আরো একটি বছর চলে গেলো। শূন্যতা পূরণ হচ্ছে না, হবেও না।
হ্যাঁ, আমাদের মিশুক মুনীর। যার শিক্ষার্থীদের সর্বশেষ ব্যাচের আমি একজন। এটিএন নিউজের শুরুটা বন্ধুরা দলেবলে। আমি, মুন্নী সাহা, প্রভাষ আমিন, কাজী তাপস সবাই একসঙ্গে কাজ করেছিলাম ভোরের কাগজে। তখনও কিছুদিনের জন্য আমাদের চিফ রির্পোটার ছিলেন মঞ্জুরুল ইসলাম। তিনি আবার এটিএন নিউজের প্রথম সিইও। তার চলে যাওয়ার পর পেয়েছিলাম মিশুক মুনীরকে। কানাডায় প্রবাস জীবনে রিয়াল নিউজের দায়িত্ব ছেড়ে দেশে ফিরে এসেছিলেন দেশের রিয়াল নিউজ চ্যানেল করার জন্য। কারণ বাংলাদেশে বেসরকারী টেলিভিশনের সাংবাদিকতার শুরুটাও হয়েছিল তার হাত ধরেই একুশে টেলিভিশনে। তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে টেলিভিশনে যোগ দিয়েছিলেন মিশুক মুনীর।
সেই মিশুক মুনীরকে পেলাম এটিএন নিউজেই। মনটা ভরে গেলো। সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না থাকায় প্রায়ই যে পরোক্ষ খোঁচা হজম করতে হতো, তার অনেকটাই উপশম হয়েছিল মিশুক মুনীরের শিক্ষার্থী হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর । কিন্তু মাত্র নয় মাসের মাথায় একদিন আমাদের হাতেই ব্রেকিং নিউজ হয়েছিলেন মিশুক মুনীর। মন শক্ত করে বুকে পাথর বেঁধে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত প্রিয় মিশুক ভাইয়ের ক্ষতবিক্ষত মুখমণ্ডল দেখেছিলাম তাকে হাসপাতালের হিমশীতল ঘরে রেখে আসার সময়। এক এক করে তিন বছর কেটে যাচ্ছে। কিন্তু বারবার আমার টেবিলে থাকা তার ছবির কাছে প্রায়ই প্রশ্ন করি:“ মিশুক ভাই, আমরা কি ঠিক পথে হাঁটছি ? ”
আমি জানি মিষ্টি হাসির জবাব আর পাবো না। ঈদের আগে-পরে যখন শতাধিক মানুষের সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো নিয়ে শুক্লা সরকারের রিপোর্টে পাণ্ডুলিপি দেখি, আমার বুক তখন পান্ডুর রোগে আক্রান্ত হয়। কারণ সৃজনশীলতায় ব্রতী মিশুক মুনীর আর তারেক মাসুদ খানকেই তো সড়কেই বধ করেছিল যন্ত্রদানবরা, যার চালক ছিল খুনি মানবসন্তান। কিংবা যখন সরকারের করা সম্প্রচার নীতিমালার বিরুদ্ধে সোচ্চার হই লেখনীতে কিংবা টকশোতে তখন্ও তো আমি খুঁজে ফিরি মিশুক মুনীরের মোবাইল নাম্বার। কারণ মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেও এটিএন নিউজের ফ্রন্ট ডেস্কে ফোন করে মিশুক ভাই আমাকে খুঁজেছিলেন। অফিসে এসে সেই তথ্য পাওয়ার আগেই পেয়েছিলাম তার মৃত্যুসংবাদ। চোখের জল মুছতে মুছতেই লাল ব্রেকিং নিউজকে কালো করেছিলাম, অনেক সময় ধরেই সেই খবরটা চালাতে হয়েছিল বলে।
