ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ফারুক ভাইয়ের সহকর্মী ছিলাম ।। টোকন ঠাকুর

শ্রদ্ধাঞ্জলি/মুক্তমত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০১৪
ফারুক ভাইয়ের সহকর্মী ছিলাম ।। টোকন ঠাকুর

সেদিন, সম্পাদক গোলাম ফারুকের টেবিলে মুখোমুখি বসে ছিলেন রাজনীতিবিদ গোলাম ফারুক অভি। এককালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাইটের ছাত্রনেতা।

পরবর্তীতে, গোলাম ফারুক অভি এমপি হলেন কিন্তু টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের মডেল তিন্নি হত্যা মামলায় তিনি তখন অভিযুক্ত এবং তিন্নিকে নিয়ে সম্পাদক গোলাম ফারুক সম্পাদিত বিনোদন পাক্ষিক 'অানন্দ ভুবন' সে-সময় কভার স্টোরি করায় সেখানে গোলাম ফারুক অভির নাম-ধাম চলে আসে। সম্ভবত সে কারণেই গোলাম ফারুক অভি এসেছেন তখনকার বিনোদন জগতের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন 'আনন্দ ভুবন'-এর সম্পাদকের সঙ্গে হয়তো মীমাংসা করতে। সম্পাদক ফারুক ভাই-ই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, বলে-কয়ে 'সন্ত্রাসকে শিল্পে উত্তীর্ণ' করতে চাওয়া রাজনীতিবিদ অভির সঙ্গে। হাসতে হাসতেই বললেন, 'দ্যাখেন আমাকে তুলে নিয়ে যেতে এসেছেন উনি। ' ফারুক ভাইয়ের শ্লেষ-উচ্চারণে অভির মুখেও হাসি দেখা গেল।

অামি জানি, সম্পাদক গোলাম ফারুকের মুখের হাসিটি এ মুহূর্তে মনে করতে পারবেন পরিবার-পরিজন-বন্ধু-সহকর্মী-পরিচিতরা। এটা কষ্টের, বেদনার যে, ফারুক ভাইয়ের সেই হাসিটি অামরা অার দেখব না। ফারুক ভাই নেই। চলে গেছেন। অার অাসবেন না। পৃথিবী চলতে থাকবে, গণমাধ্যম অারো বিকশিত হবে—সাংবাদিকতা অারো বিস্তৃত-পরিশীলিত-সাহসী হবে—কিন্তু ফারুক ভাই জীবিতদের গোত্র থেকে গোত্রান্তরিত হলেন, মাত্র পঞ্চাশের কাছাকাছি পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই। এটা কোনোভাবেই একজন সচল মানুষের চলে যাবার সময় নয়।

সর্বশেষ পেশাগতভাবে গোলাম ফারুক ছিলেন 'বণিক বার্তা'র ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। দেখেছি, এই কাগজটির সঙ্গেও তিনি খুব মিশে গিয়েছিলেন তাঁর কর্মজীবনে অপরাপর কাগজগুলোর মতোই। মাঝেমধ্যে ফারুক ভাই অামাকে দিয়ে নানান কিছু লেখাতেন। কাকে দিয়ে কী হবে, কী লেখানো যাবে বা সম্পাদনা করানো যাবে— তা তিনি খুব দক্ষভাবেই বুঝতেন এবং করাতেন। তাঁর কর্মীদলের অামিও একজন ছিলাম বলেই ভালোভাবে জানতাম ফারুক ভাইয়ের ভেতরের এই গুণটা। খুব বন্ধুর মতোই সাহচার্য পাওয়া যেত ফারুক ভাইয়ের কাছে। এটা সহকর্মী সব্বাই স্বীকার করবেন যে, এই মানুষটা কাজ করিয়ে নিতেন কেমন বন্ধুর মতো করে। ফারুক ভাইয়ের এই মৃত্যু মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে ছলকে উঠছে শুধু ব্যক্তিগত স্মৃতির ফোয়ারা। কত স্মৃতি-অানন্দ-বেদনা-মন খারাপ করা স্মৃতি, অাবার কত অানন্দময় স্মৃতি ঝেপে অাসছে হঠাৎ প্রয়াত ফারুক ভাইকে ঘিরে।

এবিসি রেডিওতে ছিলেন ফারুক ভাই। একদল তরুণ কর্মীকে সেখানেও কী উন্মাদনা গোলাম ফারুকের। যখন যেখানে কাজে থেকেছেন তিনি, একাত্ম হয়েই থেকেছেন। কাছে থেকে এই তো দেখলাম। কত শিখলাম ফারুক ভাইয়ের কাছে। সমকাল এর ফিচার এডিটর যখন তিনি, তখনও অামরা বেশ কিছু বন্ধু তাঁর সহকর্মী হলাম। কী স্বপ্নময় দিন অামাদের। পত্রিকায় ফারুক ভাই অামাদের দলনেতা হয়েও ব্যাপক প্রশ্রয় দিতেন। সেই প্রশ্রয় থেকেই ভিন্নধর্মী লেখা, মেকাপ-গেটাপে নিত্যনতুন ক্যারিকেচার করতাম। ভালো লাগত। অফিসের বাইরেই গোলাম ফারুককে অামার বা অামার মতো অনেকের মনে থেকে যাবে বেশিই হয়তো বা।

