ঢাকা, সোমবার, ২২ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ মে ২০২৪, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

আইসিস: কোন পরিকল্পনার অংশ ।। জিয়া হাসান

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৪
আইসিস: কোন পরিকল্পনার অংশ ।। জিয়া হাসান ছবি: সংগৃহীত

মাঝে মাঝে, আমেরিকার ভাগ্য দেখে অবাক হতে হয়। সাম্প্রতিক কালে, মধ্যেপ্রাচ্যে আইসিসের উত্থানের মাধ্যমে, আমেরিকা এমন এক শত্রু আবিষ্কার করেছে যাকে তাদের অবস্থান থেকে আদর্শ শত্রু বলা যায়।

একটা ভালো শত্রু হতে হলে যা যা গুণাবলি লাগে, মার্কিন অবস্থান থেকে দেখলে আইসিসের মধ্যে তার সবগুলোই আছে।

একটা শত্রু, যার আমেরিকার বুকে আঘাত করার কোনো সক্ষমতা নাই, কিন্তু ঠিকই হোম গ্রউন টেররিস্টের ভীতি সৃষ্টি করে দেশের পলিটিক্সে এন্টি ইসলামিক গেম খেলা যাবে। একটা শত্রু যার ভিনধর্মীদের উপরে আক্রমণ এবং গলা কাটার ভিডিওগুলো দেখিয়ে, মধ্যেপ্রাচ্যে আরো একটা আগ্রাসন এবং আক্রমণ করার যুক্তি দেয়া যায়। এই শত্রুটির কার্যক্রম এত নৃশংস যে, বিশ্ব জনমতের একটা বড় অংশ মার্কিন আক্রমণের পক্ষে থাকে, যেখানে আমেরিকার ওয়ার অন টেররের নামে, প্রথম আক্রমণে আমেরিকাকে তাদের স্যাটেলাইট, মিডিয়া, আর্থিক ক্ষমতা হইতে শুরু  করে দস্তা দস্তা কাগজ ব্যবহার করে প্রমাণ করতে হইছে, ইরাকে জনবিধ্বংসী অস্ত্র আছে, যা তারা শেষ পর্যন্ত খুঁজে পায় নাই—(কারণ সেইটা কখনো ছিলনা) ফলে আমেরিকা মিথ্যুক এবং প্রতারক সাম্রাজ্যবাদী হিসেবে চিহ্নিত হইছে। কিন্তু আমেরিকার বিরুদ্ধে এভাবে চিহ্নিতকরণের বিপদ এবার আইসিসের কারণে হয় নাই।

পুরো ইউরোপ এবং আমেরিকাতে যে ইসলাম এবং মুসলিম বিদ্বেষ রয়েছে তা ন্যায়সঙ্গত করার জন্যে নিয়মিত বিরতিতে যথেষ্ট পরিমাণ কল্লাকাটার ভিডিও তৈরি করছে এই শত্রুরা। এটা হল এমন এক শত্রু—মধ্যেপ্রাচ্যের কাতার, সউদি আরব ও কুয়েতের মতো আমেরিকার এসব বন্ধুদেশে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অস্ত্র কেনার জন্যে এবং তাদের ভেতরে মার্কিন সেনা ক্যাম্প রাখার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ ভয়ভীতি জারি করে রাখা যায়। মানে আইসিসের মতো শত্রু তৈরি করার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিতিশিলতা সৃষ্টি করে বিপি, শেল, কনকোফিলিপ্সসহ বিভিন্ন মার্কিন এবং ইউরোপিয়ান তেল কোম্পানির জন্যে তেলের দাম অনায়াসে এমন একটা পর্যায়ে রাখা যায়, যাতে তাদের ভালো মুনাফা ধরে রাখা যায়। আবার এই দাম এমন একটা পর্যায়েও যেন চলে না যায়, যাতে পশ্চিমা বিশ্বের ঘরোয়া অর্থনীতি ক্ষতির মুখে পড়ে।

যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষ ইসলামি চিন্তাবিদেরা পরিষ্কারভাবে বলেছেন, আইসিসের কার্যক্রমের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নাই, তবু আইসিসকে ইসলামের সাথে গুলিয়ে, ইউরোপ এবং আমেরিকার জনগণের মধ্যে ইসলাম বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলা হচ্ছে। অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় আক্রমণ চালিয়ে নিরীহ শিশু, নারী এবং পুরুষ হত্যা করার পেছনে ইজরাইলের জঘন্য যুক্তি হল, এই নিষ্পাপ শিশুরাও একদিন আইসিসের মত সন্ত্রাসী হয়ে উঠবে। তাই এদেরকে ঘরের মধ্যে মেরে ফেলাতে দোষের কিছু নাই। প্রাশ্চাত্য মানসে তাদের এই বেআইনি অবস্থানের ন্যায্যতার জন্য আইসিসের মতো শত্রু বানিয়ে এই যুক্তির প্রচারণা চালানো হয়।   

অবাক হওয়ার কিছু নাই, অনেকগুলো মানুষকে একসাথে গুলি করার আইসিসের যে ভিডিওটি প্রথম ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয় সেই ভিডিওটা আবিষ্কার করেছিল একজন ইজরাইলি গোয়েন্দা। আজকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে, মুসলমান শিয়া সুন্নি, বা কুর্দিদের নিজেদের মধ্যে, এইভাবে হানাহানি, খুনাখুনি, মারামারি করতে দেখে অবাক হতে হয়। অথচ একই অঞ্চলে এই গোষ্ঠীগুলো হাজার হাজার বছর সম্প্রীতি সহকারে বসবাস করে এসেছে। তাহলে এই সম্প্রীতি এত দীর্ঘকাল ধরে কিভাবে সম্ভব হয়েছিল। (কিছু ঘটনা বাদে এই উদাহরণ বিশ্বের সকল এলাকায় পাওয়া যাবে)।

এর কারণ খুঁজতে হলে, আমরা আমাদের ঔপনিবেশিক ইতিহাসের দিকে তাকাতে পারি। এই একই তত্ত্ব ব্যবহার করে, লক্ষ মাইল দূর থেকে এসে ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করে গেছে ব্রিটেন। এই তত্ত্বের নাম হল ডিভাইড এন্ড রুল (বিভাজন তৈরি করে শাসন করো)। সেই ডিভাইড এন্ড রুলের মূলনীতি অনুসরণ করে আজকে মধ্যে প্রাচ্যের খেলা অনেক জটিল সমীকরণে পৌঁছেছে।

এই জটিল সমীকরণের গভীর হিসেবের মাধ্যেমে এই জনগোষ্ঠীকে ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিতে কোটি কোটি ডলার ঢালা হয়েছে। এটা কোনো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নয়। এটি আমেরিকা, ইজরাইল এবং তার বন্ধুদের কাছে স্ট্র্যাটেজি এবং ইন্টেলিজেন্স অপারেশান। ইজরাইল, আমেরিকা এবং তাদের বন্ধুদের কোটি কোটি ডলারের ইন্টেলিজেন্স ইন্ডাস্ট্রি আছে—যেখানে বিগত ১০ বছরে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের পরে যখন এই অপারেশনের কার্যক্রম তাদের দেশের জনগণের কাছেই প্রশ্নের মুখে, তখন এই ডিফেন্স এবং ইন্টেলিজেন্স ইন্ডাস্ট্রিকে তার নিজের অস্তিত্বের জন্যেই যুদ্ধ সৃষ্টি করতে হয় এবং শত্রু সৃষ্টি করতে হয়। ওয়ার অন টেরর এই ইন্ডাস্ট্রিরই সৃষ্টি। আল কায়েদা, তালেবান সবাই এক সময়ে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট ছিল।

