আর কদিন বাদেই ঈদ। ঈদ মানেই আনন্দ, ঈদ মানেই অনাবিল খুশি।
অবশ্য তিনি আশ্বস্ত করেছেন, ঈদের পরে বিএনপির আন্দোলন হবে শান্তিপূর্ণ। কিন্তু বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের হুমকি শুনে যেকোনো দুর্বল চিত্তের মানুষের বুকে কাঁপন ধরাই স্বাভাবিক। তিনি একধাপ এগিয়ে কঠোর ভাষায় বলেছেন, গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে কী আন্দোলন দেখেছেন? ঈদের পর আন্দোলন হবে উত্তাল, তাতে আপনারা (ক্ষমতাসীন সরকার) ভেসে যাবেন। (সূত্র: ইত্তেফাক, ২৪ জুলাই, ২০১৪)। বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সভাপতি আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে ঈদের পরে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এই আন্দোলন ব্যর্থ হবে না। আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে একনায়কতন্ত্রের অবসান হবে, গণতন্ত্রের মুখোশ পরে থাকা স্বৈরাচারী সরকারের পতন হবে। (সূত্র: বাংলানিউজ, ২৩ জুলাই, ২০১৪)
বিএনপি নেতাদের ভাষায় ঈদের পর আন্দোলন হবে উত্তাল ও কঠোর, যা গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরের আন্দোলনের মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরের আন্দোলনের চেয়ে ভয়াবহ আর কী কঠোর আন্দোলন করবেন তা বিএনপি নেতারাই ভালো জানেন। হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও, বোমাবাজি, গাড়ি ভাংচুর, চলন্ত গাড়িতে এসিড নিক্ষেপ, কেরোসিন নিক্ষেপ করে আগুন ধরিয়ে দেয়া এর চেয়েও ভয়াবহ ও কঠোর আর কী করতে চান তারা! আল্লাহ মালুম। আন্দোলন নিয়ে বিএনপি নেতাদের এমন হুমকি-ধমকিতে আসন্ন ঈদের আনন্দ মাটি না হলেও ঈদের পরে ঘরে ফেরা বা কাজে ফেরা মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হবে এটাই স্বাভাবিক। একজন শ্রমজীবী হিসাবে আমি তো খুবই আতঙ্কিত। কেননা বিএনপির শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের (!) নমুনা এর আগেও মানুষ দেখেছে। হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও, বোমাবাজি, গাড়ি ভাংচুর, চলন্ত গাড়িতে এসিড নিক্ষেপ, কেরোসিন নিক্ষেপ করে আগুন ধরিয়ে দেয়া ইত্যাদি যদি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হয় তবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট নেতাদের প্রতি করজোড়ে অনুরোধ, দয়া করে এমন শান্তিপূর্ণ (!) আন্দোলন দেশের সাধারণ জনগণের ওপর আর চাপিয়ে দিবেন না।
গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে দেশব্যাপী যে ব্যর্থ আন্দোলন আপনারা করেছেন তাতে ক্ষমতাসীনদের একচুলও নড়াতে পারেননি। অথচ এর বলি হয়েছে নিরীহ নিরপরাধ সাধারণ মানুষ। জলন্ত আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হয়েছে শতাধিক মানুষ। নির্বাচনের আগের কয়েক মাসের সহিংসতায় মারা গেছেন শতাধিক মানুষ। আন্দোলনের কঠোরতা আর ভয়াবহতা এত বেশি ছিল যে, শুধু নির্বাচনের দিনই দেশব্যাপী নিহত হয়েছিল অন্ততঃ কুড়ি জন। দেশব্যাপী পুড়েছে সহস্রাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও যানবাহন। সামনে ঈদ, যে মানুষগুলো ওই ব্যর্থ আন্দোলনে পিতা-পুত্র-ভাই কিংবা স্বজন হারিয়েছে এই ঈদে তাদের ঘরে কি ঈদ আনন্দ আসবে? তারা কি স্বাভাবিকভাবে ভাগাভাগি করতে পারবে তাদের ঈদের আনন্দ! আন্দোলনপ্রেমী নেতারা তাদের মনের হাহাকারের খবর কি নিয়েছেন?
