সাধারণভাবে তার পরিচয় নোয়াখালীর ‘ক্ষিতীশ চৌধুরী’ আর তরুণ-যুবাদের কাছে ‘ক্ষিতীশ দা’। প্রকৃত নাম ক্ষিতীশচন্দ্র রায় চৌধুরী।
জন্ম নোয়াখালীতে, ১৮৯৩ সালে। পৈত্রিকসূত্রে তারা ছিলেন ফরিদপুর জেলার ইদিলপুরের চৌধুরী বংশের। কিন্তু তার বাবা ভগবানচন্দ্র রায় চৌধুরী নোয়াখালী জেলা শহর (পুরাতন) ফকিরতলায় বসবাস শুরু করেন। এ জেলাতেই ছিল তার কর্মক্ষেত্র, জমি-জমা ও তালুক। ক্ষিতীশচন্দ্র রায় চৌধুরী নোয়াখালীর সেই ঘরে জন্ম নেন। এখানেই ছিল তার কর্মক্ষেত্র, দেশভাগের পরও তা আর পরিবর্তিত হয়নি। মেঘনার ভাঙনের পর নোয়াখালীর নতুন শহরে তিনি বসবাস শুরু করেন।
ক্ষিতীশচন্দ্রের পরিচয়ের সঙ্গে নোয়াখালীর গত শতাব্দীর রাজনৈতিক, সামাজিক ইতিহাস জড়িত। ১৯০৫ সালে ‘স্বদেশী যুগের’ মধ্যে ক্ষিতীশচন্দ্রের জীবন শুরু। ঐ সময় নোয়াখালীতে ‘জাতীয় বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠায় সে জাগরণের উদ্বোধন হয়। কিশোর ক্ষিতীশ এ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, যেমন ছিলেন নরেন ঘোষ চৌধুরীসহ অন্যান্য অগ্রজ বিপ্লবী কর্মীরা। এদের কেন্দ্র করেই নোয়াখালীতে বিপ্লবী জাতীয় চেতনা ও কর্মধারা গড়ে ওঠে। এ গোষ্ঠীর পক্ষে নরেন ঘোষ চৌধুরী ও সতেন্দ্র চন্দ্র মিত্র সম্পর্ক স্থাপন করেন। যোগাযোগ তৈরি করেন। বরিশাল শহরের মঠে যতীন্দ্রনাথ মুখার্জির (বাঘা যতীন) নেতৃত্বে যুগান্তর দলের কর্মীদের সঙ্গে নোয়াখালীর বিপ্লবী তরুণরা একত্র হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) শুরু তখন। নোয়াখালীর বিপ্লবীদের উপরে দায়িত্ব পড়েছিল হাতিয়া দ্বীপে জার্মান যুদ্ধজাহাজ থেকে অস্ত্র লুট করে নেওয়া এবং দেশের সবজায়গায় এসব অস্ত্র সরবরাহ করা ছিল তাদের দায়িত্ব। এ পরিকল্পিত অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু নোয়াখালীর কর্মীরা নগেন্দ্রকুমার গুহরায়, ক্ষিতীশচন্দ্রের পরিচালনায় তাদের কর্তব্য পালনে নিবেদিত ছিল।
অনেকের মতই ক্ষিতীশচন্দ্রের স্কুলে পড়া আর শেষ হয়নি। তিনি নরেন ঘোষ চৌধুরীর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন দুঃসাহসিক বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। সেই সময়ে তিনি নদীয়ার শিবপুর ডাকাতি মামলায় গ্রেফতার হন। কিন্তু বিচারে খালাস পেলেও তিনি যশোরের একটি গ্রামে অন্তরীণ হন। তিন বছর পরে যুদ্ধশেষে মুক্তিলাভ করে নোয়াখালীতে ফিরে আসেন। শুরু করেন জীবনের দ্বিতীয় পর্ব।
অসহযোগের মন্ত্র নিয়ে তিনি একজন কংগ্রেসকর্মী হিসেবে জন-প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দেন। পাশাপাশি তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভে বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষায় তরুণ ও ছাত্রদের সংগঠিত করেন। কিন্তু এ সময় থেকে তিনি গণ-আন্দোলনে প্রধান কর্মী হয়ে উঠেন। কংগ্রেস আন্দোলনের সঙ্গে থাকায় তিনি ১৯২১ সালে ৬ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেন। মুক্তি পেয়ে আবার তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মনোনিবেশ করেন। এবার তিনি স্বরাজ্য পার্টিতে যোগ দেন। এতে স্থানীয় সংগঠক হিসেবে অবতীর্ণ হন তিনি।
