ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

একজন সাদাসিধে মা

মুহম্মদ জাফর ইকবাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৪
একজন সাদাসিধে মা মুহম্মদ জাফর ইকবাল

১.
আমার মা সেপ্টেম্বরের ২৭ তারিখ খুব ভোরবেলা মারা গেছেন। আমার বাবা যখন মারা গেছেন তখন তার কাছে কোনো আপনজন ছিল না।

একটা নদীর তীরে জেটিতে দাঁড় করিয়ে পাকিস্তান মিলিটারি গুলি করে তাকে হত্যা করে দেহটা নদীতে ফেলে দিয়েছিল। আমার মা যখন মারা যান তখন তার সব আপনজন, ছেলেমেয়ে, ভাইবোন ও নাতি-নাতনিরা সবাই পাশে ছিল। আমার বাবা যখন মারা যান তখন আমার মায়ের বয়স মাত্র ৪১। তারপর আমার মা তার সন্তানদের ও আপনজনের জন্য আরো ৪৩ বছর বেঁচেছিলেন।

আমার মায়ের মৃত্যু একান্তভাবেই একটি পারিবারিক ঘটনা হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেছি তার অসুস্থতার খবরটিও পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশনে প্রচারিত হয়েছে। তার মৃত্যুর খবরটি সব পত্রপত্রিকায় খুব গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে।

যদি খবরের শিরোনাম হতো, ‘হুমায়ূন আহমদের মায়ের জীবনাবসান’ আমি সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবে ধরে নিতাম। কিন্তু আমি খুব অবাক হয়েছি যখন দেখেছি আমার মাকে তার নিজের নাম-পরিচয় দিয়ে লিখেছে, ‘আয়েশা ফয়েজের জীবনাবসান’। আমি জানতাম না এ দেশের মানুষ আমার মাকে তার নিজের নামে চেনে। সে জন্য আমি আজকে এ লেখাটি লিখতে বসেছি- মনে হয়েছে যদি সত্যিই দেশের মানুষ তাকে তার পরিচয় দিয়েই চেনে, তাহলে হয়তো অনেকেই আমার একেবারে সাদাসিধে মায়ের জীবনের একটি-দুটি ঘটনা শুনতে আপত্তি করবেন না।

মাঝেমধ্যেই আমাকে কেউ একজন জিজ্ঞেস করেন, আপনি আমেরিকার এত সুন্দর জীবন ছেড়ে দেশে কেন চলে এলেন? নানাভাবে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে এখন হাল ছেড়ে দিয়েছি। নিজের দেশে ফিরে আসতে যে কোনো কারণ লাগে না বরং উল্টোটাই সত্যি দেশত্যাগী হওয়ার পেছনে ভালো কারণ থাকা দরকার, সেটা কাকে বোঝাব? প্রায় ৪০ বছর আগে আমি যখন আমেরিকা গিয়েছিলাম তখন ই-মেইল ইন্টারনেট আবিষ্কার হয়নি, ডজন হিসেবে টিভি চ্যানেল ছিল না, টেলিফোন অনেক মূল্যবান বিষয় ছিল, মায়ের ফোন ছিল না, থাকলেও আমার তাকে নিয়মিত ফোন করার সামর্থ্য ছিল না। যোগাযোগ ছিল চিঠিতে। চিঠি লিখলে সেটা দেশে আসতে লাগত ১০ দিন, উত্তর আসতে লাগত আরো ১০ দিন। মেইল বক্সে দেশ থেকে আসা একটা চিঠি যে কী অবিশ্বাস্য আনন্দের বিষয় ছিল, সেটা এখন কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।

সেই সময় আমার মা আমাকে প্রতি সপ্তাহে চিঠি লিখতেন। আমি জানি এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে আমি আমার ১৮ বছরের প্রবাস জীবনে প্রতি সপ্তাহে আমার মায়ের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছি। আমার মা তার গুটি গুটি হাতের লেখায় প্রতি সপ্তাহে আমাকে বাসার খবর দিয়েছেন, ভাইবোনদের খবর দিয়েছেন, আত্মীয়-স্বজনদের খবর দিয়েছেন- এমনকি দেশের খবরও দিয়েছেন। আমার প্রবাস জীবনে দেশ কখনো আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারেনি শুধু আমার মায়ের চিঠির কারণে।

