ফাই ফরমাশ খাটে। আয়োজকরা আমাকে জানালেন এদের অনেকেই জানে না তারা কোথা থেকে এসেছে, তাদের দেশ কোথায়, বাবা মা পরিজন কোথায় থাকে! তারপরও তারা হচ্ছে এদেশের গৃহকর্মীদের বা কাজের মেয়েদের মাঝে সৌভাগ্যবানেরা।

তারা যে পরিবারের সাথে কাজ করে তারা এই কাজের মেয়েদের এই সংগঠনের সাথে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে, সময় করে লেখাপড়া করতে দিয়েছে, এই সংগঠনের সাথে খানিকটা বিনোদনের জন্যে ঘর থেকে বের হতে দিয়েছে। সেজন্য আজ আমি তাদের দেখার সুযোগ পেয়েছি। অন্যদের আমরা কখনো দেখব না, তাদের কথা শুনব না।

আয়োজকেরা জানালেন এই বাচ্চাদের সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর দেখিয়ে আনা হয়েছে, আমাকে অনুরোধ করলেন তাদের কিছু একটা বলতে-সম্ভব হলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে।

আমি শিক্ষক মানুষ। মাস্টারি করি। আমার কাজ কথা বলা, যে কোনো জায়গায় জানি আর না জানি কিছু একটা বলে ফেলতে পারি। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে আমি হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আমার বলার কিছু নেই। এই বাচ্চাগুলো যদি কোনো স্কুলের বাচ্চা হতো আমি তাদের স্বপ্নের কথা বলতে পারতাম, ভবিষ্যতের কথা বলতে পারতাম, কিন্তু যে বাচ্চা বাসায় কাজ করে জীবন কাটায় তাকে আমি কী মিথ্যা স্বপ্ন দেখাব?

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের মত মানুষের সামনে নতুন একটি দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে, সুন্দর ভবিষ্যৎ হাতছানি দিয়েছে। কিন্তু এই ছোট শিশুদের জীবনে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার কি কিছু আছে? আমি কী তাদের কোনো আশার কথা বলতে পারব? কোনো স্বপ্নের কথা বলতে পারব? সারা জীবনে যেটি কখনো হয়নি, আজ আমার সেটি ঘটে গেল। আমি তাদের বলার মত কিছু খুঁজে পেলাম না। অবান্তর একটি দুটি কথা বলে তাদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা কী পড়তে পার?’ সবাই চিৎকার করে বলল, ‘পারি!’ কী অসাধারণ একটি ব্যাপার। এই প্রথমবার আমি উল্লসিত হয়ে বললাম, ‘আমি তোমাদের সবার জন্য একটি করে বই এনেছি! তোমরা এসো, আমি তোমাদের একটি করে বই উপহার দিই। ’

অনুষ্ঠানের সব শৃঙ্খলা ধ্বংস হয়ে গেল, বাচ্চাগুলো ছুটে এলো, আয়োজকেরা তাদের লাইন করিয়ে দিলেন, আমি তাদের হাতে একটি একটি বই তুলে দিলাম। আহা! কী মায়াকাড়া চেহারা কিন্তু নিষ্ঠুর পৃথিবীর তাদের দেবার মত কিছু নেই। বাচ্চাগুলোর কিন্তু মুখে হাসি। তাদের কোনো অভিযোগ নেই, এই জীবন নিয়ে অভিযোগ করা যায় সেটি তারা জানেও না। শুধু একজন আমার কাছে জানতে চাইল, ‘আমরা এখন ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়তে পারি। যদি আরো পড়তে চাই তাহলে কোথায় পড়ব?’ আমি তাকে আশ্বস্ত করে কিছু একটা উত্তর দিয়ে এসেছি, একটি মেয়ের লেখাপড়া হয়তো অনেকভাবেই করা সম্ভব, কিন্তু তার মতো অন্যদের কে আশ্বস্ত করবে?

