শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ। মন্ত্রী হিসেবে ওনাকে চেনার আগে শিক্ষা সংক্রান্ত কলাম লেখালেখির জন্যই ওনাকে চিনতাম।
আর এই হলো তার কাল। সংসদে তুলোধুনো হলেন। প্রধানমন্ত্রীর ওই সময়ের উপদেষ্টা ড. আলাউদ্দীন এলেন দৃশ্যপটে। সেই যে খেই হারালেন নাহিদ সাহেব। তারপর শুধুই নেতিবাচক খবরের শিরোনামে তিনি।
পরীক্ষায় পাসের হার বাড়ার কারণ খুঁজতে দেখা গেল মন্ত্রণালয়/বোর্ড থেকে বিশেষ নির্দেশনা, সরকারি বই ছাপা হলো দেশের বাইরে থেকে, মার খেলো দেশীয় প্রকাশনা শিল্প, শুরু হলো প্রশ্ন ফাঁস উৎসব। শুধু এইচ এসসি নয়, প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে এসএসসি, জেএসসি ও প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীরও।
মন্ত্রী কিন্তু স্বীকারের পাত্র নন। তিনি সংসদে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস হতেই পারেনা। বললেন, আমাকে মন্ত্রিত্ব থেকে সরানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
অবশেষে ড. জাফর ইকবালের আন্দোলনের কারণে শেষপর্যন্ত তদন্ত কমিটির বরাত দিয়ে স্বীকার করলেন নির্জলা এ সত্য কথাটি। বললেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে পরীক্ষার মধ্যে গ্যাপ দেবেন না। প্রয়োজনে দিনে ২ পরীক্ষা। এ নিয়েও চলছে হৈ-চৈ।
নাহিদ সাহেবের করা এমপিও’র প্রথম তালিকা থেকে শেষপর্যন্ত বাদ পড়া ৬৩ প্রতিষ্ঠানের জন্য তিনি কিন্তু কিছুই করলেন না। ওই সব প্রতিষ্ঠানকে বেতন দেওয়ার শুধুই হাতছানি দিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় মোতাবেক ১২টি প্রতিষ্ঠানকে এমপিও দিতে বাধ্য হয়েছে তার মন্ত্রণালয়।
হাইকোর্ট থেকে রায় পাওয়া আরও প্রতিষ্ঠানকে এমপিও দিচ্ছেনা মন্ত্রণালয়। বলছে আপনারা ঘুরে আসেন আপিল বিভাগ হয়ে। যেখানে রেজাল্ট একই হবে, রায় শিক্ষকদের পক্ষে যাবে(আগের রায়ের ভিত্তিতে) সেখানে না খাওয়া শিক্ষকদের উচ্চ আদালতের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কী লাভ জানিনা।
আমার কাছে প্রাপ্ত তথ্যে বলছি, সরকার যেনো দ্রুত আপিল করে সেজন্য সেই শিক্ষকরা বেতন পাবার অপার আশায় মন্ত্রণালয়/সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে। আর শিক্ষকরা আপিল বিভাগের খরচ আর এ সংক্রান্ত ঘুষের টাকা দিচ্ছে ভিটেমাটি বিক্রি করে।
সম্প্রতি নম্বর বাড়িয়ে পাস করিয়ে দেয়াসহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন কাজে কোটি কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হয় বলে গত সোমবার গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবি। এ নিয়ে আজ (৬ জুলাই-২০১৪) শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, টিআইবি-কে প্রমাণ দিতে হবে। নইলে ক্ষমা চাইতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের উদ্ধৃত করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, তারাও একযোগে বলেছেন টিআইবির প্রতিবেদন অসত্য ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন, উপচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগে আর্থিক লেনদেন হয়নি বলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানিয়েছে বলেও জানান শিক্ষামন্ত্রী। কি আজব ব্যাপার। তিনি কি এতোদিন মন্ত্রী থেকে এটুকু বোঝেন নি, টিআইবির কাছে অবশ্যই প্রমাণ আছে। টিআইবি এরইমধ্যে বলেছেও তারা প্রতিবেদন প্রত্যাহার করবে না।
আর টিআইবি কেনো তার শিক্ষা মন্ত্রণালয়েই এরকম হাজারো প্রমাণ পাওয়া যাবে। শিক্ষামন্ত্রী একটু মাউশি-তে খোঁজ নিলে বা আইন শাখায় খোঁজ নিলেই পাবেন এ সংক্রান্ত নানা তথ্য। আর ঢাকা শহরের অলি-গলিতে যেভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড ঝুলছে তাতেও তো বোঝা যায় কি শিক্ষা দেওয়া দেওয়া হচ্ছে।
তবে বেশ কয়েকটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি আজ আমাদের গর্ব। তারা শিক্ষার প্রতীক হয়েও উঠেছে। কিন্তু সবগুলোর পক্ষে সাফাই গাওয়া বিশেষ করে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা-বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, কুইন্স ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটির পক্ষ নেওয়া কী ঠিক হবে।