কয়েক বছর পর বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদও পিএইচডি করতে আমেরিকা এসেছিলেন, তখন আমার মা প্রতি সপ্তাহে দুটি চিঠি লিখতেন একটি আমাকে, আরেকটি আমার ভাইকে।

আমার মায়ের লেখা সেই চিঠিগুলো বাঁচিয়ে রাখিনি, এখন চিন্তা করে খুব দুঃখ হয়। যদি চিঠিগুলো থাকত, তাহলে সেটি কী একটা অসাধারণ দলিল হতো আমি সেটি চিন্তাও করতে পারি না।

আমার মা খুবই সাধারণ একজন সাদাসিধে মহিলা ছিলেন- অন্তত আমরা সবাই তাই জানতাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যখন আমাদের থাকার জায়গা নেই, ঘুমানোর বিছানা নেই, পরনের কাপড় নেই, তখন হঠাৎ করে আমরা সবাই আমার মায়ের একটা সংগ্রামী নতুন রূপ আবিষ্কার করলাম। আমরা ভাই-বোনেরা সবাই লেখাপড়া করছি, কিছুতেই লেখাপড়া বন্ধ করা যাবে না, তাই বাবার গ্রুপ ইনস্যুরেন্স আর পেনশনের অল্প কিছু টাকার ওপর ভরসা করে ঢাকায় স্থায়ী হলেন। কী ভয়ংকর সেই সময়, এখন চিন্তা করলেও আমার ভয় হয়। বাড়তি কিছু টাকা উপার্জনের জন্য আমার মা একটা সেলাই মেশিন জোগাড় করে কাপড় সেলাই পর্যন্ত করেছেন।

আমি পত্রিকায় কার্টুন আঁকি, গোপনে প্রাইভেট টিউশনি করি। এভাবে কোনোমতে টিকে আছি। বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ পাস করে একটা চাকরি পাবে, সবাই সেই আশায় আছি। এ রকম সময় আমি একদিন হঠাৎ করে বলাকা সিনেমা হলের নিচে একটা বইয়ের দোকানে পুরো মানিক গ্রন্থাবলি আবিষ্কার করলাম। পূর্ণেন্দু পত্রীর আঁকা অপূর্ব প্রচ্ছদ, পুরো সেটের দাম ৩০০ টাকা! (এখনকার টাকায় সেটি নিশ্চয়ই ১০-১২ হাজার টাকায় সমান হবে)! এত টাকা আমি তখনো একসঙ্গে হয়তো ছুঁয়েও দেখিনি। এই বইয়ের সেট আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবু আমি বইগুলো হাত বুলিয়ে দেখি, লোভে আমার জিবে পানি এসে যায়।

যাই হোক বিকেলবেলা বাসায় ফিরে এসেছি, ভাইবোনদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমি তখন মানিক গ্রন্থাবলির সেটটার কথাই শুধু ঘুরেফিরে বলছি, কী অপূর্ব সেই বইগুলো, দেখে কেমন লোভ হয় কিছুই বলতে বাকি রাখিনি। আমার মা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত দাম?’ আমি বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ‘৩০০ টাকা। ’ আমার মা বললেন, ‘আমি তোকে ৩০০ টাকা দিচ্ছি, তুই কিনে নিয়ে আয়। ’

আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমাদের পরিবারের তখন যে অবস্থা তখন প্রতিটি পয়সা গুনে গুনে খরচ করা হয়। তার মধ্যে আমার মা আমাকে ৩০০ টাকা দিয়ে দিচ্ছেন- এ রকম ভয়ংকর একটা বিলাসিতার জন্য! ‘মানিক গ্রন্থাবলি’ কিনে আনার জন্য! টাকাটা কোথা থেকে দিচ্ছেন, এই টাকা দিয়ে বই কিনে ফেলার পর সংসারের কোন চাকাটা অচল হয়ে পড়বে, আমার সেই সব জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল! আমি তার কিছুই করিনি, মায়ের হাত থেকে টাকাটা নিয়ে ছুটতে ছুটতে সেই বইয়ের দোকানে হাজির হলাম। ভয়ে বুক ধুকপুক করছে। এর মধ্যে যদি কেউ সেই বইগুলো কিনে নিয়ে যায়, তাহলে কী হবে?