আয়োজকরা বাচ্চাদের দিয়ে একটি অনুষ্ঠান করিয়েছিলেন, সেই অনুষ্ঠান দেখে কে বলবে তাদের জীবন কাটে বাসার কাজ করে! ছোট একটি শিশুকে একটুখানি সুযোগ দেয়া হলে তারা কতো কী করে ফেলতে পারে? এই দেশের সব শিশুদের আমার কখন সেই সুযোগ করে দেব?

৩.
ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে-কাজেই আমি কিছু একটা লিখতে বসেছি, লেখা পড়া নিয়ে যদি কিছু না বলি সেটা কেমন করে হয়?

খবরের কাগজে দেখেছি সংসদে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে আলোচনা হয়েছে, আমাদের শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় বলেছেন পাঁচবছরে এই প্রথমবার প্রশ্নফাঁস হয়েছে। খবরটি পড়ে আমার খুব মন খারাপ হয়েছে। কারণ আমি নিশ্চিতভাবে জানি এই পাঁচ বছরে আরো অনেকবার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। আমার মতো আরো অসংখ্য ছাত্র-শিক্ষক অভিভাবকেরাও জানে-তারা যখন খবরের কাগজে এই খবরটি পড়বে তখন তাদের কী মনে হবে? আমাদের মাননীয় মন্ত্রী একটি সত্যকে অস্বীকার করছেন নাকি তার থেকেও বেদনাদায়ক ব্যাপার, দেশের শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পরও এই গুরুত্বপূর্ণ সত্যটির কথা কেউ তাকে জানায় নি? কোনটি বেশি বেদনাদায়ক?

আমরা সবাই প্রশ্ন ফাঁস সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির রিপোর্টের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম, তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে, রিপোর্টে বলা হয়েছে শুধু ইংরেজি এবং গণিতের প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে- অথচ আমি নিজে খবরের কাগজে পদার্থ বিজ্ঞানের ফাঁস হয়ে যাওয়া চারটি প্রশ্ন সত্যিকার প্রশ্নের পাশাপাশি ছাপিয়েছিলাম। ফাঁস হয়ে যাওয়া অন্যান্য প্রশ্নগুলোও আমি ছাত্রদের দিয়ে তদন্ত কমিটির হাতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম! হাতে প্রমাণ থাকার পর তদন্ত কমিটি এই সত্যগুলোও উদ্ঘাটন করতে পারেনি- আমরা এখন তাদের কাছে খুব বেশি কিছু কি আশা করতে পারি?

৪.
এইচএসসির লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়েছে, এখন ব্যবহারিক পরীক্ষা চলছে বা শেষ হয়েছে। আমার মনে হয় এদেশে ব্যবহারিক পরীক্ষার বিষয়টাও দেশের মানুষের জানা দরকার। আমি নিজেই লিখতে পারি কিন্তু সবচেয়ে ভালো হয় যারা এই পরীক্ষা দেয় তাদের নিজেদের মুখে শোনা। একজনের ই-মেইল এরকম: ‘প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় আমাদের কোনো পরীক্ষা করতে হয় না। ফিজিক্সে আমরা বই দেখে কলেজে করা পরীক্ষার মানগুলো বসিয়ে দিই। কেমেস্ট্রি ফার্স্ট পেপারে পিয়ন বলে দেয় মান কী রকম হবে, একটু এদিক সেদিক করে লিখে দেই। সেকেন্ড পেপারে লবণ শনাক্তকরণ থাকে, পিয়ন বলে দেয় কোনটা কী লবণ। আর সব পরীক্ষার বর্ণনাই লিখি বই, খাতা বা ফোনে তোলা ছবি দেখে। এজন্যে প্রতি পরীক্ষায় একশো টাকা দিতে হয়। চার বিষয়- দুইপত্র = ৮০০ টাকা। কী ব্যবসা দেখছেন? পিয়ন না শুধু শিক্ষকরাও জড়িত। ’

