ঢাকা, বুধবার, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ মে ২০২৪, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

’ফিলিস্তিন’ রাষ্ট্রের কোনো সীমানাই থাকবে না ।। রবার্ট ফিস্ক

অনুবাদ : শাহাদাৎ তৈয়ব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৪ ঘণ্টা, জুলাই ১৩, ২০১৪
’ফিলিস্তিন’ রাষ্ট্রের কোনো সীমানাই থাকবে না ।। রবার্ট ফিস্ক ছবি: সংগৃহীত

ভবিষ্যত ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কেমন হবে! মূলত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে ফিলিস্তিনের কোনো সীমানাই থাকবে না। বড়জোর ইজরাইলের অভ্যন্তরীণ একটি অঞ্চল হয়ে থাকবে ফিলিস্তিন, যার চারপাশেই থাকবে ইজরাইলের সীমান্ত।

  

গত দুইদিন থেকে এই বিকেল পর‌্যন্ত ইসরাইল আর ফিলিস্তিনিরা যে পরিমাণ হামলা করেছে তাতে পুরো হামলার ঘটনাই ইসরাইলের পক্ষে ছিল। ইসরাইলের হামলায় এ দুদিনে ৪০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। অপরদিকে ফিলিস্তিনের পাল্টা হামলায় একটি মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেনি।
তবে আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আপনি কারো কাছ থেকেই গাজায় ইসরাইলি হামলা নিয়ে সত্যিকার কাহিনিটা শুনতে পাবেন না।  

গাজা থেকে ফিলিস্তিনিরা যেসব রকেট হামলা চালাচ্ছে, তার শিকার হচ্ছে মূলত দক্ষিণাঞ্চলীয় সেদেরত অঞ্চলের ইসরাইলিরা। এতে করে সেখানকার ফিলিস্তিনিরাও এখন কিছুটা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। ঘটনা কিন্তু তাই। তবে অপেক্ষা করে দেখুন, ইসরাইলের এ এলাকার কমপক্ষে ১৫ লাখ ফিলিস্তিনি তাদের পরিবার এক সময় গাজায় বসবাস করত। বর্তমানে যাকে ইসরাইল বলা হচ্ছে, সেখানে কি তাদের বসবাস ছিল না? যখন ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টি হল, তখন বর্তমান ইসরাইল থেকে তাদেরকে বের করে দেয়া হয়েছিল, সেখান থেকে আরব ফিলিস্তিনিরা নিজেদের জীবন নিয়ে পালিয়ে আসেন।  

একটু থেমে পেছন থেকে বলছি। ১৯৪৮ এর শুরুর দিকে সেদেরতে যারা বসবাস করত তারা মোটেও ইসরাইলি ছিল না। বরং তারা হল ফিলিস্তিনের আরব। তাদের গ্রামকে হুজ বলা হত। তারা ঠিক ইসরাইলের শত্রু ছিল না। তবে সে সময় ৪৮ এর আরো দুই বছর আগে ঠিক এদের মতো কিছু আরব ব্রিটিশ আর্মির মধ্যকার ইহুদিদের গুপ্ত সংগঠন জুইশ হাগানার যোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখে। কিন্তু যখন ইসরাইলি আর্মি ১৯৪৮ এর ৩১ মে হুজে ফিরে আসে তখন তারা হুজের লোকজন ছাড়া সব আরব গ্রামবাসীকে বহিষ্কার করে গাজা উপত্যকায় পাঠিয়ে দেয়। এ ঘটনায় তখন তারা সবাই সেখানে শরণার্থী হয়ে পড়ে। ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিওন নিজেদের এ কর্মকাণ্ডকে ‘অন্যায় এবং অন্যায্য অ্যকশন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। সবেচেয়ে খারাপ দিক হল, হুজের ফিলিস্তিনিদের আর কখনো ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি।      

হুজ বর্তমানে সেদেরত নামে পরিচিত। এখান থেকেই ছয় হাজারেরও বেশি বংশধর সৃষ্টি হয়েছে, যারা বর্তমানে সবচেয়ে অধপতিত গাজা উপত্যকায় বসবাস করছে। আর ঠিক এ এলাকাটিকেই ইসরাইল ধ্বংস করছে সন্ত্রাসের নামে। ধ্বংস করতেই ইসরাইল সেখানে ‘সন্ত্রাসী’ রয়েছে বলে অভিযোগ তুলছে। যারা সেদেরতে গুলিবর্ষণ করছে তারা গাজারই এমন দাবিও করছে ইসরাইল।