বইয়ের দোকানে গিয়ে দেখলাম বইগুলো তখনো আছে। আমি টাকা দিয়ে লোভীর মতো মানিক গ্রন্থাবলির পুরো সেট ঘাড়ে তুলে নিলাম। আহা কী আনন্দ!

বাসায় সবাই বই পড়ে, তাই সেই আনন্দ শুধু আমার একার নয়, সবার। কেউ তখন বাসায় এলে বিচিত্র একটা দৃশ্য আবিষ্কার করত, ঘরের একেক কোনায় একেকজন বসে, শুয়ে, আধাশোয়া হয়ে, কাত হয়ে, সোজা হয়ে মানিক গ্রন্থাবলি পড়ছে।
 
তারপর বড় হয়েছি, জীবনে বেঁচে থাকলে অনেক কিছু কিনতে হয়, অন্য অনেকের মতো আমিও কিনেছি। আমেরিকা থাকতে শোরুম থেকে নতুন গাড়ি কিনে ড্রাইভ করে বাসায় এসেছি, ঝকঝকে নতুন বাড়িও কিনেছি; কিন্তু সেই মানিক গ্রন্থাবলি কেনার মতো আনন্দ আর কখনো পাইনি, আমি জানি কখনো পাব না। এটি আমার জীবনের ঘটনা, যাঁরা আমার মায়ের কাছাকাছি এসেছেন, তাদের সবার জীবনে এ রকম ঘটনা আছে। কাউকে কিছু কিনে দিয়েছেন, কাউকে অর্থ সাহায্য করেছেন, কাউকে চিকিৎসা করিয়েছেন, কাউকে উপহার দিয়ে অবাক করে দিয়েছেন কিংবা কাউকে শুধু আদর করেছেন, দুঃখের সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন।

আমরা যখন আমেরিকা থাকি তখন একবার তাকে আমাদের কাছে বেড়াতে নিয়ে গেলাম। আমেরিকা দেখে আমার মা খুবই অবাক। তার শুধু একটাই প্রশ্ন, ‘মানুষজন কোথায় গেল?’ আমরা তাকে বোঝাই, মানুষজন কোথাও যায়নি, যাদের দেখছেন তারাই আমেরিকার মানুষ। আমরা যখন বাসায় থাকি না তখন মাঝেমধ্যে আমার মা হাঁটতে বের হন, রাস্তা ধরে এদিক-সেদিক হেঁটে আসেন। একদিন হেঁটে এসে আমাদের বললেন, ‘তোরা কখনো বলিসনি, এখানে একটা কবরস্থান আছে। কী সুন্দর কবরস্থান, কবরের ওপর কত ফুল। আমি সেই কবরগুলো জিয়ারত করে এসেছি। ’
আমি মাথায় হাত দিয়ে বললাম, ‘হায় হায়! আপনি জানেন, কী করেছেন?’
মা বললেন, ‘কী করেছি?’
আমি বললাম, ‘ওটা কুকুর-বেড়ালের কবর। আপনি কুকুর-বেড়ালের কবর জিয়ারত করে ফেলেছেন!’ এই দেশে কবরস্থানে কুকুর-বেড়ালকে কবর দেওয়া হয়। শুনে মা চোখ কপালে তুললেন আর আমরা হেসে কুটি কুটি হলাম।

দেশে থাকতে মা কত রকম কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন। আমেরিকায় তার কোনো কাজকর্ম নেই। আমার ছেলেমেয়েরা ছোট, তাদের বাংলা পড়তে শেখান। তখন নতুন পার্সোনাল কম্পিউটার বের হয়েছে, বাসায় একটা আছে, আমি সেখানে বাংলা লেখার ব্যবস্থা করেছি। একদিন মাকে বাংলা লেখা শিখিয়ে দিলাম। আমার মা তখন কম্পিউটারে বাংলায় দেশে ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনির কাছে চিঠি লিখতে শুরু করলেন। কম্পিউটারে বাংলায় লেখা মায়ের চিঠি দেখে দেশে সবাই হতবাক হয়ে গেল!