একজন ছাত্র বা ছাত্রী যখন জানে তাদের শিক্ষকেরা দুর্নীতির সাথে জড়িত তখন সেই শিক্ষার কী আসলে কোনো গুরুত্ব আছে? বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর ব্যবহারিক পরীক্ষায় ২৫ নম্বর থাকে। ১০০ এর ভেতর এই ২৫ মার্ক সরাসরি টাকা দিয়ে কেনা যায় সবাই এটি জানে। ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক-কেউ বাকি নেই, কিন্তু কেউ কিছু করে না। তারপরও আমরা শিক্ষা নিয়ে অনেক বড় বড় কথা বলি-আমার দুঃখটা সেখানে।

৫.
আমি যখন ঢাকা যাই তখন আমার মায়ের সাথে দেখা করার জন্য মিরপুর ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে যাই। মিরপুরে পৌঁছানোর পর আমি যে রাস্তাটি ব্যবহার করি সেটি বিহারী এলাকার ভেতর দিয়ে যায়- আমি সেটি আগে জানতাম না, এখন জানি। বেশ রাতে আমি একদিন যাচ্ছি। দেখি রাস্তায় অনেক মানুষের ভীড়। মানুষের ভীড় দেখেই বোঝা যায় ভীড়টির গতি প্রকৃতি কী রকম, কখনো হয় নির্দোষ আনন্দোল্লাস, কখনো ক্ষুব্ধ মানুষের জটলা। আমি বুঝতে পারলাম এই ভীড়টির ভেতরে এক ধরনের ক্ষোভ রয়েছে-ভীড় ঠেলে ক্ষুব্ধ মানুষের ভেতর দিয়ে আমি যখন গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছি, আমার ড্রাইভার জানালো এই ভীড়ের মাঝে মানুষজনের সাথে কথা বলছেন স্থানীয় এমপি।

এর মাঝে বিন্দুমাত্র অস্বাভাবিকতা নেই, একজন এমপি তার এলাকায়, তার মানুষের সাথে কথা বলতেই পারেন, তাদের ভেতরে কোনো ক্ষোভের জন্ম নিলে তাকেই তো সেটা প্রশমিত করার জন্য আসতে হবে।

ঠিক তার কয়েকদিন পর শবেবরাতের রাত পার হয়ে যে ভোর এসেছে সেই ভোরে বিহারীদের এলাকায় দশজন মানুষকে পুড়িয়ে মারা হল। এর মাঝে মহিলা আছে, শিশু আছে কিশোর কিশোরী আছে। সেই ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি শবেবরাতের রাতে পরের বছরের জন্য ভাগ্য গেঁথে দেয়া হয়। বিহারী পল্লীর মো. ইয়াসিন নামের মানুষটি জানতো না তার পরিবারের জন্য কী ভয়ংকর নির্মম একটি ভাগ্য কয়েক ঘণ্টা আগে শবেবরাতের রাতে তাদের কপালে লিখে দেয়া হয়েছিল। আমি কারো নাম মনে রাখতে পারি না। কিন্তু পুড়িয়ে মারা মানুষগুলোর মাঝে লালু ভুলু নামে দু’জন জমজ শিশুর নাম আছে, সেই নামগুলো আমার স্মৃতিতে গেঁথে গেছে-আমি মনে হয় সেটা কখনো ভুলতে পারব না।

এই নির্মম পৈচাশিকতা কেমন করে ঘটেছে বোঝার চেষ্টা করেছি বুঝতে পারিনি। এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, এই এলাকায় যে এক ধরনের উত্তেজনা ছিল আমি সেটা নিজের চোখে দেখেছি, কিন্তু খবরের কাগজ পড়ে আমি কিছু বুঝতে পারছি না। সেখানে দেখেছি এই ভয়ংকর পৈচাশিক ঘটনার জন্যে ছয়জন বিহারীকেই ধরে নেয়া হয়েছে, মনে হচ্ছে এখানে খুব বড় ধরনের একটি অন্যায়, খুব বড় একটা অবিচার হতে যাচ্ছে। সেটি থামানোর কোনো পথ নেই।

