ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

লোকটি আমাকে ভালোবেসেছিল!

জব্বার হোসেন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৪
লোকটি আমাকে ভালোবেসেছিল! সেলিম আল দীনের সঙ্গে জব্বার হোসেন

সেলিম আল দীনকে আকর্ষণ করবার মতো একটি যোগ্যতাও আমার ছিল না। কিন্তু কিভাবে যেন তাকে আমি প্রবল আকর্ষণ করেছিলাম।

এমন নয় যে সেরা ছাত্র ছিলাম, দুর্দান্ত মেধাবী ছিলাম, আমার চৌকষের আলোকছটা ঝলমল করত চারিদিক। বরং তার চারদিকে, চার-পাশে প্রতিভাবান, খ্যাতিমান, মেধাবী, জ্ঞানী-গুণীদের ছড়াছড়ি ছিল সবসময়। সবাই তার কাছে যেতে চাইত, সান্নিধ্য চাইত, একটা বলয় তাকে ঘিরে রাখত সবসময়।

আমিই ছিলাম বলয়ের বাইরে, অন্য অনেকের চেয়ে অনেক দূরে। তিনি দূর থেকেই আমাকে কাছে ডেকেছিলেন। ইশারায় বসতে বলেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন, কি নাম আমার? কোনো ডাকনাম আছে কি? তারপর কি মনে করে না মনে করে অনেকক্ষণ অপলক তাকিয়েছিলেন, অনেকক্ষণ!

অতটা কাছের ছিলাম না, যতটা কাছে নিয়ে এসেছিল আমাদের সাপ্তাহিক ২০০০। শাহাদত চৌধুরীর ২০০০। তখন ২০০০-এ কাজ করি। দেশের সবচাইতে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক তখন এটি। সেলিম আল দীন ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন শাহাদত চৌধুরীকে। শাহাদত চৌধুরীও ভালোবাসতেন সেলিম আল দীনকে। শাচৌ, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্ছু, সেলিম আল দীন- অনেক কাল আগের সম্পর্ক, বন্ধুত্ব।

সেলিম আল দীন দৈনিকে, সাপ্তাহিকে খুব কমই লিখতেন। সাপ্তাহিক ২০০০ এর ঈদ সংখ্যাটিতেই প্রথম লিখলেন দীর্ঘ লেখা। উপন্যাস লিখবার জন্য ভীষণ আবদার করেছিলাম। উপন্যাস লিখেন। কিছুতেই তিনি উপন্যাস লিখবেন না। উপন্যাসের ফর্মেই তিনি বিশ্বাস করেন না। দ্বৈতাদ্বৈতবাদ তত্ত্বের যিনি প্রবক্তা তিনি কিভাবে উপন্যাস লিখেন! উপন্যাস, নাটক, গল্প, কবিতা- সবই তো এক, কোনোটিই আবার এক নয়।

সেই  সেলিম আল দীন আমাকে  বিস্মিত করে একরাতে বললেন, উপন্যাস লিখছি ‘স্বর্ণবোয়াল’, অনেকদূর হয়েও গেছে। শুধু তোর জন্য লিখলাম। স্বর্ণবোয়াল আখ্যান বা উপন্যাসটি সময় প্রকাশনা থেকে বই আকারেও বেরিয়েছিল। ২০০০-এ দেবেন বলেই লিখেছিলেন ‘স্বপ্ন রমনীগণ’, ‘পুত্র’- এমন আরও অনেক রচনা, আত্মকথন ‘এইতো আমি’। সবই প্রকাশিত হয়েছিল ২০০০-এ।

অনেক স্মৃতির তলে চাপাপড়া আমি। নিমার্তা আফজাল হোসেনের অফিসে ধারাবাহিক নাটক লিখবার জন্য আমাদের কয়েকজনকে পাঠালেন। কয়েক পর্ব লিখবার পর ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। ‘নিমজ্জন’ এর প্রথম শো দেখতে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিশ্বসভ্যতা, গণত্যার ইতিহাস, বাংলাদেশ- সব এক নাটকে। বিশ্বশিল্পধারায় নিমজ্জনকে বলা হয় ফোররিয়েলিজমের প্রথম উদ্ভাবন। বলেছিলাম, আপনি মানুষ না দানব, মানুষ কি এমন নাটক লিখতে পারে? ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। হাসলেন, সেই শিশুর মতো হাসি!

