ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

অস্তিত্ববাদ ও ফিলিস্তিনের মানবাধিকার

মুহাম্মদ উবায়দুল হক, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৭ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৪
অস্তিত্ববাদ ও ফিলিস্তিনের মানবাধিকার ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: অস্তিত্ববাদ বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম মতবাদ । পৃথিবীর আনাচে-কানাচে যত মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, অস্তিত্বতবাদ ও ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয়টি তত জোরালো হচ্ছে।



কিছুদিন ধরে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল যে মানবতাবিরোধী বর্বর হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে,  সে প্রেক্ষিতে অস্তিত্ববাদের বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে ।

অস্তিত্ববাদ কি? সে ব্যাপারে তাত্ত্বিক ধারণা নেয়া প্রয়োজন ।

অস্তিত্ববাদ হল – কোন জিনিসের অবস্থান বা উপস্থিতিকে মেনে নেয়া । অস্তিত্ববাদের প্রবক্তা জাঁ পল সার্ত্রে তার অস্তিত্ববাদ ও মানবতাবাদ গ্রণ্থে বলেন- “ব্যবহৃত অর্থে অস্তিত্ববাদ হল এমন একটি মতবাদ যা জীবনকে সম্ভব করে তোলে । ”

ফ্রেডারিক নাটশে, জাঁ পল সার্ত্রে, মার্টিন হাইডেগার ছিলেন অস্তিত্ববাদী দার্শনিক । মূলত প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর জার্মানি ও ফরাসি দেশে এবং ২য় মহাযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং অন্যান্য দেশের বুদ্ধিজীবীদের মাঝে এই চিন্তার উদ্ভব ও বিকাশ হতে দেখা দেয় । যদিও প্রথম কিয়েরকিগার্ড অস্তিত্ববাদ বা Existentialism নিয়ে কথা বলেন ।

অস্তিত্ববাদকে সাধারণত তিন ভাগে বিন্যস্ত করা যায় ।

১. ধর্মতাত্বিক রূপে অস্তিত্ববাদ
২. দার্শনিক রূপে অস্তিত্ববাদ
৩. সাহিত্য-শিল্পে অস্তিত্ববাদ

অস্তিত্ববাদ মানুষকে নেহায়েত বস্তু বা বিষয় হওয়া থেকে রক্ষা করে । এখানে সাধারণ সত্তার পূর্বে ব্যক্তি সত্তার স্বীকৃতি গুরুত্ব পায়। সঙ্কটে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ব্যক্তি তার অস্তিত্বের জানান দেয় । ফরাসি দার্শনিক জাঁ পল সার্ত্রে মনে করতেন- সত্তা বা অধিবিদ্যিক ধারণার আদতে কোন প্রয়োজন নেই । কারণ , তা পরিপূর্ণভাবে মানুষের জীবনে সুখ প্রদান করে না । অস্তিত্ব স্বীকার হলেই মানুষের জীবনে প্রকৃত সুখ অর্জিত হয় । এর কারণও মানুষের প্রকৃতিগত স্বাধীনতা । স্বাধীনতাই মানুষকে সাহায্য করে সব কিছুকে চিনতে, ভাবতে, আবিষ্কার ও অর্জন করতে । অস্তিত্ববাদে প্রতিটি সত্য ও কাজের পেছনে পরিবেশ ও মানুষের আত্মশক্তিভাব উভয়েরই স্বীকৃতি রয়েছে । মানুষ নিজেকে গড়ার সাথে সাথে পরিবেশকেও গড়ে তোলে । সুতরাং অস্তিত্ববাদের সাথে দায়বদ্ধতা বা দায়িত্বশীলতার ব্যাপারটি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চলে আসে। এর ভিত্তিতে বলা যায় যে, অস্তিত্ববাদ বা ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে কেউ লাগামহীন হবে না ; বরং দায়িত্বশীল হবে ।

Absolute Freedom Of Choice এর ধারণা এখান থেকেই এসেছে । আমরা আমাদের চারপাশ ও পৃথিবীতে দেখি সামগ্রিকতার কাছে ব্যক্তি মানুষ কতইনা অসহায় হয়ে যাচ্ছে দিন দিন ! মানবতা সামগ্রিকতার পদতলে করুণভাবে পিষ্ট হচ্ছে । পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে অদ্যবধি যত যুদ্ধ, সংঘাত হয়েছে তার সবই ব্যক্তি স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেই হয়েছে । সেখানে চাপা পড়েছে অস্তিত্ববাদ । সংঘটিত হয়েছে ঘৃণ্য সব অত্যাচার, নির্যাতন আর হত্যাযজ্ঞের কালো অধ্যায়।