একটিমাত্র উদাহরণ দিয়ে বলি, গাজীপুরে ট্রাকে দেওয়া আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া মনিরের পিতা কি পারবে পুত্রশোক কাটিয়ে এবার আনন্দঘন ঈদ উদযাপন করতে? বেঁচে থাকলে হয়তো মনিরও বায়না ধরতো একটি নতুন জামার। সেই বিস্মৃতি কী করে ভুলবেন দুর্ভাগা পিতা।
ধরি, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হয়নি, কিন্তু এর দায় কী শুধু সরকারের, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোটের নয়? তারা কি কোনোভাবে এই দায় এড়াতে পারেন! নির্বাচন প্রতিহত করতে ১৯ দলীয় জোট যে সহিংস আন্দোলন করেছিলো আর যাই হোক তাতে সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল না একথা হলফ করে বলা যায়। জনসমর্থন থাকলে সে যাত্রায় তাদের আন্দোলন ব্যর্থ হতো না। ফলে কঠোর (বিএনপির ভাষায়) বা ভয়াবহ সেই আন্দোলন সত্বেও ‘বিচার মানি তাল গাছ আমার’ টাইপের একগুয়েমি মনোভাবের কারণে গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে উভয়পক্ষই। কিন্তু এর মূল্য দিতে হয়েছে সাধারণ জনগণকে জীবন দিয়ে, সম্পদ দিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপনের অধিকার বিসর্জন দিয়ে। দায়িত্বশীলতার বিচারে কোনোপক্ষই জনগণের সেই ক্ষতির দায় এড়াতে পারেন না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জনগণের জন্য রাজনীতি নাকি রাজনীতির জন্য জনগণ? নেতারা যা চান জনগণ তা চায় কিনা? আন্দোলন নাকি আনন্দঘন পরিবেশ, শান্তি না সহিংসতা? আন্দোলনের মতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিএনপির উচিত এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা।
উত্তরটা অবশ্য বঙ্গবন্ধু তার কালজয়ী ভাষণেই দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এদেশের মানুষ শান্তি চায়, নিরাপত্তা চায়’। এই ভাষণের আবেদন এখনো ফুরিয়ে যায়নি, আজীবন ফুরাবে না। কারণ দেশের একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে একথা শতভাগ বিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি, এদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। তারা শান্তি চায়, নিরাপত্তা চায়। স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকার চায়। আর তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকার ও বিরোধী দলের সমানে- সমান। কেননা, জনগণ ছাড়া তাদের রাজনীতির অন্যকোনো গন্তব্য নাই। এই বোধ যত তাড়াতাড়ি রাজনীতিবিদদের হবে, সেটাই জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। আন্দোলন আর জ্বালাও-পোড়াও করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা যায়, কিন্তু জনসমর্থন আদায় করা যায় না। তা করতে হয় জনসংযোগ করে, আর আসছে ঈদ তার একটা বড় সুযোগ।
আগেই বলেছি, আন্দোলনের নামে আতঙ্ক তৈরি করা যায়, জনসমর্থন আদায় করা যায় না। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপনে বিঘ্ন ঘটানোর অধিকার রাজনীতিবিদদের নেই। মানুষ এখন আর সহিংস আন্দোলন পছন্দ করে না, বিকল্প ভাবুন, জনগণের বিশ্বাস আর আস্থা আদায় করুন। জনবিচ্ছিন্ন আন্দোলনের চেয়ে জনবান্ধব আলোচনা বা সংলাপ সংকট সমাধানের অন্যতম উপায়। জনগণের চলাফেরার স্বাধীনতা, শিক্ষা-দীক্ষা, কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ না করে কীভাবে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছা যায় সেটা নিয়ে ভাববার এখনো সময় আছে। পাশ মার্ক না পেলেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর মানুষ আপাতত: কিছুটা স্বস্তিতে ও শান্তিতে আছে এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। সাধারণ মানুষের সেই স্বস্তি ও শান্তিটুকু কেড়ে নিবেন না প্লিজ! সবাইকে ঈদ মোবারক।
লেখক: উর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি, গাজীপুর. Email: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৮ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৪