ধর্মের পার্থক্য থাকলেও, মধ্যেপ্রাচ্যে সবাই আরব এবং আরবদের মধ্যে আরব জাতীয়তাবাদের একটা সেতুবন্ধন রয়েছে যার কারণে, এই জনগোষ্ঠী তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য বিরোধ বাদে ভাই ভাইয়ের মত শান্তিপূর্ণভাবে হাজার হাজার বছর ধরে বসবাস করেছে। সেই সম্প্রীতিকে ভেঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে ভাত্রিঘাতী যুদ্ধ সৃষ্টি করা মার্কিন এবং ইউরোপিয়ান ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রির জীবনরক্ষাকারী একটা কাজ।

এই ইন্টেলিজেন্স অপারেটররা অত্যন্ত সফিস্টিকেটেড প্রজুক্তি, ডাটা এবং আরটিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে কাজ করে। তারা ১০ বছর আগে দেখতে পায় কোন কার্যক্রমের কি রেজাল্ট হতে পারে। তাই এই বাহিনী এমনভাবে কাজ করে, যাতে শুধু আজকের নয় আগামীর জন্যে শত্রু সৃষ্টি হয়—বিভেদ ও ভাত্রিঘাতী যুদ্ধ সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি এবং বিনাশ এই উভয় প্রক্রিয়াতেই এরা তাদের উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা বজায় রাখতে পারে।

এই ইন্টেলিজেন্স অপারেশান একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যা মার্কিন এবং ইউরোপিয়ান সমরনীতিতে তাদের পক্ষ থেকে যুদ্ধের একটা নৈতিক অবস্থান সৃষ্টি করে। তারা কোটি কোটি ডলার খরচ করে। এতে মানুষ খুন এবং যুদ্ধ করার যৌক্তিকতা সৃষ্টি করে।  

এই নৈতিক অবস্থান তৈরির প্রয়োজন এখন আরো বেড়েছে। কারণ, বিগত ২০ বছরে নতুন একটা প্রজন্মের জন্ম নিয়েছে, যারা ইন্টারনেটের কারণে আগের থেকে অনেক বেশি কানেক্টেড এবং যারা নিজেকে একটা গ্লোবাল বিশ্বের প্রতিনিধি মনে করে। যারা অনেক বেশি লিবারেল, ধর্মীয়ভাবে সহনশীল এবং পরমত সহিষ্ণু। এরা সিএনএন বা বিবিসি এইসব নিউজ মিডিয়ার উপরে নির্ভরশীল না। কারণ, এরা নিজেরাই সামাজিক মাধ্যমে নিউজ তৈরি কর এবং সেই নিউজকে ফিল্টার করে নিজেদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। এই প্রজন্মকে যে কোনো নিউজ খাওয়ানো বা তাদের মধ্যে যুদ্ধের যৌক্তিকতা সৃষ্টি করা এত সহজ নয়। এদেরকে ইরাক যুদ্ধের মত একটা অনৈতিক যুদ্ধ গেলানো অনেক কঠিন। তাই, ইজরাইল যখন প্যালেস্টাইনে আক্রমণ করে নারী ও শিশুদের হত্যা করে সমালোচনার মুখে পড়ে ঠিক তখনই, আইসিসের ভিডিওগুলোর উত্থান হয়। আইসিস হজরত ইউনুসের মাজার ধ্বংস করে, খ্রিষ্টানদেরকে ধর্মান্তরিত  করে, কল্লা কেটে শিয়াদেরকে হত্যা করে, ইয়াজদিদেরকে গৃহচ্যুত করে। এসব আবার তারা ভিডিও করে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ছেড়ে দেয়।

আজকে আমেরিকার এই সৌভাগ্য দেখে অবাক হইতে হয়। কিন্তু, একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, এইটা সৌভাগ্য নয়। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে
আইসিসের মতো কৃত্রিম আদর্শ শত্রু তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। এই শত্রুর মাধ্যমে আমেরিকা তার ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখে তাদের কোটি কোটি ডলার অস্ত্র বেচার মাধ্যমে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

বাংলাদেশ সময়: ১২০৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।