আসলেই ‘নিমজ্জন’ ঐশরিক বা দানবিক শক্তি ছাড়া লেখা সম্ভব নয়। যারা নিমজ্জন দেখেছেন তারা জানেন। নিমজ্জন আমি ১৯ বার দেখেছি। শুধু ‘নিমজ্জন’ বলছি কেন, ‘হাতহদাই’, ‘চাকা’, ‘যৈবতী কন্যার মন’, ‘হরগজ’, - কোনোটি কি কোনোটিকে অতিক্রম করতে পারে কিংবা কোনটি কোনটিকে অতিক্রম করতে পারে না। শিল্পের ক্ষেত্রে তো তিনি দানব-ই। বাংলা নাটকের ইতিহাস যে হাজার বছরের পুরোনো সে তো সেলিম আল দীনেরই প্রথম প্রকাশ।

টুকরো স্মৃতি আরও অনেক। বুদবুদের মতো উঠে আসছে। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সাক্ষাৎকার নেব। সৈয়দ হক সবসময় ভাবেন, যারা তার সাক্ষাৎকার নিতে আসেন তারা কিছু জানেন না, অথবা না জেনে আসেন। অন্যকে মুর্খ, অল্পশিক্ষিত, অমেধাবী ভাবতে তিনি হয়তো ভালোবাসেন। আমি এই ধারণা ভাঙ্গতে চেয়েছিলাম।

সেলিম আল দীন প্রায় ১৫ দিন আমাকে রীতিমত ২/৩ ঘণ্টা করে পাঠ দিয়েছেন। সংস্কৃত নাটক থেকে ইউরোপিয়ান থিয়েটার, জোহান ভন গ্যাটে থেকে ইউজিন ওনিল। কাব্যকলা, নন্দনতত্ত্ব, মুক্তিযুদ্ধ, সমকালীন বাংলাদেশ । আমার সাথে কথোপকথণে সৈয়দ হক নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছিলেন। খুব খুশিও হয়েছিলেন। বলেছিলাম, এটি সেলিম আল দীনের  অবদান। তিনি খুব চেয়েছিলেন, আমি যেন ভালো ইন্টারভিউ নিতে পারি। শুধু ইন্টারভিউ কেন, ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি চাইতেন যেন আরও ভালো করি। আরও সফল হই।
কী এক প্রগাঢ়, গভীর ভালোবাসা বোধ করতেন আমার প্রতি।

জীবনে এমন গভীর ভালোবাসা খুব কম মানুষের কাছেই পেয়েছি। খুব কম মানুষই এমন ভালোবাসা পায়। বন্ধু পায়, শিক্ষক পায়, অভিভাবক পায়। আমার জীবন বদলে দিয়েছিলেন সেলিম আল দীন। চিন্তা, দর্শন, বোধ, জীবনের অর্থ, গভীরতা। বলতেন, মানুষ দেখতে হবে। মানুষ বুঝতে হবে। জগৎ আসলে অন্য কিছু নয়, মানুষই। কিন্তু এই মানুষটিকেই এত কাছে থেকে আমার বোঝা হয়নি, জানা হয়নি।

ঘরমুখো ছিলেন না, বহির্মুখী ছিলেন। গভীর অন্তর্মুখীও ছিলেন। হয়তো ব্যক্তিগত, পারিবারিক জীবনের উৎপীড়ন তাকে বহির্মুখী করেছিল। ঘর তাকে বেঁধে রাখলে হয়তো তিনি এত বড় মানুষও হতে পারতেন না। গার্হস্থ্য জীবন তো মানুষকে সীমাবদ্ধ, সংকীর্ণ, স্বার্থপরই করে তোলে। সে মানুষতো তিনি কখনোই ছিলেন না। স্ত্রী বেগমজাদী মেহেরুন্নেসার প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে জীবনের শেষ সময়ে এসে লিখেছিলেন ‘ভাঙ্গা প্রেম অশেষ বিশেষ’ আত্মজৈবনিক রচনা।

সম্পর্ক কি শুধুই সম্পর্ক? প্রেম কি ব্যক্তি প্রেম, নাকি আরও অন্য উচ্চাতায় পৌঁছে যায় সম্পর্কের গভীরতায়। মানুষ-প্রকৃতি-প্রেম-কাম-জীবন-জগৎ সব মিলেমিশে একাকার। এই প্রেম শেষ পর্যন্ত খুব ক্লিষে প্রেম ধারণার মধ্যে থাকেনি, দর্শন হয়ে উঠেছে। কাম হচ্ছে একটি তাৎক্ষনিক উত্তেজনা ও ঝড়, প্রেম নিরত্তর’- কথাটি আমার প্রায়ই মনে পড়ে। আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি যখন বইটি প্রকাশিত হয়, উৎসর্গপত্রে আমারই নাম লেখা- ‘পুত্র প্রতিম জব্বার হোসেনকে’। তবে কি তিনি মৃতপুত্রের প্রাপ্তআদল দেখেছিলেন আমার মুখে? বেঁচে থাকলে আমার, আমাদেরই বয়সী হতো একথাও তো লিখেছিলেন ভেতরে। আমার ভেতরে তোলপাড়। সারা অস্তিত্ব যেন অবশ হয়ে আসে। আর্তনাদ করতে ইচ্ছে করে। তবে কি আমিই তার সেই মৃত পুত্র!

হায়! কিছুই তো জানতে চাওয়া হয়নি। কিছুই জানা হয়নি আমার, বোঝা হয়নি। শুধু ভালোবাসা ছাড়া।
লোকটি আমাকে ভালোবেসেছিল!!

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক কাগজ ও মিডিয়াওয়াচ, [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৯০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৭, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।