কিন্তু কোনটা ব্রেকিং আর কোনটা ব্রেকিং নয়, তার বিতর্ক শেষ হবে না। কিন্তু মাথার ওপর মিশুক মুনীর থাকলে তার সিদ্ধান্ত শিরোধার্য বলে নিশ্চিন্ত থাকতাম। কিংবা সম্প্রচার সাংবাদিকতায় যখন ব্যক্তির প্রভাব অনেক বেশি, ব্যক্তির আচরণ যখন সাংবাদিকতার পেশাদারিত্বকে অতিক্রম করে তখন অসহায় বোধ করি? আর মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করে, কেন চলে গেলেন মিশুক মুনীর! খুব মনে পড়ে ২০১১ সালের আগস্ট মাসে তার চলে যাবার আগের এপ্রিলে পহেলা বৈশাখের দিনটির কথা। একজন সহকর্মী তার কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনের বৈশাখী পালনের ভিডিও ফুটেজ এনে তা প্রচারের অনুরোধ করেছিল। আমি সামনেই পেয়েছিলাম মিশুক মুনীরকে, একবাক্যে ‘না’ করে দিয়েছিলেন। যাহোক, অনেকবার ঘ্যানঘ্যান করে মিশুক মুনীরকে রাজী করিয়েছিলাম। তাই এখন যখন টেলিভিশনগুলোতে ব্যক্তিপূজা, আর প্রভাবশালীদের অন্যায় সুযোগ নেওয়া দেখি তখন নিজেকে বড় বেশি অসহায় মনে হয়।
আর নিজের কর্মক্ষেত্রে যখন প্রযুক্তিগত পশ্চাদপদতায় সম্প্রচার সাংবাদিকতার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ি তখন মিশুক মুনীরের কথা বারবার মনে পড়ে। কারণ তিনি এটিএন নিউজে যোগ দিয়ে বলেছিলেন গায়ের জোরে কতদূর যাবা, যদি প্রযুক্তি তোমাকে না সাপোর্ট করে। এই প্রযুক্তির কারিশমা নিজেই দেখিয়েছিলেন। মিনি ডিভি ক্যাসেটের ক্যামেরাগুলোতে খুব সহজেই ডিজিটাল কার্ড ব্যবহার করতে শিখিয়েছিলেন। তার সুফল পেয়েছি আমরা। নিউজ চ্যানেল হিসেবে আমাদের বড় ওভি ভ্যান ছিল না, কিন্তু একবার যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে নিয়ে এসেছিলেন টেলিপোর্টার। সেই যন্ত্র ব্যবহার করে বঙ্গভবন থেকে মন্ত্রিসভায় রদবদল ও নতুন মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করতে পেরেছিলাম অনেক উত্তজনা নিয়ে। এখন যেখানে ঘটনা ঘটছে সেখান থেকেই সরাসরি সম্প্রচার করতে পারছে নিউজ চ্যানেলগুলো। তা পদ্মার বুকে লঞ্চ উদ্ধারের তৎপরতাই হোক বা হবিগঞ্জের জঙ্গল থেকে পরিত্যক্ত অস্ত্র উদ্ধারই হোক!
আর শুরুতেই যেমন উল্লেখ করেছি, এখনতো এই বিতর্কে জড়িয়েছি যে কোনটা সরাসরি সম্প্রচার হবে কোনটা হবে না ? এমনকি এই প্রশ্ন্ও উঠেছে যে, প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন বা কোনো অনুষ্ঠান একঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সরাসরি সম্প্রচার কি দর্শকরা গ্রহণ করবে? আর যখন এই মুহূর্তে ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে সরকারের জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা, তখন তো আরো বেশি করে মিশুক মুনীরের অভাব অনুভব করছি।
কোনো হা হুতাশ, কোনো ক্ষোভ বা হতাশা আর মিশুক মুনীরকে ফিরিয়ে দেবে না। তাই এবারও তার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা বলতেই পারি, মিশুক মুনীরের শিক্ষাই আমাদের পরম অস্ত্র। অল্পদিনে তার কাছে যা শিখেছি সম্প্রচার সাংবাদিকতায় সেই অস্ত্রই প্রয়োগ করতে চাই মাথা উঁচু করে, পেশাদারিত্বকে উর্ধ্বে তুলে ধরে। এর বিপরীতে যতই থাকুক সরকার কিংবা প্রভাবশালী কর্পোরেট-হুমকি অথবা কোনো ক্ষমতাবান ব্যক্তিত্বের মুঠোবন্দি আস্ফালন!
প্রণব সাহা: এডিটর আউটপুট, এটিএন নিউজ, [email protected]