এত কিছু করেও মায়ের অনেক অবসর। আমার স্ত্রী তখন মাকে বলল, ‘আপনার এত ঘটনাবহুল একটা জীবন, আপনি বসে বসে সেই জীবনীটুকু লিখে ফেলেন না কেন?’ আমার মা একটু ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত লিখতে রাজি হলেন। তারপর বসে বসে তার বৈচিত্র্যময় জীবনীটুকু লিখে ফেলেন। আমি কম্পিউটারে সেটা টাইপ করে দিলাম। মা দেশে ফিরে যাওয়ার সময় তার হাতে পুরো পাণ্ডুলিপিটা দিয়ে দিলাম। ইচ্ছে করলেই কোনো প্রকাশককে দিয়ে সেটা প্রকাশ করানো যেত; কিন্তু কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে সেটা দেশে বাক্সবন্দি হয়ে থাকল। আমরা আমার মায়ের লেখা আত্মজীবনীর কথা ভুলেই গেলাম।

তারপর বহু দিন কেটে গেছে, আমি দেশে ফিরে এসেছি, তখন হঠাৎ করে উইয়ে কাটা অবস্থায় এই পাণ্ডুলিপি নতুন করে আবিষ্কৃত হলো, আমি তখন উদ্যোগ নিয়ে সময় প্রকাশনীকে সেটি দিয়েছি ছাপানোর জন্য। তারা খুব আগ্রহ নিয়ে প্রকাশ করার দায়িত্ব নিয়ে নিল। যখন বইয়ের ছাপা শেষ, বাঁধাই হচ্ছে তখন হঠাৎ করে আমার মায়ের খুব শরীর খারাপ। কী কারণে তার ধারণা হলো, তিনি বুঝি আর বাঁচবেন না। আমি তখন সিলেটে। আমাকে ফোন করে বললেন, ‘বাবা, যদি তোদের সঙ্গে কখনো ভুল করে থাকি, মনে কষ্ট রাখিস না। আমাকে মাফ করে দিস। ’

শুনে আমার মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। মাকে মাফ করে দেব মানে? আমি তখন তখনই সময় প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, আমার মায়ের বইয়ের কী অবস্থা। ফরিদ জানালেন, বই বাঁধাই হচ্ছে। আমি বললাম, এই মুহূর্তে দুটি বই বাঁধাই করে আমার মায়ের হাতে দিয়ে আসতে হবে। আমি জানি, একজন লেখকের জীবনের প্রথম বইয়ের থেকে বড় আনন্দ পৃথিবীতে নেই। ফরিদ ছুটতে ছুটতে বই নিয়ে আমার মায়ের হাতে তুলে দিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার মায়ের সব অসুস্থতা দূর হয়ে গেল! আমার মা পুরোপুরি ভালো হয়ে গেলেন! শুধু ডাক্তাররা চিকিৎসা করে, কে বলেছে, আমিও চিকিৎসা করতে পারি।

আমার মা খুবই আন্তরিকভাবে এই বইটি লিখেছিলেন। যারাই বইটি পড়েছে তাদের সবার হৃদয় স্পর্শ করেছে। একজন মানুষ জীবনে কতভাবে কষ্ট পেতে পারে, এই বইটি পড়লে সেটি বোঝা যায়।

হুমায়ূন আহমেদ মারা যাওয়ার পর আমার মা আবার নতুন করে যে কষ্ট পেয়েছিলেন, সেই কষ্ট থেকে বের হয়ে আসতে পারবেন আমরা কেউ ভাবিনি। সেই কষ্ট ভুলে থাকার জন্য আমার মা বসে বসে তার কাছে চিঠি লেখার মতো করে অনেক কিছু লিখেছেন। পাণ্ডুলিপিটি আমার কাছে আছে, হয়তো এটাও কোনো প্রকাশককে দিয়ে কখনো প্রকাশ করিয়ে দেব।