আবার এ কথাও বলছে ইসরাইল যে, তাদের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। মজার গল্প বটে। আমরা ইসরাইলিদের এ যুক্তি আজ আবার শুনলাম— যদি লন্ডনের জনগণ ইসরাইলের জনগণের মতো রকেট হামলার শিকার হত তাহলে কি পাল্টা হামলা চালাত না? জ্বি নিশ্চয়ই। তবে আমরা যারা ব্রিটিশ তাদের দশ লাখেরও বেশি সাবেক অধিবাসী হাস্টিংসের (নিউজিল্যান্ডের সীমান্তবর্তী এলাকা যেটি এক সময় ব্রিটিশদের ছিল) কাছে বিশাল এলাকা জুড়ে উদ্বাস্তু হয়ে বসবাস করছে না?   

সর্বশেষ ২০০৮ সালে একই যুক্তি দেখিয়েছিল ইসরাইল। সন্ত্রাস আর আত্মরক্ষার যুক্তি দেখিয়ে সে সময় দেশটি গাজায় হামলা চালিয়ে অন্তত ১১০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে। আর ফিলিস্তিনিদের পাল্টা হামলায় ইসরাইলের মারা গেছে মাত্র ১৩ জন। এখন যদি আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন রকেট হামলার শিকার হয় তবে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত কি বলবেন? কারণ বাস্তবতা হল কি জানেন? ৭০-এর দশকে উত্তর আয়ারল্যান্ডের যুক্তরাজ্যের ক্রসমাগলেন শহর রকেট হামলার শিকার হয়। আইরিশ রিপাবলিকান থেকে এই রকেট হামলা চালানো হয়। কিন্তু ‍যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনী তো আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে এ ঘটনার ফলে পাল্টা হামলা চালায়নি। কোনো আইরিশ নারী ও শিশু হত্যা করতে কোনো সামরিক অভিযানে নামেনি ব্রিটেন।

২০০৮ সালে সে সময় ইসরাইলের সমর্থকরা কানাডায় একই ধরনের বাজে ভিত্তিহীন যুক্তি দেখিয়েছিল। কানাডার সেসব সমর্থকরা বলেছিল, যদি কানাডার ভেনকুভার, টরন্টো, কিংবা মন্ট্রিলের লোকজন তাদের উপশহরগুলো থেকে নিক্ষেপ করা রকেট হামলার শিকার হয় তবে তারা কি চিন্তা করবে? কিন্তু বাস্তবতা হল, এ ধরনের রকেট হামলার কোনো আশঙ্কাই নেই। কারণ কানাডার কর্তৃপক্ষ তাদের আসল অধিবাসীদেরকে সীমান্তের শরণার্থী শিবিরে ঠেলে দেয়নি।     
এবার আসুন পশ্চিম তীরে। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, তিনি ফিলিস্তিনের ‘প্রেসিডেন্ট’ মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে আলোচনা করতে পারবেন না। কারণ আব্বাস হামাসের প্রতিনিধিত্ব করেননি। পরে যখন আব্বাস হামাসকে নিয়ে ঐক্য সরকার গঠন করলেন নেতানিয়াহু তখন বললেন, তিনি আব্বাসের সঙ্গে আলোচনা করতে পারবেন না। কারণ আব্বাস নিজে গিয়ে ‘সন্ত্রাসবাদী’ হামাসের সঙ্গে ঐক্য গঠন করেছেন। তো এখন নেতানিয়াহু বলছেন, তিনি শুধু আব্বাসের সাথেই আলোচনা করতে পারেন। তবে শর্ত হচ্ছে, আব্বাস যদি হামাসের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন তবেই তিনি আলোচনায় যাবেন। শুধু তাই নয়, আলোচনার অপর শর্ত হল, আব্বাস হামাসের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না।   

ইসরাইলের বামপন্থী মহান দার্শনিক ৯০ বছর বয়সী ইউরি অ্যাভনারি যিনি এখনো ভালোভাবেই সচল আছেন। তো এই দার্শনিক তার দেশের এমন মানসিক বিকারগ্রস্ততার চিত্র তুলে ধরেছেন এভাবে: আইসিস (ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড দ্য ল্যাভেন্ট/শাম) ইতিমধ্যে ইরাক ও সিরিয়া থেকে পশ্চিম তীরে ঝড়ের মতো আঘাত করা শুরু করবে। এমনকি তারা জর্ডান নদীর পূর্ব তীরেও পৌঁছে যাচ্ছে।