শুধু রাজনৈতিক দায়িত্ব নয়, এ সময়ে অস্পৃশ্যতা প্রভৃতি প্রতিটি সামাজিক বাধা দূরীকরণের প্রয়াসে, স্থানীয় প্রতিটি অবিচার-অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনসাধারণের উদ্যোগে ও আন্দোলনে, নেতাজি সুভাষচন্দ্রের সহযোগী হয়ে বন্যা ত্রাণে, স্বরাজ্য পার্টির কর্মপদ্ধতি ও বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে ক্ষিতীশচন্দ্র জনজীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেন। ১৯২৪ থেকে ১৯২৭ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় অবসাদ ও সাম্প্রদায়িক বিরোধের পর্বে তিনি নোয়াখালীর কংগ্রেসের অদম্য কর্মী, হিন্দু-মুসলমানের মিলনের সুদৃঢ় সাধক, সাপ্তাহিক ‘দেশের বাণী’ পত্রিকার নির্ভীক সম্পাদক, সেই সম্পাদক হিসেবে রাজদ্রোহের অপরাধে তিন মাস কারাদণ্ড, নোয়াখালী জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক, সেই সঙ্গে সমাজ বৈষম্যের বিরোধীতায় নোয়াখালীর কৃষক আন্দোলনের সহায়ক হিসেবে তাকে পাওয়া যায়।
১৯২৭ সালে ভুলুয়ার জমিদার অরুণ চন্দ্র সিংহের আর্থিক সাহায্যে ‘দেশের বাণী’ নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ক্ষিতীশচন্দ্র রায় চৌধুরীর সম্পাদনায় নোয়াখালীর বাণী প্রেস হতে মথুরানাথ চক্রবর্তী দ্বারা এ পত্রিকা প্রকাশিত হতো। উল্লেখ যে, তৎকালীন ভারত সরকারের গোয়েন্দা রিপোর্টে তার সম্পাদিত ‘দেশের বাণী’ ‘কমিউনিস্ট পত্র’ বলে চিহ্নিত হয়েছিল। বিপ্লবের সূত্র ধরেই কংগ্রেসম্যান, কৃষককর্মী, সামাজিক সংগ্রামের উদ্যোক্তা, শহরের অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব হিসেবে মিউনিসিপ্যালিটির ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সেই কারণে সমস্ত বাংলায় তার পরিচয় নোয়াখালীর ক্ষিতীশ চৌধুরী হিসেবে। অগ্রগামী যুব সমাজে তিনি হয়ে ওঠেন ‘ক্ষিতীশ দা’। লেখায়, বক্তৃতায়, সব জায়গায় সতত কর্মরত, নির্ভীক ও নিরলস।
এ সময়ে (১৯৩০-৩২) আইন অমান্য আন্দোলনের স্থানীয় মূল নেতা হিসেবে তিনি আবার তিন মাস কারাদণ্ডিত হন। ইতোমধ্যে ‘চট্টগ্রাম বিদ্রোহের’ পরে সারাদেশে যে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড উদ্বেল হয়ে উঠে তারই সহায়ক হিসেবে ১৯৩২ সালে ক্ষিতীশচন্দ্র গ্রেফতার হন ও বিনা বিচারে অবরূদ্ধ হন। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত বক্সা ও দেউলি বন্দিনিবাসে তিনি কাল যাপন করেন।