আজকের ফিলিস্তিনের দিকে তাকালেই বিষয়টি আরও ভালভাবে স্পষ্ট হবে। মূল সমস্যা শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর। যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনের বেশিরভাগ এলাকা চলে যায় ব্রিটেন-ফ্রান্সের অধীনে । ১৯১৭ সালে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর ইহুদিদেরআলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন । বেলফোর ঘোষণার পর অবৈধ ইসরাইল সর্বশক্তি নিয়োগ করে ফিলিস্তিনিদের উপর চেপে বসে । ১৯০৫ সালে যেখানে ইহুদি ছিল মাত্র কয়েক হাজার । কিন্তু ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন স্থান  থেকে জড়ো হয়ে তারা ৬ লাখে উন্নীত হয় ।

১৯১৮ সালে হাগানাহ নামক এক গুপ্ত বাহিনী গঠন করে ইহুদিরা। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনের ভূ-খণ্ডকে দ্বিখন্ডিত করে ১৮১ নম্বর প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেখানে ৪৫% ফিলিস্তিনিদের এবং ৫৫% ইহুদীদের দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ।

এভাবে ইসরায়েল ১৯৪৮ সালের ১৪ মে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে । এরপর থেকেই শুরু হয় মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন আর জবরদখল। যা এখনও চলছে। বুকের ভেতরটা হু-হু কেঁদে ওঠে অসহায় ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ওপর পাষণ্ড রক্ত পিপাসু ইসরায়েলি নির্মম হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতায়।

রক্তক্ষরণ আরো বেড়ে যায় যখন দেখি ছোট্ট নিষ্পাপ শিশুদের নির্মম পাষণ্ডের মতো হত্যার ভয়ানক চিত্র।

রক্তপিপাসু ইসরায়েল মুসলমানদের হত্যা করে যেমন উল্লাস করছে তেমনি বিশ্ব মানবাধিকার সংগঠনগুলোসহ বিশ্ব নেতারাও মনে মনে হাসছে আর মুসলমানদের রক্ত দেখে উল্লাস করছে।

সেই কান্নার আওয়াজ এবং কষ্টের আহাজারি শুনে না কেঁদে উপায় নেই। মানবতার শত্রু ইহুদিবাদী ইসরায়েল প্রতিবারই নানা ঠুনকো অজুহাতে অসহায় ফিলিস্তিনিদের সাথে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়।

ঠিক তেমনি এবারও ইসরায়েলের বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকার একটি খামখেয়ালি অজুহাত দাঁড় করিয়ে যুদ্ধ বাঁধিয়ে নিরীহ অসহায় মুসলমানদের হত্যা করছে।

এ দফায় যুদ্ধের কারণ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে তিন ইসরায়েলি তরুণের অপহরণ ও হত্যার ঘটনা। ইসরায়েল অভিযোগ করেছে এই তিন তরুণকে হামাস অপহরণ করে হত্যা করেছে। তবে হামাসের পক্ষ থেকে এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। হামাস বলেছে তারা এ তিনজনকে অপহরণ কিংবা হত্যা করেনি।

তবে এ কথায় ইসরাইল সরকার কর্ণপাত না করে গাজা থেকে কয়েকশ হামাস কর্মীকে গ্রেফতার করে প্রকৃত ঘটনা খোঁজার নামে তাদেরকে নির্যাতন করছে। শুধু তাই নয় কট্টরপন্থী ইহুদিবাদী ইসরায়েল একজন ফিলিস্তিনি নিরপরাধ কিশোরকে ধরে নিয়ে জীবিত অবস্থায় আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে।