টিআইবি বাংলাদেশের ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে গত ৩০ জুন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষার সনদপত্র কেনা যায়৷ আর শিক্ষার্থীদের পাস করিয়ে দেওয়া এবং নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য উপহার ছাড়াও নগদ অর্থের লেনদেন হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মঞ্জুরি কমিশন থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বিভাগ, বিষয় এবং শিক্ষক নিয়োগসহ নানা বিষয় অনুমোদন করাতে অর্থের লেনদেন হয়।
মাননীয় মন্ত্রী, আপনি কেনো এটি অবিশ্বাস করছেন। আপনার কাছে কেনোইবা উপাচার্যরা বলবেন, হ্যা আমরা ঘুষ দিয়ে ইউজিসি, আপনার মন্ত্রণালয় থেকে নানা কাজ করে নেই। আর উপাচার্যরাই কী বিশ্ববিদ্যালয়ে অল ইন অল। আদৌ কী তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন উপাচার্যের ভূমিকা নিতে পারেন। তারা তো মালিক তথা প্রতিষ্ঠাতার কথাতেই চলেন। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে মন্ত্রণালয় মনোনীত একজন করে যে পরিচালক থাকার কথা তাদের থেকেও তো কিছু তথ্য মন্ত্রণালয় নিতে পারে।
ঘুষ আছে। ভালো করেই আছে। এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগই নেই। আপনি হয়তো ধরতে পারছেন না। আপনার চারপাশেই রয়েছেন এমন অনেকে, যাদের বিরুদ্ধে অনেক কথাই শোনা যায়।
টিআইবি-র প্রতিবেদন অনুযায়ী উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ অনুমোদনের জন্য ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পরিদর্শন বাবদ ৫০ হাজার থেকে এক লাখ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য ১০ থেকে ৫০ হাজার, অনুষদ অনুমোদনের জন্য ১০ থেকে ৩০ হাজার, বিভাগ অনুমোদনের জন্য ১০ থেকে ২০ হাজার, পাঠ্যক্রম অনুমোদন ও দ্রুত অনুমোদনের জন্য ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা লেনদেন হয় এবং নিরীক্ষা করানোর জন্য ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা লেনদেন করতে হয়৷
সেদিন আপনাকে একটি শিক্ষা বিষয়ক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি করতে চায় এমন একজন আয়োজক কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, নাহিদ সাহেবকে তো সম্ভবত প্রধান অতিথি হিসেবে পাচ্ছিনা। আমি আসলে কোনো লাইন ঘাট পাচ্ছিনা।
এক মন্ত্রীর এপিএস’র কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এপিএস’র রেট ছিল ২ হাজার টাকা। উনি মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিতেন। কিন্তু এখানে টাকাও নিচ্ছেনা, আবার মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগও দিচ্ছে না।
ড. ইফতেখারুজ্জামান যেমনটি বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এখন ৬১ ভাগ শিক্ষার্থী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছেন৷ বাংলাদেশে যেমন আন্তর্জাতিক মানের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তেমনি টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট বিক্রির বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে৷ টিআইবি-র গবেষণার উদ্দেশ্য হল উচ্চশিক্ষাকে কেউ যেন ব্যবসার পণ্য হিসেবে ব্যবহার না করতে পারে৷ উচ্চশিক্ষার মান যেন নিশ্চিত হয়৷
আমি ড. ইফতেখারুজ্জামানের এই বক্তব্যকে বিশ্বাসকে করি। মন্ত্রণালয়ের উচিত টিআইবির প্রতিবেদনকে আমলে নিয়ে উচ্চশিক্ষার নামে সার্টিফিকেট ব্যবসার অসাধু চক্রকে চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। আর প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে যত উদ্যোগই নেন, আপত্তি নেই। তবে একদিনে ২ বেলা পরীক্ষা নয়।
আপনার সততা নিয়ে আমার প্রশ্ন নেই। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি আর ঘুষ। এটিকে অস্বীকার না করে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। দেশের আপামর জনতা আপনাকে স্যালুট দেবে। আর তা না হলে আপনার সম্পর্কেই মানুষের ধারণা পাল্টে যাবে। আপনার জন্যই, একটি সুন্দর শিক্ষা ব্যবস্থাপনার জন্যই তা খুবই জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক। ইমেইল- [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০১৪