তৃতীয় পর্বের অধ্যায় শুরু হয় ১৯৩৮ সালে। ক্ষিতীশচন্দ্র তখন কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ, স্থানীয় কংগ্রেসের অগ্রগণ্য নায়ক। কিন্তু কৃষক আন্দোলনের এবং নেতাজি সুভাষচন্দ্রের ও তৎকালীন কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন যুবক দলের সমর্থকও। অবিভক্ত নোয়াখালী জেলা কমিউনিস্ট পার্টি গঠনেও তিনি ভূমিকা রাখেন। ‘যুগান্তর দলে’র আত্মবিলোপের পর ক্ষিতীশচন্দ্র কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানও করেন। এ কথা বলাই বাহুল্য, তিনি ধ্যানে, জ্ঞানে, জীবনযাত্রায় ছিলেন চিরায়ত ঘরানার কমিউনিস্ট। এদেশে একটি শোষণ-বঞ্চণা-ভেদ বৈষম্যহীন সাম্যের সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন দেখতেন।
ভারতবর্ষের সেই পর্বের সাম্প্রদায়িক বিরোধ ও কলকাতা-নোয়াখালীর ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা পরে দেশ ভাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তরে গিয়ে পৌঁছায়। তখন ক্ষিতীশ চৌধুরী দাঙ্গাবিরোধে ব্যর্থকাম, জাতীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব ও হত্যালীলায় বেদনার্ত, আবাল্যের স্বপ্ন ‘ভারতের স্বাধীনতা’ খণ্ডিত রক্তাক্ত রূপকে সমস্ত প্রাণ দিয়ে অঙ্গীকার করতে ভগ্নোৎসাহ। তার নিজের জন্মস্থান ও কর্মক্ষেত্র যে রাষ্ট্রভূক্ত, তাকে তিনি নীরবে স্বীকার করে নেন-যা ত্যাগ করে ভারতরাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ করতে চাননি। পূর্ব পাকিস্তানে তার কর্মক্ষেত্র নেই, কিন্তু সেই রাষ্ট্রের মঙ্গল, তার হিন্দু-মুসলমানের মিলন ও হিত সাধনা করে গেছেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও রাজাকাররা এই ৭৫ বছরের বৃদ্ধকে হত্যার চেষ্টা করে। স্থানীয় মুসলমানদের চেষ্টায় তিনি রক্ষা পান। পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি আত্মগোপন করে থাকেন।
অনেক স্বপ্নের অবসান, অনেক আর্দশের বিকৃত পরিণতি দেখতে দেখতে আবাল্যের স্বাধীনতার উপাসক, বিপ্লবী কর্মী, সমাজকর্মী, কৃষক কর্মী, সাংবাদিক, সম্পাদক, কমিউনিস্ট কর্মী ক্ষিতীশচন্দ্র রায় চৌধুরী ১৯৭৬ সালে আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য কলকাতায় গিয়েছিলেন। কঠিন অসুস্থ অবস্থায় কলকাতার রিষড়া সেবাসদনে প্রায় আটমাস থাকার পর ১৯৭৭ সালের ২০ নভেম্বর সন্ধ্যায় তিনি প্রয়াত হন।
কলকাতায় গিয়ে খুঁজেছিলেন তার নিজ রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও ভারতরাষ্ট্রের মানুষের জন্য একটু আশ্বাস-দুই রাষ্ট্রের মানুষের স্বাধীনতা সত্য ও সম্পূর্ণ হয়ে উঠবে এই আশ্বাস। তার মৃত্যুর পর কয়েকটি জায়গায় স্মরণসভা, শোকসভা হয়েছে। তবে বিস্ময়কর হলেও সত্য-তার স্মরণে কোনো জীবনী বিশেষ প্রকাশিত হয়নি।
এই বিপ্লবীর প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
হাবীব ইমন: শিক্ষক, কবি, গণমাধ্যমকর্মী
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ০৫৫৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০১৪