পর্ব ২
তিনি যে বামপন্থী মতাদর্শী এবং এর স্বপক্ষে নানা আন্দোলন করে যাচ্ছেন, এটা একেবারেই পছন্দ হয়নি তাঁর জমিদার পিতার। ছেলে বখে গিয়েছে এই চিন্তা থেকে তিনি তাঁকে বাড়ি থেকে বিতাড়ন করেন।
১৯৪৬ সালে আসামে গণনাট্য সংঘ গঠিত হয়। তিনি এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পর-পর তিনবার ওই পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। ভারত ভাগের গণনাট্য সংঘের এবং কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরাও বিভাজিত হয়ে যায়। এই সময় তিনি লেখেন তাঁর বিখ্যাত ব্যাঙ্গাত্মক গান–মাউন্ট ব্যাটন মঙ্গলকাব্য— এই গান দেশজুড়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিল তখন।
১৯৪৮ সালে তেলেঙ্গানা ও তেভাগা কৃষক বিদ্রোহ দমনে স্বাধীন ভারতে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়। হাজার হাজার কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন-পীড়ন এবং গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৫১ সালে হেমাঙ্গ বিশ্বাস গ্রেপ্তার হন। কিন্তু, এবারও অসুস্থতার কারণে ছাড়া পেয়ে যান তিনি। ১৯৫৭ সালে চিকিৎসার জন্য তাঁকে চীনে পাঠায় কমুনিস্ট পার্টি। চীনে তিন বছর ছিলেন তিনি। এই তিন বছরে চীনা ভাষাটা শিখে ফেলেন তিনি।
চীন থেকে ফিরে আসার পর ১৯৫৯ সালে রাণু দত্তকে বিয়ে করেন। এরপর আরো কয়েকবার তিনি চীনে গিয়েছেন। কমরেড মুজাফ্ফর আহ্মদের সুপারিশে কলকাতার সোভিয়েত কনস্যুলেটে ১৯৬১ সালে চাকরি হয় তাঁর। কিন্তু, বেশিদিন এই চাকরিটাকে টিকিয়ে রাখতে পারেননি তিনি। চীন-সোভিয়েত মতাদর্শগত বিভাজনে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনও তখন চরমভাবে বিভক্ত। যার বিরূপ প্রভাব এই উপমহাদেশেও পড়েছিল। চীনের প্রতি তাঁর অতি আকর্ষণ এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে সোভিয়েত পার্টির সমালোচনার কারণে ১৯৭৪ সালে সোভিয়েত কনস্যুলেটের চাকরি ত্যাগ করতে হয় তাঁকে।
![h_3_1 h_3_1](files/September_2014/September_10/h_3_1_698119967.jpg)
১৯৬৯ সালে নকশাল বাড়ি আন্দোলনের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন দেন তিনি। এই আন্দোলনও সফল হয়নি। যদিও এই আন্দোলন প্রচার হতে থাকে জোরেসোরেই। ১৯৭১ সালে হেমাঙ্গ বিশ্বাস গঠন করেন ‘মাস সিঙ্গার’ নামে গানের এক দল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই দল নিয়েই তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন দেশ-বিদেশ। এই অনন্য সাধারণ মানুষটি, এই অসাধারণ গণসঙ্গীত শিল্পীটি মারা যান সাতাশি সালে।
সঙ্গীত পরিবেশনের ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তা সবসময়ই কেন্দ্রীভূত থেকেছে সংগ্রামী জনতার প্রতি। এদেরকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে তাঁর সাঙ্গীতিক জগত। তাঁর সৃষ্টিশীলতা তাই কখনও অন্যদিকে বাঁক নেয় নি। চল্লিশের দশকে ‘কাস্তেটারে দিয়ো জোরে শান’-এ যাঁর সঙ্গীত জীবন শুরু, তেভাগা সংগ্রামের পথ বেয়ে তেলেঙ্গানার পথে ‘মাউন্টব্যাটন মঙ্গলকাব্যে’ তার সঙ্গীত জীবনের সফল পরিণতি।
পঞ্চাশের দশকে তাঁর গানে যেমন দেশবিভাগের যন্ত্রণা অনুভব করা যায়, ঠিক তেমনই সংগ্রামের কঠিন শপথে উদ্দীপিত হয়ে ওঠা যায়। পঞ্চাশ দশকের শেষভাগে তিনি দীর্ঘদিন চীন দেশে কাটিয়ে এসেছেন। গীতিকার হিসেবে তাঁর ওপর এর প্রভাব ছিল অপরিসীম।
ষাটের দশকে কল্লোল, তীর, লাল লণ্ঠন এরকম কিছু বিপ্লবী নাটকে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে আমরা তাঁকে নতুনভাবে পাই। লাল লণ্ঠন নাটকের সঙ্গীতে বিভিন্ন চীনা সুর ব্যবহার করেন তিনি। এটা তাঁর শিল্পী জীবনের এক উজ্জ্বল বিবর্তন। গান নিয়ে নানা পরীক্ষা-নীরিক্ষায় মেতে উঠেন তিনি এই সময়টাতেই। এই সময় তাঁর পরীক্ষা নিরীক্ষার একটি অসাধারণ ফসল হলো ‘শঙ্খচিলের গান’।
সত্তর দশকে আমরা তাঁকে পাই আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণী ও প্রগতিশীল মানুষের বিশ্ববিখ্যাত সংগ্রামী গানের সুর অক্ষুণ্ণ রেখে বাংলার সার্থক অনুবাদকরূপে। মূল চীনা ভাষা থেকে বাংলা ও অসমীয়া ভাষায় সঙ্গীত রূপান্তরের তিনিই সম্ভবত পথিকৃৎ।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর গানগুলোর কোনোটি নিজে রচনা ও সুরারোপ করেছিলেন, কোনোটি সংগ্রহ করেছিলেন লোকসঙ্গীতের ভাণ্ডার থেকে, কোনোটি কিছুটা পাল্টে নিয়ে চলতি লড়াই-এর সঙ্গে যুক্ত করেন।
লেখক : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক। মুক্তমনার প্রাক্তন মডারেটর
বাংলাদেশ সময়: ১২৫০ ঘণ্টা, সেপ্টম্বর ১০, ২০১৪