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুটি আমার মাকে খুব বড় একটা আঘাত দিয়েছে, সত্যিকারভাবে আমার মা কখনোই সেই আঘাত থেকে বের হতে পারেননি। আমরা টের পেতাম তার মনটি ভেঙে গেছে। একজনের মন ভেঙে গেলে তাকে জোর করে বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখা যায় না। আমরাও পারিনি। গত ২৭ সেপ্টেম্বর আমার মা তার বড় ছেলে হুমায়ূন আহমেদের কাছে চলে গেছেন। তিনি সম্ভবত আমার বাবাকে নিয়ে আমার মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তারা তখন একজন আরেকজনকে কী বলেছিলেন আমার খুব জানার কৌতূহল হয়।

২.
খবরের কাগজে আমার মায়ের মৃত্যু সংবাদ ছাপানোর সময় অনেকেই তাকে রত্নগর্ভা বলে সম্বোধন করেছেন। এই বিশেষণটি পড়ে আমি দুই কারণে একটু অস্বস্তি বোধ করেছি। এক. এটি সত্যি হলে আমাদের ভাইবোনের সবারই ছোট-বড়, মাঝারি রত্ন হয়ে ওঠার একটা চাপ থাকে, কাজটি সহজ নয়। দুই. এই বিশেষণটি সত্যি হলে বোঝানো হয় আমার মায়ের নিজের কোনো অবদান নেই। তার একমাত্র অবদান হচ্ছে তিনি ছোট-বড়, মাঝারি ‘রত্ন’ জন্ম দিয়েছেন!

কিন্তু আমি জানি রত্নগর্ভা হিসেবে নয়, আসলে আমার মা একজন খুব সাদাসিধে মা হিসেবেই অনেক বড় অবদান রেখেছেন। আমার মা যেভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে আমাদের পুরো পরিবারটিকে রক্ষা করেছেন তার কোনো তুলনা নেই। যদি বুক আগলে আমাদের রক্ষা না করতেন, তাহলে আমরা কেউ টিকে থাকতে পারতাম না।

কিভাবে, কিভাবে জানি আমার মায়ের একটা পরিচিতি হয়েছে। তিনি অসুস্থ হলে টেলিভিশনে খবর প্রচারিত হয়, তিনি মারা গেলে খবরের কাগজে কালো বর্ডার দিয়ে খবর ছাপা হয়। কিন্তু আমি আমার মাকে দেখে বুঝেছি, এই বাংলাদেশে নিশ্চয়ই আমার মায়ের মতো অসংখ্য মা আছেন, যারা যুদ্ধে স্বামীকে হারিয়েছেন এবং যারা নিজের সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য ঠিক আমার মায়ের মতো সংগ্রাম করেছিলেন। তাদের কথা কেউ জানেন না, তাদের কথা কেউ বলেন না। আমার মনে হয়, আমাদের বাংলাদেশ যে পৃথিবীর অন্য দশটা দেশ থেকে ভিন্ন তার একটা বড় কারণ, মুক্তিযুদ্ধের পর এ দেশে অনেক মা ঘর থেকে বের হয়ে সংগ্রাম শুরু করেছেন। বেঁচে থাকার জন্য সেই সংগ্রামের কথা কতজন জানে? মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধক্ষেত্রে যে যুদ্ধ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের দেশের সেই মায়েদের যুদ্ধ তাঁদের থেকে কোনো অংশে কম নয়। আমরা কী সেটা মনে রাখি?

একদিন যখন বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াবে, তখন আমরা কী বাংলাদেশের সেই অসংখ্য মায়ের কথা স্মরণ রাখব? যে সাদাসিধে মায়েরা সন্তানদের রক্ষা করার জন্য সিংহীর সাহস নিয়ে কঠিন পৃথিবীর মুখোমুখি হয়েছিলেন, বুক আগলে তাদের রক্ষা করেছিলেন?

আমি আজকে আমার নিজের মায়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের এ রকম অসংখ্য মায়ের কাছে একটুখানি ভালোবাসা পৌঁছে দিতে চাই। একটুখানি শ্রদ্ধা পৌঁছে দিতে চাই।

বাংলাদেশ সময়: ০০১০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।