অবশ্য নেতানিয়াহুও তাই বলেছেন। অ্যাভনারির মতে, ‘জর্ডান নদীর উপকূলে ইসরাইল যে স্থায়ী আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে, তাতেও যদি তারা (আইসিস) না থামে তবে তারা অবশ্যই তেল আবিবের প্রবেশপথগুলোতে হাজির হয়ে যাবে। ’

কিন্তু ভেতরের সত্য কথাটা হল, যেই মাত্র আইসিস ইরাক ও সিরিয়া থেকে জর্ডান সীমান্ত দিয়ে ক্রস করার চেষ্টা করছিল ইসরাইল মুহূর্তেই আইসিসের ইসরাইলমুখি তৎপরতা ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।       

তবে এ কথার আসল গুরুত্বটা হল, আইসিস থেকে রক্ষার নামে ইসরাইল যদি জর্ডান সীমান্তে তার সেনা মোতায়েন রাখে তবে ভবিষ্যতে ‘ফিলিস্তিন’ নামক রাষ্ট্রের কোনো সীমান্তই থাকবে না। এটি হবে ইসরাইলের ভেতরকার একটি অঞ্চল মাত্র। যার চারপাশ জুড়ে থাকবে শুধু ইসরাইলেরই সীমান্ত।

অ্যাভনারি এ পরিস্থিতিকে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকার কালো নৃগোষ্ঠী বান্তুস্তানীদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। [বান্তুস্তান এখন নামিবিয়ার মধ্যে হারিয়ে গেছে। ] কিংবা কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিন তখন আর বিদ্যমান থাকবে না। তাহলে সবকিছু বুঝলে আইসিসকে কি হামাসের মতো বলা যাবে না? অবশ্যয়ই নয়।

তবে নেতানিয়াহুর মুখপাত্র মার্ক রেগেবের যে কথা আমরা শুনেছি তার সঙ্গে আমার বক্তব্যের কোনো মিল নেই। সম্প্রতি আল জাজিরাকে মার্ক রেগেব বলেছেন, হামাস ‘একটি চরমপন্থী সন্ত্রাসী সংগঠন, ইরাকের আইসিস থেকে, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং বোকো হারাম থেকে হামাস খুব বেশি আলাদা নয়। ’

হিজবুল্লাহ হল শিয়া মিলিশিয়া বাহিনী, যারা এ মুহূর্তে সিরিয়ার অভ্যন্তরে আইসিসের সুন্নি মুসলিমদের সঙ্গে মরণপণ লড়াই করে যাচ্ছে। আর ইসরাইল থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের বোকো হারাম মোটেও তেলআবিবের জন্য হুমকি নয়।

তবে সবশেষে আপনি আপনার যু্ক্তিতে আসুন—হুজ বা সেদেরত থেকে যেসব আরব পরিবারগুলো গাজায় এসেছে (দয়া করে তাদের পরিচয় চিরতরে ভুলে যান) সেই ছয় হাজার ফিলিস্তিনির বংশধর এবং গাজার ফিলিস্তিনিরা হাজার হাজার ইসলামপন্থীদের সঙ্গে যুক্ত; যারা বাগদাদের মালিকির সরকারকে, দামেস্কের আসাদকে কিংবা আবুজার প্রেসিডেন্ট গুডলাক জনাথনকে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। আপনি আরো যুক্তি দিতে পারেন, যদি আইসিস পশ্চিম তীরের দিকেই ধেয়ে আসে তাহলে আরব ভূমিতে অবৈধভাবে ইসরাইল কেন এখনো কলনি বা বসতি স্থাপন করে যাচ্ছে?  

যে চার কিশোরকে হত্যা করা হয়েছে আপনি সেখানে এসব যুক্তি দেখাতে পারবেন না। অর্থাৎ পশ্চিম তীরে যে তিন ইসরাইলি কিশোরকে অবৈধভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেইসাথে দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেমে যে ফিলিস্তিনি কিশোরকে অবৈধভাবে হত্যা করা হয়েছে এমনকি হামাসের যে ব্যাপক সংখ্যক নেতাকর্মী, যোদ্ধা, রাজনীতিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শুধু এই ব্যাপারগুলোতেই আপনার এসব যুক্তি রাখতে পারবেন না। এমনকি ফিলিস্তিনের প্রশ্ন শুধু রকেটের মামলাও নয়। এটি শুধুই ভূমির প্রশ্ন।  
*লেখাটি ৯ জুলাই যুক্তরাজ্যভিত্তিক দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট এর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়।

লেখক : মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ব্রিটিশ সাংবাদিক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।