ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মান্না ভাই, ভয় পাইছি!

ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৪২ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৪
মান্না ভাই, ভয় পাইছি! মাহমুদুর রহমান মান্না / ছবি: ফাইল ফটো

আমরা যারা আশির দশকে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম, তাদের অনেকের কাছেই মাহমুদুর রহমান মান্না ছিলেন এক স্বপ্নের ছাত্রনেতার নাম।

নিজস্ব ছাত্র সংগঠনটির কলেবর তেমন বড় না হলেও ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দিয়ে সে সময়ে তিনি অযুত ছাত্র-ছাত্রীর হৃদয়ে আসন গেড়েছিলেন।



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি পর্যন্ত নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে বড় পর্যায়ের কোনো সংগঠন গড়তে না পারলেও ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি বজায় রেখেছেন ঠিকই। এমন কি তুচ্ছ ব্যক্তি কারণে রাজনৈতিক দল ভাঙলেও তার প্রতি আমাদের মুগ্ধতা কিন্তু কমেনি।

জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময় পর্যন্ত শ্রমিক-মেহনতী মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখানো মানুষটি ব্যক্তিগত জীবনে বস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ধনীদের কাতারে (যাদের তিনি এক সময় বুর্জোয়া, শোষক শ্রেনীর প্রতিনিধির মত শব্দাবলীতে ভৎর্সনা করতেন) নাম লেখালেও আমরা অবাক হইনি, বরং তার এহেন উত্তরণে খুশিই হয়েছি। ভেবেছি মানুষটা আসলেই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। এক হাতে জ্যোৎস্না ধারণ করেন তো আরেক হাতে অমাবস্যা!

বাম রাজনীতির বহু ভাংচুরের সাক্ষী হয়ে শ্রদ্ধেয় মাহমুদুর রহমান মান্না শেষমেষ আওয়ামী নৌকায় সওয়ার হলে মনে একটু খটকা লেগেছে ঠিকই, তারপরও মনে হয়েছে, যাক এবার বৃহৎ এক রাজনৈতিক প্লাটফর্মে ঠাঁই পেলেন! জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বগুড়ায় নিজ আসনে পরাজিত হলেও আওয়ামী লীগ দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সুনজরে পড়লেন ঠিকই।

ব্যাস পেয়ে গেলেন আওয়ামী লীগের মত ঐতিহ্যবাহী, বৃহৎ রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের মত গুরুত্বপূর্ণ পদ। কিন্তু ওয়ান ইলেভেনের পর রাজনীতির হিসেবে সম্ভবত একটু গড়মিল হয়ে যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্কচ্ছেদ না ঘটলেও আওয়ামী রাজনীতির মূল কক্ষ থেকে ছিটকে পড়েন তিনি।

তারপর থেকে আমরা আমাদের মান্না ভাইকে নতুন রূপে দেখছি। এবার তিনি জাতির বিবেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। গঠন করেছেন নাগরিকি ঐক্য। ইতোমধ্যে বিএনপি ঈদের পরে সরকার পতনের বিশাল আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে। তবে সে আন্দোলনের ভবিষ্যত কি হবে তা নিয়ে স্বয়ং বিএনপির নিজের ঘরেই সন্দেহ আছে।

আন্দোলনে বিএনপির সক্ষমতা নিয়েও জনগণও আজকাল খানিকটা দ্বিধান্বিত! বিগত দিনে সরকার বিরোধী

আন্দোলনে বিএনপির নজিরবিহীন ব্যর্থতায় সরকারই বরং ফুরফুরে মেজাজে। এরকম ম্যাড়মেড়ে পরিস্থিতিতে রাজনীতির দীঘিতে মৃদু আলোড়ন তুলেছেন মান্না ভাই।

গত শুক্রবার এক ইফতার অনুষ্ঠানে মান্না ভাই ঈদের পরে বিএনপির পাশাপাশি গণতন্ত্র রক্ষায় রাজপথে নামার ঘোষণা দিয়ে ‘নিন্দুকদের’ প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। প্রদত্ত এই চ্যালেঞ্জে তার তুরুপের তাস হলেন ডঃ কামাল হোসেন।

যারা বলেন যে, কামাল হোসেনকে দিয়ে কিছু হবে না, তাদের এবার তিনি দেখিয়ে দেবেন ডঃ কামালকে দিয়ে কি হয়? সেই সঙ্গে এবার তার সাথে আরো আছে শাহদীন মালিক, আসিফ নজরুলের মত বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবী, মধ্যরাতে টেলিভিশনের পর্দা কাঁপানো টক শো তারকারা।

শ্রদ্ধেয় মাহমুদুর রহমান মান্নার এহেন ঘোষণায় আমরা যারা তার অন্ধ ভক্ত তারা ভীষণ ভাবে উজ্জীবিত বোধ করছি। এবার নিশ্চয়ই একটা কিছু হবে, শুধু ঈদটা কোনোভাবে পার হোক!

