ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

তাইতো কালো আমার শ্যামা

তারাপদ আচার্য্য, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৪
তাইতো কালো আমার শ্যামা

কালীপূজা শক্তির পূজা। তান্ত্রিক ধারার প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান।

শক্তি সাধক তন্ত্রানুসারীরা বিশ্বাস করেন- সৃষ্টির মূলে আছেন আদ্যাশক্তি মহামায়া। নির্গুণ পরমব্রহ্ম যখন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে উঠলেন তখন তার মধ্যে ঘটলো গুণের প্রকাশ। এই গুণই হচ্ছে মহাশক্তি। শুরুর শেষ আছে। সৃষ্টির শেষ হচ্ছে ধ্বংস। মাঝে স্থিতিকাল। মহাশক্তি এই সৃষ্টি, স্থিতি প্রলয়ের অধিশ্বরী। তিনি মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী নামেও পূজিতা।

আদিকাল থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আধ্যাত্মিক চেতনার দু’টি প্রধান ভিত্তি হিসেবে বেদ ও তন্ত্র স্বীকৃত। বেদের ধারাবাহিকতায় যাগযজ্ঞের পাশাপাশি যোগ সাধনার বিকাশ ঘটেছে, যার মূল সূত্র হচ্ছে-‘সো-অহং’; অর্থাৎ স্রষ্টাকে পরমসত্য হিসেবে ধরে নিয়ে ‘আমি’কে তা জানার চেষ্টাই হচ্ছে যোগ সাধনা। পক্ষান্তরে, তন্ত্র সাধনার মূল সূত্র হচ্ছে ‘অহং-স’। ‘আমি’কে সত্য ধরে নিয়ে ‘তিনি’ সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধির চেষ্টা। বেদ ও তন্ত্র পরস্পর বিরোধী এ ধরনের  উক্তি অজ্ঞতা প্রসূত। বৈদিক ধারার নির্যাস গীতা ও তান্ত্রিক ধারার নির্যাস গ্রন্থ শ্রীশ্রীচণ্ডী।

চণ্ডীতে আদ্যাশক্তির বিবরণ পাওয়া যায় বিভিন্ন কাহিনীর মধ্য দিয়ে। মহাশক্তিকে কালীরূপে আরাধনা করার বিষয়ে বিভিন্ন পুরাণে বর্ণিত কাহিনী অনুসারে হিমালয় দুহিতা পার্বতী ছিলেন জন্মসূত্রে কৃষ্ণবর্ণা। শিব একবার তাঁকে কালী বলে বিদ্রুপ করেছিলেন। এতে কুপিতা পার্বতী দীর্ঘদিন সাধনা করে গৌরবর্ণ অর্জন করেন; হয়ে যান গৌরী।

প্রতিবছর দুর্গাপূজার পর আসে কালীপূজা। বিজয়া দশমীর চারদিন পর পূর্ণিমা তিথিতে হয় লক্ষ্মীপূজা। লক্ষ্মীপূর্ণিমার পরবর্তী অমবস্যা কালীপূজার তিথি হিসেবে নির্ধারিত। দুর্গাপূজা মূলত বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সেই তুলনায় কালীপূজা অনুষ্ঠান অনেক ব্যাপক। অঞ্চল ভেদে কালীপূজায় যুক্ত হয়েছে কিছু লোকজ উপাদান। গ্রাম বাংলায় কালীপূজার আগে পক্ষকালব্যাপী আকাশ দীপ জ্বালানো হয়। লম্বা বাঁশের মাথায় একটা লন্ঠন লাগিয়ে তা উঁচু করে টানানো হয়। এ সময়ে আমাদের দেশে পোকার উপদ্রব বাড়ে। হয়তোবা পোকা ধ্বংস করার জন্যই আকাশ দীপ জ্বালানো হয়ে থাকে।

শাস্ত্রমতে, দুর্গার দশমহাবিদ্যা রূপের মধ্যে প্রধান রূপ হচ্ছেন কালী। বিবসনা নৃমু-মালিনী কালী ভীষণা সৌন্দর্যের প্রতীক। তিনি একাধারে বরাভয় প্রদান করেন, পাশাপাশি অসুর নিধনের মধ্য দিয়ে ন্যায়ের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাতৃকাশক্তির আরাধনার মধ্য দিয়ে সাধক নিজে শক্তিমান হয়ে ওঠেন। সাধকের শুভশক্তি নিয়োজিত হয় জগতের কল্যাণে। সৃষ্টির আদি কারণ হিসেবে মাতৃকাশক্তিকে গ্রহণ করা আধ্যাত্মিক ভাবনার এক অনন্য দিক। মা ও সন্তানের নৈকট্য সৃষ্টির সবচেয়ে নিবিড় বন্ধন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির এই বন্ধনের অনুভূতি মানুষের মনে যথার্থভাবে জাগ্রত হলে তখন আর কারও পক্ষে অন্যায় পথে পা বাড়ানোর সুযোগ থাকে না।

দুর্গাপূজার পরই কালীপূজা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান। দুর্গাপূজা যেমন দুর্গোৎসব, কালীপূজা কিন্তু তেমনিভাবে কালী উৎসব নয়। অবশ্য কালীপূজার সাথেও রয়েছে উৎসবের নিবিড় সম্পর্ক। সে উৎসব দেওয়ালী। বাঙালি বলে দিপান্বীতা। দিপান্বীতা-অমাবস্যার গভীর রাতে কালীপূজা অনুষ্ঠিত হয়। কালীপূজার রাতে সনাতন ধর্মবলম্বীদের ঘরে ঘরে সহস্র প্রদীপ জ্বলে ওঠে। আলোর বন্যায় ভেসে যায় চারদিক। হেলেদুলে জ্বলতে থাকা প্রদীপ শিখা ঘোষণা করে প্রাণের অস্তিত্ব। যে প্রাণ অন্ধকার থেকে আলোয় যাওয়ার জন্য ব্যাকুল। তাই এ রাত দেওয়ালী, দিপাবলী বা দিপান্বীতার রাত হিসেবে খ্যাত।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন-
“সকল জ্ঞানের অতীত যে মা
তাইতো কালো আমার শ্যামা
জ্ঞানরূপী শিব চরণে তাঁর লুটিয়ে পড়ে রয়,
আমার নাই আঁধারের ভয়। ”

কালীর পদে লুটিয়ে থাকা জ্ঞানের সন্ধান যিনি পেয়েছেন তাঁর স্থান সকল ভেদাভেদের উর্ধ্বে। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব আধ্যাত্মিক সাধনার সকল পন্থার মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন মূলত কালী সাধক। বহুবার তিনি নিজেকে ‘ন্যাংটা মায়ের ন্যাংটা ছেলে’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। এই উক্তির মধ্য দিয়ে  তিনি সবাইকে বুঝাতে চেয়েছেন, তাঁর পাওয়ার কিছু নেই, হারাবারও কিছু নেই।

কালী হচ্ছেন তান্ত্রিক ধারার প্রধান আরাধ্যা দেবী। সাধক অজ্ঞানের অন্ধকার ভেদ করে আলোর সন্ধান লাভের জন্য আকূল থাকেন। অন্ধকার থেকেই আলোর পথে যাত্রা শুরু বলে কালীপূজার নির্ধারিত সময় অমাবস্যার গভীর কালো আঁধার রাত। একই কারণে কালীর গাত্রবর্ণও কালো।

তারাপদ আচার্য্য: সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ

বাংলাদেশ সময়: ১৪১২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।