ফারুক ভাই একসময় ছিলেন ভোরের কাগজে, প্রয়াত শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরীর সঙ্গে। তবে কর্মজীবনে ফারুক ভাইয়ের সোনালী অধ্যায় হয়তো বা হয়ে থাকবে 'অানন্দ ভুবন'এর দিনগুলি। সেখানে, ফারুক ভাই-ই ছিলেন সম্পাদক। লিজেন্ডারি সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরীর 'অানন্দ বিচিত্রা'কে টপকে 'অানন্দ ভুবন'ই তখন এক নস্বর বিনোদন ম্যাগাজিন। প্রত্যেকটা ইস্যুই যেন এক-একটা বিস্ফোরণ হয়ে প্রকাশিত হচ্ছিল। অামাদের মনে থাকবে সে সব।

একবার, অামি অার ফারুক ভাই সিলেটে গিয়েছিলাম শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের উদ্দেশে, বক্তৃতা করতে। গত কয়েকবছর নিয়মিত দেখা হতো না। হঠাৎ কোথাও দেখা হলেই কত কী পরিকল্পনার কথা বলতেন ফারুক ভাই। সেই পরিকল্পনায় অামার কী কাজ থাকবে, তাও বলতেন। স্বপ্নবান মানুষ গোলাম ফারুক। মন দিয়ে কাজ করা ব্যাপারটা পছন্দ করতেন। মাঝেমধ্যে ফাঁকি দিয়ে পরে ধরা পড়ে লজ্জাও পেতাম। ফারুক ভাই বন্ধুজন হয়ে থাকতেন। রাগ করতে দেখছি কখনো, রাগ পুষে রাখার স্বভাব তাঁর ছিল না।

সঞ্জীব চৌধুরী মারা যাওয়ার পর সঞ্জীব দাকে নিয়ে ফারুক ভাই অামাকে দিয়ে বেশ কয়েকটা লেখা লিখিয়ে নিলেন, সে সব কাগজে ছাপা হলো। সঞ্জীব দা-ফারুক ভাই ছিলেন জল-সমুদ্রের নাবিক। তাঁরা পৃথিবীর জল-বাস্তবতার সঙ্গে খুব একাত্ম ছিলেন, দেখেছি, তাঁদের তরীতে উঠেছি কখনো। জীবনে অামরা জড়িয়ে ছিলাম। ফারুক ভাই হঠাৎ চলে গেলেন, এই যাওয়া ঠিক হলো, এ-সময়, ফারুক ভাই? অাপনি তো সবসময় অাশাবাদী মানুষ ছিলেন, তাই তো জানি। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক অাপনাকে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল!

কবে শেষ দেখা হলো অাপনার সঙ্গে, ফারুক ভাই? আপনারই বন্ধু-শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরীর জন্মদিনে, রেডিও স্বাধীন থেকে রাব্বি অায়োজন করল দুই ঘণ্টার অনুষ্টান 'নিঃস্ব রাতের সঞ্জীব'। অনুষ্ঠানে ফারুক ভাই, অামি ও বাপ্পা মজুমদার অাড্ডাবাজি করলাম সঞ্জীব দাকে নিয়ে। বাপ্পা গান করল কয়েকটা। অাদিত্যও যোগ দিল শেষে। কত কথা হলো সেদিন। অাপনার গাড়িতে অামাকে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। অামার ছবিতে অভিনয় করবেন, কথা হলো। কিন্তু সব কিছু ফেলে এই প্রস্থান, মন খারাপ করে দিলেন ফারুক ভাই। অাপনার ওপর রাগারাগি করতে ইচ্ছে করছে।   শায়লা ভাবি ও অাপনার মেয়ে অরিত্রী, ওরা কীভাবে থাকবে অাপনার এরকম চলে যাওয়ার পর?

ময়মনসিংহ থেকে অাপনার লাশ অানা হলো জাতীয় প্রেস ক্লাব চত্বরে। তারপর ফের ফিরে যাওয়া, ময়মনসিংহেই, ফুলবাড়িয়ায়। পঞ্চাশ বছর কী এমন মানব বয়স!

ফারুক ভাইয়ের লাশ ময়মনসিংহের উদ্দেশে নিয়ে যাওয়ার পর, যেহেতু ছিল ঈদের দিন, ঢাকার রাস্তা বড্ড ফাঁকা-ফাঁকা, হু হু করে উঠল মন। এই শহর তো গোলাম ফারুকেরই জীবন-যৌবন পার করা শহর। ফারুক ভাইকে এ শহর ছেড়ে কোথায় নিয়ে যাওয়া হলো? অার কোনোদিনই দেখা হবে না? জন্মদিন ছিল ফারুক ভাইয়ের, মৃত্যু দিনে।

ফারুক ভাই, চলে গেলেন?

টোকন ঠাকুর : কবি, চলচ্চিত্র নির্মাতা

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।