এছাড়া সবর্শেষ ওই তিন কিশোরকে হত্যার মিথ্যা অজুহাতে অসহায় ফিলিস্তিনিদের সাথে যুদ্ধের নামে মুসলমান হত্যার ধ্বংসলীলা শুরু করেছে। ফিলিস্তিনে ঐক্যের সরকার গঠনের পর থেকে ইসরায়েলের টার্গেট হল ফিলিস্তিনি সমাজ ব্যবস্থায় বিভাজন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা। একটি ভঙ্গুর সমাজ ব্যবস্থা কোনরকম টিকিয়ে রেখে সেই সমাজের উপর আধিপত্য ও দাসত্ব কায়েমের হীন স্বার্থান্ধ নীতি জীবিত রাখা । সে কারণে সম্প্রতি ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে সদ্য সম্পাদিত 'একতার সরকার' (government of unity) চুক্তির প্রতি ইসরায়েল নগ্ন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।
 
গত ৮ জুলাই থেকে চলমান এ হত্যাযজ্ঞে পনের দিন পর্যন্ত অসহায় ফিলিস্তিনির ওপর ইসরাইল  কয়েক হাজার  বারেরও বেশিবার বিমান হামলা, স্থল হামলা চালিয়েছে।   এই বর্বর বিমান হামলায় ৯ শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যার স্বীকার হতে হয়েছে পাষণ্ড নেতানিয়াহু বাহিনীর হাতে।   যার ৭৭ শতাংশ মানুষই হলো বেসামরিক নিরীহ মুসলমান।

অবরুদ্ধ গাজায় যুদ্ধ নয়, সেখানকার মুসলমানদের ওপর  একতরফা গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরায়েল। তাদের হাজার বছরের মাতৃভূমি দখল করে নিয়েছে উড়ে এসে জুড়ে বসা ইহুদিরা। পুরো ঘটনাটি ঘটেছে বিশেষ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানের পর আন্তর্জাতিক শক্তিধরদের সহায়তা, উদ্যোগ ও উসকানিতে। পৃথিবীর ইতিহাসে এতবড় অন্যায় আর কোথাও হয়েছে কি-না সন্দেহ। যখনই রক্ত পিপাসু, পাষণ্ড, কট্টরপন্থী ইহুদিবাদী ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সংকট দেখা দেয় তখনই গাজায় অভিযান চালিয়ে মুসলমানদের হত্যা করে ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন সরকার তাদের শক্তি সংহত করে এবং নিজেদের জনসমর্থন বাড়ানোর চেষ্টা করে।

এ প্রেক্ষিতেই ফিলিস্তিনের অসহায় মুসলমানদের নির্মমভাবে হত্যা করে পাষণ্ড ইসরায়েল সরকার মুসলমানদের লাশ দেখে উল্লাস করছে।
 
আজ  যখন ফিলিস্তিনে শত শত মুসলমানকে হত্যা করা হচ্ছে তখন মানবাধিকার সংগঠনগুলো নীরব। হারিয়ে গেছে হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ, অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ সকল মানবাধিকার সংগঠনের মানবতার উচ্চবাচ্য। তাদেরকে প্রশ্ন রাখতে চাই আজ তারা নীরব কেন? কেন তারা আজ কোন রকম প্রতিবাদ করছে না? কেনইবা তারা তাদের মানবতার বাণী হারিয়ে ফেলেছেন? তাহলে কি মুসলমান জাতিকে হত্যা করা হচ্ছে বলেই তাদের নীরবতা?

একথা বার বার প্রমাণিত হয়েছে যে-ফিলিস্তিনের অস্তিত্বকে ইসরায়েল চিরতরে নিঃশেষ করে দিতে চায়। গত এক সপ্তাহের বিমান হামলায় শত শত ফিলিস্তিনী প্রাণ হারালেও তারা ভূমিতে থেকেই ইসরায়েলের বর্বরতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। সংগ্রাম করে যাচ্ছে তাদের স্বাধীন অস্তিত্বের জন্য ।

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রক্রিয়ার পুনঃপ্রতিষ্ঠা তখনি সম্ভব যখন উভয়েই তাদের চাওয়া-পাওয়ার অগ্রাধিকারগুলোর যৌক্তিক অর্জন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে। একে অপরের অস্তিত্বের স্বীকৃতি দেবে। সে পথ ধরেই ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মৌলিক মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে । গোটা পৃথিবীর মানবাধিকার সুরক্ষার মূলমন্ত্রও অস্তিত্ববাদের পূর্ণ স্বীকৃতি ।

লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১৯২৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।