আমরা সবাই জানি ১৯৭১ সালে এই বিহারী সম্প্রদায় বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। এই পুরো এলাকার অসংখ্য বাঙালিদের হত্যা করা হয়েছিল এমন কী স্বাধীনতার পরও ২০ জানুয়ারি এখানে জহির রায়হানসহ অনেকে খুন হয়েছেন, হারিয়ে গেছেন। এখনও সেই এলাকায় বধ্যভূমি খুঁজে পাওয়া যায়। বিহারীদের অনেকেই এখনো নিজেদের পাকিস্তানী মনে করেন, তারা পাকিস্তানে ফিরে যেতে চায় কিন্তু পাকিস্তান সরকারের এই বিহারীদের ফিরিয়ে নেয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। গত চার দশক থেকে এই বিহারী সম্প্রদায় এখানে ক্যাম্পে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে।

চার দশক দীর্ঘ সময়। একাত্তরে যারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তাদের সংখ্যা এখন খুব বেশি থাকার কথা নয়- এখন এখানে নত‍ুন প্রজন্ম জন্ম নিয়েছে। তারা এদেশের মাটিতে জন্মেছে, এই দেশে সম্মান নিয়ে তাদের বেঁচে থাকার অধিকার আছে। বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমাদের সবার উপর দায়িত্ব এই মানুষগুলোকে আমাদের দেশে আমাদের সমাজে সম্পৃক্ত করে নিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তাদের গড়ে ওঠার অধিকার দেয়া। আমি নিশ্চিত যারা নতুন প্রজš§ তাদের নিশ্চয়ই পাকিস্তান যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই- পাকিস্তান নামক দেশটির এমন অবস্থা যে যারা পাকিস্তানের অধিবাসী তারাই এখন এই দেশ থেকে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে! সরকার হোক, মানবাধিকারকর্মী হোক সবাই মিলে ক্যাম্পে রিফিউজি হিসেবে কয়েক যুগ থেকে বাস করা মানুষগুলোর জীবনে একটুখানি স্বস্তি, একটুখানি স্বপ্ন, একটুখানি আশা ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। পূর্বপুরুষের অপরাধের জন্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে- সেটি তো কোনোভাবে আমরা মেনে নিতে পারি না।

স্বাধীনতার আগে বিহারীদের সাথে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেকভাবে দেখা হতো- তখন তারা বাংলা বলতো না। বাংলা না জেনেই তারা যেন এই দেশে জীবন কাটাতে পারে পাকিস্তান সরকার নানাভাবে সেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল। আমি এখন যখন বিহারী এলাকার ভেতর দিয়ে যাই তখন দেখি তারা চমৎকার বাংলা বলতে পারে!

মিরপুরে তাদের এলাকার ভেতর দিয়ে দুই লেনের একটি রাস্তা গিয়েছে, দশজন বিহারী শিশু কিশোর মহিলাকে পুড়িয়ে মারার পর একটি লন সম্ভবত তারা প্রতিবাদ হিসেবে বন্ধ করে রেখেছে, সেখানে বাংলায় লেখা অনেক ব্যানার ঝুলছে। সেদিন যাবার সময় দেখলাম একটা শোকসভা হচ্ছে বিহারী বক্তারা চমৎকার বাংলায় তাদের বক্তব্য দিচ্ছেন। তারা আসলে পুরোপুরি আমাদের মানুষ হয়ে গিয়েছেন।

তাহলে কেন তাদের ভিনদেশি মানুষ হিসেবে আমাদের এই দেশে কষ্ট দিয়ে যাব? স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্যে আমরা অনেক কষ্ট করেছি-আমরা সেই কষ্ট করেছি যেন পরের প্রজন্মকে কষ্ট করতে না হয়। কেন তাহলে আমরা নতুন প্রজন্মকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছি?

বাংলাদেশ সময়: ০০০১ ঘণ্টা, জুলাই ০৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।