সন্ধ্যায় ইফতারির পর সোফায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই মনের মধ্যে কেমন যেন একটা খঁচখচ করতে লাগলো। পারিবারিক কারণে নব্বই দশকের মাঝামাঝি ডঃ কামাল হোসেন সম্পর্কে খুব কাছ থেকে জানার সৌভাগ্য কিংবা দূর্ভাগ্য আমার হয়েছিল।

ততদিনে তিনি আওয়ামী লীগ ছেড়ে নিজস্ব রাজনৈতিক দল গণ ফোরাম প্রতিষ্ঠা করেছেন।

আমার মত অনেক নাদানই তখন ভেবেছিল, শেখ হাসিনা কিংবা বেগম খালেদা না পারলেও ডঃ কামাল হোসেন এইবার নিশ্চয়ই বাংলাদেশের রাজনীতির ধারা পাল্টে দিতে পারবেন। তার নেতৃত্বেই লেখা হবে বাংলাদেশের আগামী দিনের পথচলা। কিন্তু কিসের কি?

সময় নেই অসময় নেই তিনি উড়াল দেন বিদেশে, তাকে দেশে পাওয়াইতো ভার! যতক্ষণই বা দেশে থাকেন, তার রাজনীতির প্রধান ও সম্ভবত একমাত্র উদ্দেশ্য হল, কি ভাবে শেখ হাসিনার বিরোধিতা করা যায়।

মাঝে মধ্যে তাই দ্বন্দ্বে পড়ে যেতাম, গণ মানুষের মুক্তি না কি শেখ হাসিনার প্রতি বিদ্বেষ, কামাল হোসেনের রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য আসলে কোনটা? সেই ডঃ কামাল হোসেনের উপরেই মান্না ভাই বাজি ধরছেন!

আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, মান্না ভাই কি ডঃ কামাল হোসেনের আগামী এক বছরের বিদেশ সফরের সূচিটা সংগ্রহ করেছেন? কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না, জনবিচ্ছিন্ন, সাম্প্রতিক রাজনীতিতে পরীক্ষিতভাবে ব্যর্থ এই মানুষটার ওপর কিভাবে বাজি ধরা যায়? নাকি সবাই মিলে কোন একটা ষড়যন্ত্রের ঘোঁট পাকানোর অপচেষ্টা করা হচ্ছে?

ঈদের পরে শুরু হওয়া নাগরিক ঐক্যের আন্দোলন এবার সফল হবেই। এ ব্যাপারে ভীষণ আশাবাদি মাহমুদুর রহমান মান্নার ভাষ্য, ‘আমাদের আন্দোলন সফল হবে।

কারণ, জনগণ জানে, মাহমুদুর রহমান মান্না যখন কথা বলে, ডঃ কামাল হোসেন যখন কথা বলে, শাহদীন মালিক যখন কথা বলে, ডঃ আসিফ নজরুল যখন কথা বলে তখন তারা কোনো ধান্দাবজি থেকে কথা বলে না (সুত্র: কালের কণ্ঠ, ১৯ জুলাই)।

যে সব টক শো তারকাদের ওপর ভর করে তিনি আন্দোলনে সাফল্যের স্বপ্ন দেখছেন, তাদের সম্পর্কে আমজনতা বর্তমানে কি ধারণা পোষণ করেন তা কি মান্না ভাই জানেন?

এই যে যেসব টকশো তারকাদের নাম তিনি বলেছেন, তাদের একজনকে সেই ছাত্র জীবন থেকেই চিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সন্ত্রাসী ছাত্রনেতা যিনি সন্ত্রাসকে শিল্পের পর্যায়ে নেবার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন তার খুবই ঘনিষ্ট ছিলেন এই টক শো তারকা।


ব্যক্তি জীবনে অনেক নয়-ছয় করলেও টেলিভিশনের পর্দায় তথাকথিত নিরপেক্ষতার ভেকধারী এই টক শো তারকাকে আড়ালে আবডালে লোকজন আজকাল ‘ওরস্যালাইন বুদ্ধিজীবী’ বলে ডাকে।

এক মুঠ বিএনপি, এক চিমটি আওয়ামী লীগ আর আধা সের জামায়াতের পক্ষে কথা বলে তিনি যে নিরপেক্ষতার ভং ধরেন, লোকজনের তা বুঝতে আর বাকি নেই। নিরপেক্ষতার মুখোশের আড়ালে আপাদমস্তক আওয়ামী বিরোধী কতিপয় জনবিচ্ছিন্ন, বাক সর্বস্ব মানুষ নিয়ে মাহমুদুর রহমান মান্না দেশবাসীকে ঈদের পরে কি যে দেখাবেন আর কীভাবেই বা দেখাবেন, ভেবে ভেবে হয়রান হয়ে যাচ্ছি! ভয়ও পাচ্ছি খুব! মান্না ভাই তো আর যে সে মানুষ নন! তার মানে কী আসন্ন ঈদের পরপরই বর্তমান সরকারের বিদায়ের ঘন্টা বেজে যাবে?
 
বাংলাদেশের রাজনীতির সাম্প্র্রতিক ইতিহাস মাহমুদুর রহমান মান্নার পক্ষে কথা বলে না। তাই আমরা যারা মাহমুদুর রহমান মান্নার একনিষ্ঠ ভক্ত, তাদের আশংকা সরকার পতন নয় অন্যখানে।

যে সব মানুষের উপর ভর করে মান্না ভাইয়ের এই আস্ফালন, অচিরেই তা ফুটো বেলুনের মত চুপষে যাবে না তো?"

ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন, কবি ও চিকিৎসক। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াস্থ নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত।
ই-মেইল: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ২১২৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।